নীরবে চলে গেছে ৫ জানুয়ারি
হাসিনার দানবীয় যাত্রা শুরু
- প্রকাশের সময় : ১১:৪৩:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫
- / ২৫ বার পঠিত
নীরবে চলে গেছে ৫ জানুয়ারি। দিবসটি দেশের রাজনীতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৪ সালের এই দিন প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে শেখ হাসিনার দানবীয় রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়। জনগণ প্রত্যাখ্যাত ওই নির্বাচনে ১৫৪টি আসনে বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন নৌকার প্রার্থীরা। অথচ সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫১ আসনে বিজয়ী হলেই সরকার গঠন করা যায়। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
এর আগে পিলখানা হত্যাকা-, ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা এবং ৩০ জুন সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, শাপলা চত্বরে গভীর রাতে হেফাজতের জমায়েতে আলেমদের হত্যা, ২০১০ সালের ২৫ জুন ঢাকা সিটি করপোরেশনের রমনা শাহবাগ এলাকার তৎকালীন কমিশনার চৌধুরী আলম ও ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী এলাকা থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা ঘটলেও তখনো হাসিনা দানব হয়ে উঠেনি। ২০১৪ সালের পাতানো নির্বাচনের পর ‘নির্বাচিত’ এমপিরা তিন থেকে সাড়ে তিন বছর নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারেননি। এমনকি জনরোষের ভয়ে বেশির ভাগ এমপি পুলিশ প্রহরা ছাড়া বের হতে পারেননি। ওই সময় যে দু’চারজন এমপি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন এবং এলাকায় গেছেন তারা কেউ দৌড়ানি খেয়েছেন, কেউ গণপিটুনি খেয়েছেন। সে খবর গণমাধ্যমে প্রচারও হয়েছে। ভারতের নীল-নকশায় নির্বাচনের নামে প্রহসনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সরকার গঠনের পর ইনকিলাব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও নির্বাচন নামের প্রহসনের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। তথাকথিত নির্বাচনের পর কিছু গণমাধ্যমকে তাঁবেদার হিসেবে ধরে শেখ হাসিনা সেগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন; ওই সব গণমাধ্যম সরকারের তোষামোদির প্রতিযোগিতায় নামে; অন্যদিকে; দৈনিক ইনকিলাবসহ কয়েকটি গণমাধ্যমকে শত্রুপক্ষীয় গণমাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করে। সরকারের অপকর্ম তুলে ধরায় ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব বন্ধ করে দেয়। ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ আদালতে লড়াই করে ২৯ জানুয়ারি পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের রায় পায়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হাসিনা হয়ে উঠেন দানবরূপী একজন ভয়ঙ্কর নেত্রী। বিএনপিকে ফঁাঁদে ফেলে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনে আগের রাতে ভোট করে নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি ডামি প্রার্থীর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভোট পড়ে এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাননি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর হাসিনা মূলত ভয়ঙ্কর নেত্রীতে পরিণত হন। তিনি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের গুম করে ‘আয়নাঘরে’ রাখেন বছরের পর বছর। একদিকে জুলুম-নির্যাতন, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে লুটপাট, বুদ্ধিজীবী, সুশীল, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের মধ্যে ‘স্তবক’ সৃষ্টি করেন। ১০ বছর আগে শেখ হাসিনার দানবীয় হয়ে উঠার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেমন ছিল? ইনকিলাব নির্বাচনের পরের দিন ৬ জানুয়ারি ওই নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরেছে। নির্বাচনের দিনের চিত্র স্মরণ করতে পাঠকদের জন্য ৬ জানুয়ারি মুদ্রিত ‘নীরব প্রত্যাখ্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদনটির সংক্ষিপ্তাংশ তুলে ধরা হলো।
‘নীরব প্রত্যাখ্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদ ‘পাতানো’ নির্বাচনকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘না’ করে দিয়েছে। সারা দেশের ভোটাররা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। নজিরবিহীন এ ঘটনায় গোটা বিশ্ব হতবাক। প্রশাসন, যৌথবাহিনী, পুলিশ, ডিসি, এসপি এমনকি নির্বাচন কমিশনও ভোট বৃদ্ধির চেষ্টায় দৌড়ঝাঁপ করেছে, আদেশ-নির্দেশ দিয়েছে। কোনো কাজ হয়নি। প্রার্থীরা ক্যাশ টাকা দিয়েও ভোটারের কেন্দ্রমুখী করতে পারেননি। ক্যাশ টাকা দিয়ে ভোটার উপস্থিতির চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বাঁকা পথ গ্রহণ করা হয়। ভোট না দিলে ভিজিএফ, বিধবা-ভাতা, বয়স্ক-ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, আইডি কার্ড বাতিলের ভয় দেখানো হয়। এসব করেও ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের বিপুল-সংখ্যক কর্মী-সমর্থকও নির্বাচনে ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকে নির্বাচনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রধান মুনিরা খান জানিয়েছেন শতকরা হিসাবে সাড়ে ৯ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। আর চ্যানেল ২৪ হিসেবে শতকরা ৯ পয়েন্ট ৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।
আমজনতার বিরোধিতার মুখে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই আয়োজিত নির্বাচনে ভোট প্রতিহত করতে গিয়ে ২১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ১৪৭ সংসদীয় আসনের ১৮ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে পাঁচ শতাধিক কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। প্রায় ১২ হাজার ভোটকেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের আশপাশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে ১৭ জেলায় ৪০০ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করতে হয়েছে। ৪৮টি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ভোটের বাক্স পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা নিজেরাই শত শত ভোট দেয়ায় ২৪ জন প্রার্থী ভোট চলাবস্থায় নির্বাচন বর্জন করেন। পাবনার ভোটারশূন্য কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পুত্র আশিক সামস একাই ৪৭৫ ভোট দিয়ে রেকর্ড গড়লেও নৌকা এবং অন্যান্য মার্কার অনেক প্রার্থী ভোট দিতে পারেননি। তারা কেন্দ্রে যাওয়ার আগে তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। ভোট গ্রহণের সময় প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার মারা গেলে পাঁচ লাখ এবং গুরুতর আহত হলে দুই লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ভোট গ্রহণে তাদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য মাইকিং করে এ বার্তা দেয়া হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধে অনেক ভোটকেন্দ্র থেকে প্রিজাইডিং-পোলিং অফিসার ভোট গ্রহণের সরঞ্জাম ফেলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। পুলিশ ফাঁড়ি দখল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র কেড়ে নেয়া, ভোটকেন্দ্র তছনছ করা, ব্যালট পেপার ও ভোটের বাক্স গুঁড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে শত শত কেন্দ্রে। এমনকি নগদ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এবং ভবিষ্যতে নিরাপদে এলাকায় থাকার নিশ্চয়তা দিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। রাজধানী এবং বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় মহিলা-পুরুষ ভোটারদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোটকেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে রেখে মিডিয়ায় ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে যাতে কৌশল করে অধিক ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় এবং ভোটারশূন্য কেন্দ্র দেখানো থেকে বিরত থাকে সে জন্য নগদ অর্থ ছড়ানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শত শত ভোটকেন্দ্রে ভোট প্রয়োগের সংখ্যা এতই কম যে, দুপুর ১টা পর্যন্ত (ভোট গ্রহণ শুরুর ৫ ঘণ্টা) একটি ভোটও পড়েনি। একজন ভোটারও ভোট দেননি এমন কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। শুধু লালমনিরহাট জেলায় ৩১ ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার ভোট দেননি। জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা জানান, অনেক প্রার্থী ভোটের দিন নিরাপত্তার ভয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাননি। কেউ কেউ পুলিশ প্রহরায় ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করলেও কয়েকজন প্রার্থীকে ‘কান ধরে উঠবস’ করিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন নৌকা মার্কার সাবেক মন্ত্রী-এমপি অনেক প্রার্থী। তামাশার এই নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী এবং সাজানো বিরোধী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও ভোট গ্রহণকালে স্বচ্ছতার প্রমাণ দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই একতরফাভাবে পড়েছে জাল ভোট।
নির্বাচনকে সাধারণ ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বর্জন করায় শতকরা হিসাবে ভোট প্রদানকারীর সংখ্যা দুই সংখ্যা ছুঁতে পারেনি। অনেক কেন্দ্রে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রে একজনও ভোটার না থাকায় কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। কোথাও কোথাও মিডিয়ায় ভোটারদের অংশগ্রহণ প্রচারের জন্য কৃত্রিমভাবে দলীয় লোকজনকে লাইনের দাঁড় করিয়ে রাখা হলেও সেসব কেন্দ্রে শতকরা ১২ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। দুপুরে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়, যে ভোট কাস্ট হবে সেটিই প্রচার করা হবে। ভোট প্রদানের সংখ্যা কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধির সুযোগ নেই। তবে দিনভর নির্বাচন কমিশন ভোট নিয়ে লুকোচুরি করে। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট চলার সময় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভোটের শতকরা হিসাব ঘোষণা করা হলেও এবার সেটি করা হয়নি; বরং কমিশনের কিছু কর্মকর্তাকে ভোটের হিসাব নিয়ে লুকোচুরি ও রহস্যজনক আচরণ করে। সিইসির এ বক্তব্যের পর কয়েকটি মিডিয়া নিজস্ব রিপোর্টারদের মাধ্যমে ভোট প্রদানের হিসাব করে প্রচার করে এ নির্বাচনে ভোট প্রদানের শতকরা হিসাবে ১০-এর নিচে। চ্যানেল ২৪-এর রিপোর্টে বলা হয় শতকরা সাড়ে ৯ শতাংশ ভোটার ভোট প্রয়োগ করেছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রধান মুনিরা খান জানিয়েছেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনে ভোট পড়েছে শতকরা ১০ শতাংশের নিচে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ১৪৭ আসনে শতকরা ৯ দশমিক পাঁচজন ভোটার ভোট প্রয়োগ করেছেন। মিডিয়ার এ খবর প্রচার হওয়ার পর রাতে নির্বাচন কমিশনে ছুটে যান আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম, ড. আবদুর রাজ্জাক ও হাসানুল হক ইনু। তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোট প্রদানের শতকরা হিসাবে বৃদ্ধি করে সম্মানজনক করার প্রস্তাব দেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অবশ্য ইসি সেটি প্রচার করেনি (সংক্ষিপ্ত)। সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব।