ধর্ষণের বিচারে ধীরগতি
- প্রকাশের সময় : ০৩:৩০:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৫০ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে এসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর হাতে গণধর্ষণের শিকার হন তাঁর স্ত্রী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে থেকে নবদম্পতিকে তারা জোর করে গাড়িতে তুলে ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যায়। পরে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষেই ধর্ষণ করে তারা।
বহুল আলোচিত এ ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে তখনই সিলেটের তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ১৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আসামিদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ‘কলেজের অধ্যক্ষ ঘটনায় দায় এড়াতে পারেন না’ বলেও উল্লেখ করে ওই কমিটি। এ ঘটনায় ধর্ষণের পাশাপাশি চাঁদাবাজির পৃথক মামলা হলেও গত তিন বছরে একটি মামলায়ও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। মামলার আট আসামি বর্তমানে কারাগারে। এরই মধ্যে গত রোববার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে স্বামীকে বেঁধে রেখে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে এলে তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকারকর্মীরা। প্রশ্ন উঠেছে ধর্ষণ মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়েও।
ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ সমকালকে বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হল এলাকায় ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি ক্ষমতার দম্ভের বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিকভাবে পুনঃক্ষমতায়ন এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। এর সঙ্গে যদি আরও কারণ খুঁজতে যাই তাহলে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক ও আর্থিক শক্তির বিষয়টি সামনে আসবে।
দেশে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। এর চার বছর পরও ধর্ষণের ঘটনা কমেনি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিচারের ধীরগতির কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার জট কেবল বাড়ছেই। আর এ সুযোগে অধিকাংশ আসামি মামলার বিভিন্ন প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে মুক্ত হয়ে ঘুরছে। এ আসামিদের অনেকে প্রভাবশালী হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বাদীকে হুমকি বা অর্থের প্রলোভন দিয়ে নাজেহাল করছে। অনেকে সাক্ষ্য-প্রমাণের ঘাটতি মেনে নিয়ে মামলা থেকেও আপসে বাধ্য হচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের নিম্ন আদালতে বর্তমানে ১ লাখ ৫৮ হাজার ২৪৮টি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৩৬ হাজার ২২২টি মামলা পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে আদালতে পড়ে থাকলেও নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত থাকা মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১ হাজার ৫৩১টি। এর বাইরে শিশু আদালতে বিচারাধীন রয়েছে আরও ৩৯ হাজার ৩৫৮টি মামলা। সব মিলিয়ে দেশে এ মুহূর্তে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু আদালতে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬০৬টি মামলা বিচারাধীন।
ধর্ষণের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের প্রতিবেদনে আলাদা তালিকা থাকলেও পুলিশ সদরদপ্তরের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে থানায় ২৭ হাজার ৪৭৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৫৯ হাজার ৯৬০টি। এর মধ্যে ২০২২ সালে সারাদেশে ৪ হাজার ৭৬২টি ধর্ষণের মামলা করা হয়। একই বছর নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৯ হাজার ৭৬৮টি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই পাঁচ বছরে রাজধানীতে ৩ হাজার ৪২টি ধর্ষণের মামলা করা হয়। যার মধ্যে নারী ২ হাজার ৪৭০ জন এবং শিশু ৫৭২ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৫২৩টি। এর মধ্যে নারী ৪৩০ এবং শিশু ৯৩ জন। অথচ ওই পাঁচ বছরে ঢাকা মহানগরীতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা শুধু ২৪ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত বছর সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন নারী। হত্যা করা হয়েছে ৪৮ জনকে এবং আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। পুলিশ সদরদপ্তর এবং আসকের তথ্যানুযায়ী গত ৬ বছরে ২৮ হাজার ৪১৫টি ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
নারীপক্ষের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলায় ৯৮ দশমিক ৬৪ ভাগ আসামিই খালাস পেয়েছে। সাজা হয় মাত্র ১ দশমিক ৩৬ ভাগ আসামির। বাদী এবং আসামিপক্ষের আপস মীমাংসা, বিচারের ধীরগতি, তদন্তে গাফিলতি, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, সাক্ষীর আদালতে হাজির না হওয়া, যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকাসহ নানা কারণে এসব মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকার দুটি এবং জামালপুর, ঝিনাইদহ, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাটের নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের ৬০টি মামলা পর্যালোচনা করে বিশ্লেষণমূলক এ প্রতিবেদন তৈরি করে সংগঠনটি।
ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, মামলার বিচারের ধীরগতির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ তাদের দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করে না। কারণ সাক্ষী ও আসামি হাজির করার দায়িত্ব তাদেরই। তাই অবশ্যই আইনের আওতায় মামলা-সংশ্লিষ্ট পুলিশের দায়িত্বে গাফিলতির জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে বিচারে গতি আসার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা পরিবারগুলোর ন্যায়বিচারও দ্রুত নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
মানবাধিকার সংগঠন আসকের চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, সরকারের প্রশাসনযন্ত্র চাইলেই ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। সরকারের সেই সদিচ্ছা আছে কিনা সেটা ঘটনা প্রবাহ থেকে শুরু করে বিচার পর্যন্ত পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। রাষ্ট্রপক্ষ যদি ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে উদ্যোগী হতো তাহলে অবশ্যই এর সুফল আসত।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, যে ঘটনা সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং স্পর্শকাতর বিষয় জড়িত– এমন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা হবে– এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সূত্র : সমকাল
হককথা/নাছরিন