শাহজালালে সক্রিয় শক্তিশালী ডলার পাচার চক্র
- প্রকাশের সময় : ০৫:০৫:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
- / ৫১ বার পঠিত
ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি শক্তিশালী চক্র ডলার কারসাজি ও পাচার করে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অনেকগুলো সংস্থার মাঝখানে থেকেও বিমানবন্দরকেন্দ্রিক এত বড় চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এসব অপরাধ করে যাচ্ছে।
দেশে ডলার সংকটের অন্যতম কারণ এই চক্র। রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় চক্রটি কাজ করছে বলেও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোটি কোটি ডলার পাচার করে আসছে তারা। জাল-জালিয়াতি করে এই চক্রটি প্রতিদিন প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা বিদেশে পাচার করছে। এ কারণে বাংলাদেশে ডলার, ইউরোসহ বিদেশি মুদ্রার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় ও পাচারে জড়িত দেশের ছয়টি ব্যাংক ও দুটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। ছয়টি ব্যাংক হলো রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক; বেসরকারি মিচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ, যমুনা ব্যাংক এবং এভিয়া মানি এক্সচেঞ্জ ও ইমপেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ।
প্রতিদিন হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিভিন্ন দেশের নাগরিক শাহজালাল বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তারা বিমানবন্দরে থাকা ব্যাংকের বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা দিয়ে টাকা সংগ্রহ করেন। বিমানবন্দরে থাকা উল্লিখিত ৭ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া ভাউচার দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশি লোকজনের কাছ থেকে ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা কিনে তা কালোবাজারিদের মাধ্যমে পাচার করেন। বিদেশি মুদ্রা কেনার পর সেই মুদ্রা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে যুক্ত করার কথা থাকলেও সেটা করা হয় না। বরং এ সংক্রান্ত কোনো প্রকার তথ্য না দিয়ে মানিল্ডারিং করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরে ছয়টি ব্যাংক ও দুই মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ বিদেশি মুদ্রা পাচারে জড়িত শক্তিশালী কালোবাজারি চক্রের হোতাদের ধরতে সম্প্রতি অভিযানে নেমেছে দুদক। দুদকের এনফোর্সমেন্টের টিম কয়েকদিন ধরে অভিযান চালিয়ে বিদেশি মুদ্রা পাচারের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। ছয়টি ব্যাংকের ১৯ জন ব্যাংক কর্মকর্তা, দুটি নিবন্ধিত মানি এক্সেচেঞ্জ এর মালিকসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে দুদক দুটি মামলা করেছে। বুধবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম মামলাটি করেন।
আসামিরা হলেন- জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সুরুজ জামাল, প্রিন্সিপাল অফিসার শামীম আহমেদ, প্রিন্সিপাল অফিসার আশিকুজ্জামান, সিনিয়র অফিসার অমিত চন্দ্র দে, সিনিয়র অফিসার মানিক মিয়া, সিনিয়র অফিসার সাদিক ইকবাল, সিনিয়র অফিসার সুজন আলী, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আনোয়ার পারভেজ, সিনিয়র অফিসার হুমায়ুন কবির; সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সোহরাব উদ্দিন খান, সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) শরীফুল ইসলাম ভূইয়া, সিনিয়র অফিসার মোহাম্মদ সবুজ মীর, সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) খান আশিকুর রহমান, সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) এবিএম সাজ্জাদ হায়দার, সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) কামরুল ইসলাম, অফিসার সামিউল ইসলাম খান, সাপোর্টিং স্টাফ মোশারফ হোসেন; অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার আব্দুর রাজ্জাক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অফিসার আবু তারেক প্রধান, এভিয়া মানি চেঞ্জারের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার আসাদুল হোসেন ও ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম কবির আহমেদ। তাদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২); মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭ এর ২৩(১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এজাহারে অভিযোগ আনা হয়েছে, জাল ভাউচার তৈরি করে বিদেশফেরত প্রবাসী এবং বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের থেকে সংগৃহীত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে অন্তর্ভুক্ত না করে বেআইনিভাবে কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। আসামিরা ফরেন কারেন্সি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশমালা ও ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭ অনুযায়ী অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধ করেছেন।
কিছু ব্যাংকার ও অসাধু চক্র লাভবান হওয়ার জন্য বেআইনিভাবে দীর্ঘদিন ধরে ডলার কারসাজি ও পাচার করে আসছে। ফলে প্রবাসী বা বিদেশিদের বিক্রি করা ডলার দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। সাধারণত বিমানবন্দরে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব অর্থে বৈদেশিক মুদ্রা কেনার কথা। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের টাকা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা না কিনে তাদের ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে তা কিনছেন। পরে এসব ডলার বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছে চড়া দামে বিক্রি কিংবা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন। এ খাত থেকে চক্রটি প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে। এ কারণে মাসে ৫০ কোটি টাকার বেশি অর্থ সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এ চক্রের কারণে প্রবাসীদের কাছ থেকেও ক্রয়কৃত ডলার বা বিদেশি মুদ্রা সরকারের খাতায় যোগ হচ্ছে না। বহু বছর ধরে তারা এই কাজ করে আসছে। অথচ এতদিন তারা ছিল ধোরাছোয়ার বাইরে। একাধিক সংস্থা জানায়, ডলার কারসাজি ও জাল-জালিয়াতির ভাগ তারা একা পায়নি। এর সাথে অনেকে জড়িত। যারা এর নেপথ্যে রয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা না গেলে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা পাচার বন্ধ হবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বৈদেশিক অর্থের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা, রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু বিমানবন্দরের এ রকম অসাধু চক্রের কারণে এসব উদ্যোগ নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আমরা আশা করব, এসব অনিয়মকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। অন্যথায় ডলার আসার স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবে, আর সরকার বঞ্চিত হবে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে।
দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এ বিষয়ে বলেন, বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আসামিদের বিরুদ্ধে বিদেশি মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারকারী দুর্নীতিবাজদের অবৈধভাবে মুদ্রা সরবরাহ করছেন।
দেশে চলমান ডলার সংকটের পেছনে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয়কে দায়ী করে তিনি বলেন, অবৈধভাবে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের কারণে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। অবৈধ এসব অর্থ দেশের বাইরে পাচারও হতে পারে। দুদক এখন থেকে এসব বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করবে। সূত্র : ডেইলি-বাংলাদেশ
হককথা/নাছরিন