দুর্নীতির ‘মাস্টারমাইন্ড’
উন্নয়নের ২০ শতাংশই জ্যাকবের
- প্রকাশের সময় : ০৩:১৩:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ২৫ বার পঠিত
ভোলা-৪ (চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনে ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতির ‘মাস্টারমাইন্ড’ সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত রাখতে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘জ্যাকব সেনা’ নামের সন্ত্রাসী বাহিনী। হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, জমি দখল, কমিশনবাণিজ্য ছিল তার অনুসারীদের পেশা। ১৫ বছরে ভোলা-৪ আসনে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিলেন তিনি।
এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশল প্রভৃতি সরকারি দপ্তরের নথিতে দেখা যায়, এসবের বিভিন্ন প্রকল্পের অধিকাংশ বরাদ্দ চলে যেত ভোলা-৪ আসনে অর্থাৎ চরফ্যাশন ও মপনুরায়। উন্নয়ন প্রকল্পের ২০ শতাংশ কমিশন যেত এমপি জ্যাকবের পকেটে। সরকার দলীয় বা বিরোধী দলীয় যেই হোক না কেন ২০ শতাংশ কমিশন না দিলে ওই আসনের কোনো ঠিকাদারই কাজ পেত না।
নেতার সঙ্গে তর্ক করায় বাস ভাঙচুর করল বিএনপি কর্মীরা, চালককে মারধরনেতার সঙ্গে তর্ক করায় বাস ভাঙচুর করল বিএনপি কর্মীরা, চালককে মারধর টেন্ডারবাজি ও কমিশনবাণিজ্য বন্ধের দাবিতে ২০২০ সালে ভোলার এলজিইডি ভবন ঘেরাও করে মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে স্থানীয় ঠিকাদার অ্যাসোসিয়েশন। দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হলেও শেখ পরিবারের প্রভাবশালী এক নেতার (শেখ ফজলে নুর তাপস) ব্যাবসায়িক অংশীদার হওয়ায় তার প্রভাবে ২০২১ সালে দুদকের অনুসন্ধান থেকে রেহাই পান জ্যাকব।
এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জ্যাকব। জমি দখল করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিয়োগবাণিজ্য, ম্যানগ্রোভ বনের কাঠ কেটে ইটভাটায় পোড়ানো, দখল করা জমিতে খামার ও রিসোর্ট নির্মাণ, জেলেদের ভিজিএফের চাল আত্মসাৎ, দলের মনোনয়ন বাণিজ্য প্রভৃতি উপায়ে হাতিয়ে নেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। পরিবারের সদস্যদের নামে দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দুবাই ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছেন।
আওয়ামী লীগ বিজেপির ভোটের রাজনীতিতে হাওয়া দিচ্ছে: জুনায়েদ সাকিআওয়ামী লীগ বিজেপির ভোটের রাজনীতিতে হাওয়া দিচ্ছে: জুনায়েদ সাকি
মেসার্স ইলিয়াছ এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি মো. বাবলু জানান, ‘উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানরা ২০ শতাংশ কমিশনের টাকা জোগাড় করে জ্যাকবের কাছে পৌঁছে দিলেই মিলত কাজ।’
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জ্যাকব আত্মগোপন করলেও তার কমিশন বাণিজ্যের সহযোগীরা বহাল আছে। চরফ্যাশন এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী মোশারেফ হোসেন ছিলেন ওই দপ্তরের কমিশন আদায়কারী। ঠিকাদারদের বিল আটকে রেখে এমপির কমিশন আদায় করাই ছিল তার প্রধান দায়িত্ব। এমপির বিশ্বস্থতা অর্জন করে একই দপ্তরে রয়েছেন ৫ বছরের বেশি সময় ধরে। অবশ্য প্রকৌশলী মোশারেফ হোসেনের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জ্যাকবের কমিশনবাণিজ্যের সহযোগী হিসেবে পরিচিত পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলা ডিভিশন-২-এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ তার দপ্তরের প্রতিটি কার্যাদেশের জন্য ২০ শতাংশ অর্থ ঠিকাদারের কাছ থেকে আদায় করে জ্যাকবের কাছে পৌঁছে দিতেন। এমপির লোক হিসেবে অনেক বছর একই কর্মস্থলে থেকে প্রমোশন নিয়ে চলতি বছরে কর্মস্থল ছাড়েন তিনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে তাকে মোবাইল ফোনে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় জেনে কল কেটে দেন তিনি।
কমিশন সহযোগী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর চরফ্যাশন সাব ডিভিশনের সহকারী প্রকৌশলী কামাল হেসেন বলেন, ‘অফিসিয়াল নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় এমপির পরামর্শ ছাড়া আমরা কাজের সাইট দিতে পারি না। তাই এমপির নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে হত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চরফ্যাশন উপজেলা আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত এক নেতা বলেন, ‘পৌরসভা মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান পদের জন্য ৫ কোটি এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নের জন্য ২ কোটি করে নিতেন এমপি জ্যাকব। যারা এ অর্থ দিতে ব্যর্থ হতেন তারা দলের ত্যাগী বা জনপ্রিয় নেতা হলেও মনোনয়ন পেতেন না।’
চরফ্যাশন উপজেলার নুরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের এডিবি, টিআর, কাবিখা, সৃজনশীল কর্মসূচীর সম্পূর্ণ টাকা এমপি জ্যাকব নিয়ে যেতেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা স্বাক্ষর করতেন কেবল। এসবের বিরোধিতা করায় নৌকা প্রতীক পেয়েও তিনি ২০১৯ সালের ইউপি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। এসব বিষয় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েও লাভ হয়নি।’
সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্যাকবের বার্ষিক আয় ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় ছিল মাত্র ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার হাতে নগদ ৫ লাখ টাকার কম দেখালেও ১৫ বছরের ব্যবধানে তা ১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
২০০৮ সালে স্থাবর সম্পদ হিসেবে পৈতৃকসূত্রে ঢাকার দুটি ফ্ল্যাট ও চরফ্যাশনে একটি বাড়ি দেখানো হলেও এখন পৈতৃক সম্পত্তির বাইরে তার স্থাবর সম্পদ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ২৫ হাজার ১৭৪ টাকার হয়েছে। তার স্ত্রীর নামেও সম্পদ বেড়েছে। এছাড়াও জ্যাকবের রয়েছে বিলাসবহুল রিসোর্ট, গরুর খামার, মাছের খামার ও কৃষিজমি।
হলফনামার বাইরেও রাজধানীর ধানমন্ডিতে ৩টি ফ্ল্যাট, গুলশানে ১টি বাড়ি, গাজীপুরে ১৫০ একর জমির উপর বিলাসবহুল খামার বাড়ি ও নরসিংদীতে ১০০ একর জমির উপর মৎস্য খামার রয়েছে জ্যাকবের।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে ভোলা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও জানা সম্ভব হয়নি। সূত্র : দেশ রুপান্তর।