ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এখন যে চারটি বিষয় ও একটি প্রশ্ন সামনে আসছে
- প্রকাশের সময় : ০৫:৫০:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৪৯ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। বিগত তিনটি সরকারের আমলে যে দেশটির সঙ্গে তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যারা সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সেই দেশটি নিঃসন্দেহে ভারত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন মেয়াদেও সেই ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বিগত দেড় দশকে ক্রমশ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত একাধিকবার বলেছে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশই তাদের ‘সব চেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’।
পূর্বের সময়কালে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি বা সংযোগ, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন, স্থল ও সমুদ্রসীমায় বিরোধ নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা– ইত্যাদি বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় অভাবনীয় অগ্রগতি দেখা যায়।
তবে এর মধ্যে সব ইস্যুরই যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। সীমান্ত বিরোধ মিটলেও সীমান্তে হত্যা নিয়ে অস্বস্তি যেমন রয়েই গেছে, তেমনি আবার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও তিস্তাচুক্তির জট এখনো খোলা যায়নি। ফলে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদি ও ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকার বিগত এক দশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে ‘টেমপ্লেট’ বা কাঠামোটা গড়ে তুলেছেন, সেটি আরও অন্তত পাঁচ বছর অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে ধরেই নেওয়া যায়।
আর এই পটভূমিতেই বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লিতে এসেছেন বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই বিদেশে তার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর– যেখানে তিনি বৈঠকে বসবেন তার ভারতীয় কাউন্টারপার্ট এস জয়শঙ্করের সঙ্গে।
তবে টেমপ্লেট অপরিবর্তিত থাকলেও দুই দেশের আলোচনার বিষয়বস্তু বা এজেন্ডাতে পরিবর্তন আসবে সেটাই প্রত্যাশিত। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো ইস্যু হয়তো বেশি গুরুত্ব দাবি করবে, কোনো কোনো বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রয়োজন হবে।
আগামী পাঁচ বছরে সেই প্রধান ইস্যুগুলো কী কী হতে পারে, তা জানতেই দিল্লিতে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে সাবেক কূটনীতিক, বিভিন্ন থিংকট্যাংকের বাংলাদেশ ওয়াচার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। দিল্লি-ঢাকার মধ্যকার এজেন্ডায় তাদের দৃষ্টিকোণে চারটি বিষয় যেগুলো, এই প্রতিবেদনে তা একে একে তুলে ধরা হলো। একই সঙ্গে একটি প্রশ্ন— যা ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মনে।
গঙ্গা চুক্তির নবায়ন
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মোট ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে গত বেশ কয়েক বছর ধরে যে নদীটির পেছনে দুই দেশেই সবচেয়ে বেশি নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছে, সহজবোধ্য কারণেই সেটি হল তিস্তা। কিন্তু সেই না-হওয়া তিস্তাচুক্তিকে ছাপিয়ে এখন পরবর্তী অন্তত তিন বছর যে নদীটিকে ঘিরে আলোচনা ঘুরপাক খেতে পারে, সেটি হলো গঙ্গা।
তার কারণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির কার্যকাল শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরেই। ১৯৯৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর যখন দুই দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তখন সেটির মেয়াদ ধার্য করা হয়েছিল তিরিশ বছর।বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, ১৯৯৬ সালে ভারতের এইচডি দেবেগৌড়া সরকার ও বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে যখন মূল চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তাতে কিন্তু সানন্দ সম্মতি ছিল।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর
বাংলাদেশে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে মাতারবাড়িতে গড়ে তোলা হচ্ছে সে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর বা ডিপ সি পোর্ট। বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ি মাত্র ৩৪ নটিক্যাল মাইল দূরে।
২০২৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে, অর্থাৎ আর মাত্র বছর তিনেকের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ মুহুর্তে সেখানে কাজ চলছে জোর কদমে। প্রায় দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রধানত জাপানের ঋণে ২৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই মাতারবাড়ি প্রকল্পটি গড়ে তোলা হচ্ছে।
এই মাতারবাড়ি থেকে সড়কপথে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম। সীমান্তে সাব্রুম শহরে আধুনিক ও বিশাল ‘ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট’ (আইসিপি) প্রায় তৈরি, সীমান্তের মৈত্রী সেতুও প্রস্তুত এবং সাব্রুম থেকে রাজধানী আগরতলা হয়ে বাকি ভারতের রেল সংযোগও চালু।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি এ মুহুর্তে যে একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে কথা সুবিদিত। সেই সংকটের গভীরতা কতটা, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। একদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন হু হু করে কমছে, তেমনি দেশের ভেতরে ডলারের বাজারেও চলছে হাহাকার।
এই পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তার নতুন সরকারে এমন একজনকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি আগে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের পদ সামলেছেন। সম্ভবত এ কারণেই একজন পোড়খাওয়া কূটনীতিবিদকে অর্থমন্ত্রীর ভূমিকায় আনা হয়েছে। মি চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, প্রথম কথা হলো বাংলাদেশ শ্রীলংকা নয়!
তিনি বলেন, হ্যাঁ, কোভিড মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ভারত দেখছে না।
এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম
যে জটিল সমস্যা বা কঠিন পরিস্থিতির কথা সবাই জানে, অথচ চট করে বা প্রকাশ্যে সেটা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না– সেই অবস্থাটা বোঝাতে ইংরেজিতে ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ – এই ফ্রেজ বা শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যেও এ রকমই একটা ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ আছে। এবং সেটা আর কিছুই নয় – চীন ফ্যাক্টর। তিস্তার ওপর বাংলাদেশে একটি বহুমুখী ব্যারাজ প্রকল্প নির্মাণে তাদের আগ্রহের কথা চীনা রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছিলেন প্রকাশ্যেই।
শেখ হাসিনার পর কে?
এ তালিকার পাঁচ নম্বর বা শেষ এন্ট্রি-টি এমন একটি ইস্যু, যা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে দুই দেশের মধ্যে কখনই কথাবার্তা হয় না। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রশ্নটাকে ঘিরে অনানুষ্ঠানিক ও ঘরোয়া আলোচনায় জল্পনা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
আর সেই ইস্যুটি হলো– শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হবেন কে বা কারা?
কিন্তু তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালে বা তার অবর্তমানে আওয়ামী লীগের হাল কে ধরবেন, সেটি নিয়ে শেখ হাসিনা এখনো স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত দেননি। এই বিষয়টি ভারতকে ইদানীং সামান্য অস্বস্তিতে রেখেছে। বিষয়টি যতদিন না স্পষ্ট করা হচ্ছে, ততদিন ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতরে একটা ‘অস্বস্তি’, ‘অনিশ্চয়তা’ বা ‘অধৈর্য ভাব’ কাজ করবে বলেও সাবেক ওই কূটনীতিবিদের বিশ্বাস।
সেই উত্তরাধিকারী কে হবেন তা এখনই হয়তো বলা সম্ভব নয়, কিন্তু শেখ মুজিবের পরিবারের মধ্যে থেকেই যে কেউ সেই দায়িত্ব পাবেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ভারতও সেই সম্ভাবনাটা ধরেই এগোচ্ছে এবং পরিবারের মধ্যে থেকে কেউ উত্তরাধিকারী হলে তাদের যে কোনো সমস্যা নেই, সেটিও অনেক আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে, বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
শেখ হাসিনার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম নিয়েই সবচেয়ে বেশি নাড়াচাড়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান ববি সিদ্দিককেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রায় সময়ই দেখা যায়।
ঘটনাচক্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল গত সপ্তাহেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্বাচিত আঞ্চলিক অধিকর্তার পদে তার কার্যভার গ্রহণ করেছেন। নেপালের দক্ষ ও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে এই পদে সায়মা ওয়াজেদের নির্বাচনে ভারতের একটা বড় ভূমিকা ছিল মনে করা হয়। সূত্র : বিবিসি
হককথা/নাছরিন