নিউইয়র্ক ০১:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834
সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব

ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রেখে ফুলেফেঁপে উঠছে সরকারি প্রতিষ্ঠান

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:১২:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৩২ বার পঠিত

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জ্বালানি তেল বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ কোম্পানিটি আয় করেছে ২৪৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এ বাবদ কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১৭২ কোটি টাকা। মূলত সুদহার বাড়তে থাকার প্রভাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির এ খাত থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। পদ্মা অয়েলের মতো কোম্পানিগুলোর মূল আয়ের উৎস হিসেবে ধরা হয় জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন বাবদ আয়কে। যদিও এরই মধ্যে পদ্মা অয়েলের ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ আয় জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন হিসেবে করা আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটি জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন থেকে আয় করেছে ১৬২ কোটি টাকা। আর আগের বছরে একই সময়ে এ বাবদ আয় হয়েছিল ১৩৬ কোটি টাকা। পদ্মা অয়েলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর প্রতিটিরই আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এখন ব্যাংকে জমা রাখা আমানতের সুদ।

জ্বালানি খাতের এ কোম্পানিগুলোর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন ব্যাংকে গচ্ছিত মেয়াদি আমানত থেকে সুদ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে। বর্তমান সময়ে সুদহার বাড়তে থাকায় সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে রাখা মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সুদ বাবদ আয় আরো স্ফীত হয়েছে। উচ্চ সুদের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে তদবির ও প্রভাব খাটিয়ে এসব আমানতের একাংশ রাখা হয়েছে বেশকিছু দুর্বল ব্যাংকেও, যেগুলো ফেরত পাওয়া নিয়েও রয়েছে বড় ধরনের সংশয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় সরকারি মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর মেয়াদি আমানত শ্রেণীভুক্ত হয়েছে ‘সরকারি খাতের মেয়াদি আমানত’ হিসেবে, যার পরিমাণ ৫৪ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। আর ‘অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে শ্রেণীকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন করপোরেশন, কর্তৃপক্ষ, আর্থিক মধ্যস্থতাকারী, বীমা কোম্পানি ও পেনশন ফান্ডগুলোর মোট মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৬১০ কোটি টাকায়। সরকারি আমানতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ৯৩ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা রাখা হয়েছে এক বছর থেকে দুই বছরের কম মেয়াদে। এরপর সবচেয়ে বেশি ৪২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকার আমানত রয়েছে ছয় মাসের কম মেয়াদে। ছয় মাস থেকে এক বছরের কম মেয়াদের জন্য গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এছাড়া তিন বছরের বেশি মেয়াদে ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা এবং দুই বছর থেকে তিন বছরের কম মেয়াদে ৫৫১ কোটি টাকার আমানত রাখা হয়েছে। মেয়াদি আমানতের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় ৯৯ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার বিশেষ নোটিসের আমানতও (এসএনডি) রেখেছে সরকার। এর মধ্যে সরকারি খাতের ২৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ৭৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকার এসএনডি রয়েছে। সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে পদ্মা অয়েলের এ খাত থেকে আয় বেড়েছে জানিয়ে কোম্পানিটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ফাইন্যান্স) ও কোম্পানি সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আলী আবছার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের তিন মাস মেয়াদি আমানত বেশি। এছাড়া এক বছর ও তিন বছর মেয়াদি কিছু আমানত রয়েছে। গত এক বছরে এসএনডি ও এফডিআর দুই ক্ষেত্রেই সুদের হার ১ থেকে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে বেড়েছে, যার ফলে সুদ বাবদ আমাদের আয়ও বেড়ে গেছে। এর বাইরে কমিশন বাড়ার কারণে পরিচালন খাতে কিছু আয় বেড়েছে।’

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার (রেপো রেট)। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন মুদ্রানীতিতেও সুদহার আরো বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আভাস দেয়া হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত বেসরকারি খাতের বেশকিছু দুর্বল ব্যাংকে রাখা হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৮৭৪ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকের কাছ থেকে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ আমানতের বিপরীতে সুদও পাচ্ছে সরকার। এ রকম আরো বেশকিছু দুর্বল ব্যাংকে রাখা সরকারি আমানত আটকে আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি উচ্চ সুদের সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড ক্রয় ও ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে বেশি সুদ আদায় করে ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোও রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পরিচালন উদ্বৃত্ত কিংবা নগদ প্রবাহে উদ্বৃত্ত থাকলে সেটি হয় কোনো স্থায়ী সম্পদে বা আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ করবে। আর্থিক সম্পদের ক্ষেত্রে একদিকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে হয়, অন্যদিকে রিটার্নের দিকটিও দেখতে হয়। সুদহার বাড়ার কারণে আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন বেড়েছে। এটি শুধু করপোরেট খাতেই হয়েছে তা নয়, ব্যাংকের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি। অর্থনীতিতে এখনো অনিশ্চয়তা না কাটার কারণে ঝুঁকি নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনীহা দেখা যাচ্ছে। এর পরিবর্তে নিরাপদ হিসেবে উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে আমানত রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ার কারণে বিনিয়োগে যে প্রাণ নেই, এটি সেই বার্তাই দিচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে যে এ আমানত কতটুকু নিরাপদ রয়েছে? এসব আমানত যদি পদ্মা ব্যাংকের মতো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোয় রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেগুলো কতটুকু ফেরত পাওয়া যাবে; সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব খাটিয়ে দুর্বল ব্যাংকে সরকারি আমানত রাখা হয়েছিল। অর্থনীতির শ্বেতপত্রে আমরা ১০টি দুর্বল ব্যাংকের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এসব ব্যাংকে রাখা আমানত উদ্ধার করা যাবে কিনা, সেটি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নেয়ার পর সে অর্থের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এমন ঘটনাও আমরা দেখেছি।’

নগদ টাকার (তারল্য) সংকট ও নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ২০২৩ সালের জুন থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৬ শতাংশে ঠেকেছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পায়নি। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখন মূল্যস্ফীতির হার আরো লাগামহীন হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাইয়ে এ হার বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকে। আগস্টেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এরপর সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দেখানো হলেও অক্টোবরে বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে উঠে যায়। আর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩৮ ও ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে এলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা কোনো কাজেই আসেনি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সুদ বাবদ আয় বাড়ানোর দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আমাদের কাছে মেয়াদি আমানতের জন্য ১২ শতাংশ সুদ চাচ্ছে। দুর্বল ও ছোট ব্যাংকগুলো এর চেয়েও বেশি সুদ দেয়ার প্রস্তাব করছে। আমরা যদি ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ১৪-১৫ শতাংশ সুদের নিচে বিনিয়োগ করা কঠিন। এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন না। বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো দরকষাকষি করে ঋণের সুদহার কমাতে পারছেন। কিন্তু এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১৫-১৬ শতাংশ সুদের নিচে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।’

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় থাকা আমানতের পরিমাণ বেশ বড়। এ কারণে তারা সুদহার নিয়ে দরকষাকষি করার সুযোগ বেশি পান। উচ্চ সুদের এ বাজারে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হলেও দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ সূত্র : বণিক বার্তা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব

ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রেখে ফুলেফেঁপে উঠছে সরকারি প্রতিষ্ঠান

প্রকাশের সময় : ১২:১২:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জ্বালানি তেল বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ কোম্পানিটি আয় করেছে ২৪৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এ বাবদ কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১৭২ কোটি টাকা। মূলত সুদহার বাড়তে থাকার প্রভাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির এ খাত থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। পদ্মা অয়েলের মতো কোম্পানিগুলোর মূল আয়ের উৎস হিসেবে ধরা হয় জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন বাবদ আয়কে। যদিও এরই মধ্যে পদ্মা অয়েলের ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ আয় জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন হিসেবে করা আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটি জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন থেকে আয় করেছে ১৬২ কোটি টাকা। আর আগের বছরে একই সময়ে এ বাবদ আয় হয়েছিল ১৩৬ কোটি টাকা। পদ্মা অয়েলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর প্রতিটিরই আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এখন ব্যাংকে জমা রাখা আমানতের সুদ।

জ্বালানি খাতের এ কোম্পানিগুলোর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন ব্যাংকে গচ্ছিত মেয়াদি আমানত থেকে সুদ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে। বর্তমান সময়ে সুদহার বাড়তে থাকায় সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে রাখা মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সুদ বাবদ আয় আরো স্ফীত হয়েছে। উচ্চ সুদের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে তদবির ও প্রভাব খাটিয়ে এসব আমানতের একাংশ রাখা হয়েছে বেশকিছু দুর্বল ব্যাংকেও, যেগুলো ফেরত পাওয়া নিয়েও রয়েছে বড় ধরনের সংশয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় সরকারি মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর মেয়াদি আমানত শ্রেণীভুক্ত হয়েছে ‘সরকারি খাতের মেয়াদি আমানত’ হিসেবে, যার পরিমাণ ৫৪ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। আর ‘অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে শ্রেণীকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন করপোরেশন, কর্তৃপক্ষ, আর্থিক মধ্যস্থতাকারী, বীমা কোম্পানি ও পেনশন ফান্ডগুলোর মোট মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৬১০ কোটি টাকায়। সরকারি আমানতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ৯৩ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা রাখা হয়েছে এক বছর থেকে দুই বছরের কম মেয়াদে। এরপর সবচেয়ে বেশি ৪২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকার আমানত রয়েছে ছয় মাসের কম মেয়াদে। ছয় মাস থেকে এক বছরের কম মেয়াদের জন্য গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এছাড়া তিন বছরের বেশি মেয়াদে ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা এবং দুই বছর থেকে তিন বছরের কম মেয়াদে ৫৫১ কোটি টাকার আমানত রাখা হয়েছে। মেয়াদি আমানতের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় ৯৯ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার বিশেষ নোটিসের আমানতও (এসএনডি) রেখেছে সরকার। এর মধ্যে সরকারি খাতের ২৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ৭৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকার এসএনডি রয়েছে। সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে পদ্মা অয়েলের এ খাত থেকে আয় বেড়েছে জানিয়ে কোম্পানিটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ফাইন্যান্স) ও কোম্পানি সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আলী আবছার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের তিন মাস মেয়াদি আমানত বেশি। এছাড়া এক বছর ও তিন বছর মেয়াদি কিছু আমানত রয়েছে। গত এক বছরে এসএনডি ও এফডিআর দুই ক্ষেত্রেই সুদের হার ১ থেকে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে বেড়েছে, যার ফলে সুদ বাবদ আমাদের আয়ও বেড়ে গেছে। এর বাইরে কমিশন বাড়ার কারণে পরিচালন খাতে কিছু আয় বেড়েছে।’

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাড়ানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার (রেপো রেট)। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন মুদ্রানীতিতেও সুদহার আরো বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আভাস দেয়া হয়েছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত বেসরকারি খাতের বেশকিছু দুর্বল ব্যাংকে রাখা হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৮৭৪ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকের কাছ থেকে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ আমানতের বিপরীতে সুদও পাচ্ছে সরকার। এ রকম আরো বেশকিছু দুর্বল ব্যাংকে রাখা সরকারি আমানত আটকে আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি উচ্চ সুদের সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড ক্রয় ও ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে বেশি সুদ আদায় করে ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোও রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পরিচালন উদ্বৃত্ত কিংবা নগদ প্রবাহে উদ্বৃত্ত থাকলে সেটি হয় কোনো স্থায়ী সম্পদে বা আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ করবে। আর্থিক সম্পদের ক্ষেত্রে একদিকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে হয়, অন্যদিকে রিটার্নের দিকটিও দেখতে হয়। সুদহার বাড়ার কারণে আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন বেড়েছে। এটি শুধু করপোরেট খাতেই হয়েছে তা নয়, ব্যাংকের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি। অর্থনীতিতে এখনো অনিশ্চয়তা না কাটার কারণে ঝুঁকি নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনীহা দেখা যাচ্ছে। এর পরিবর্তে নিরাপদ হিসেবে উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে আমানত রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ার কারণে বিনিয়োগে যে প্রাণ নেই, এটি সেই বার্তাই দিচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে যে এ আমানত কতটুকু নিরাপদ রয়েছে? এসব আমানত যদি পদ্মা ব্যাংকের মতো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোয় রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেগুলো কতটুকু ফেরত পাওয়া যাবে; সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব খাটিয়ে দুর্বল ব্যাংকে সরকারি আমানত রাখা হয়েছিল। অর্থনীতির শ্বেতপত্রে আমরা ১০টি দুর্বল ব্যাংকের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এসব ব্যাংকে রাখা আমানত উদ্ধার করা যাবে কিনা, সেটি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নেয়ার পর সে অর্থের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এমন ঘটনাও আমরা দেখেছি।’

নগদ টাকার (তারল্য) সংকট ও নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ২০২৩ সালের জুন থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ থেকে বেড়ে এখন প্রায় ১৬ শতাংশে ঠেকেছে। যদিও সুদহার বৃদ্ধির কোনো সুফল জনগণ পায়নি। বরং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি যখন সর্বনিম্ন, তখন মূল্যস্ফীতির হার আরো লাগামহীন হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাইয়ে এ হার বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ঠেকে। আগস্টেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এরপর সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দেখানো হলেও অক্টোবরে বেড়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে উঠে যায়। আর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩৮ ও ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে এলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা কোনো কাজেই আসেনি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সুদ বাবদ আয় বাড়ানোর দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আমাদের কাছে মেয়াদি আমানতের জন্য ১২ শতাংশ সুদ চাচ্ছে। দুর্বল ও ছোট ব্যাংকগুলো এর চেয়েও বেশি সুদ দেয়ার প্রস্তাব করছে। আমরা যদি ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ১৪-১৫ শতাংশ সুদের নিচে বিনিয়োগ করা কঠিন। এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন না। বড় ব্যবসায়ীরা হয়তো দরকষাকষি করে ঋণের সুদহার কমাতে পারছেন। কিন্তু এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১৫-১৬ শতাংশ সুদের নিচে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।’

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় থাকা আমানতের পরিমাণ বেশ বড়। এ কারণে তারা সুদহার নিয়ে দরকষাকষি করার সুযোগ বেশি পান। উচ্চ সুদের এ বাজারে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হলেও দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ সূত্র : বণিক বার্তা।