ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন
লন্ডনের ফ্ল্যাট নিয়ে দুই বছর আগে মিথ্যা বলেছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক

- প্রকাশের সময় : ১১:২৩:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৬০ বার পঠিত
দুই বছর আগে শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের ৭ লাখ পাউন্ড (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকারও বেশি অর্থের সমপরিমাণ) মূল্যের লন্ডনের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সে সময় অভিযোগ উঠেছিল, ফ্ল্যাটটি তার খালা ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক আবাসন ব্যবসায়ী তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। সে সময় লন্ডনভিত্তিক ডেইলি মেইলের রোববারের ট্যাবলয়েড মেইল অন সানডের (এমওএস) পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গে তাকে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন তিনি। তার দাবি ছিল, ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা তাকে কিনে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে মেইল অন সানডের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকিও দিয়েছিলেন।
ডেইলি মেইলের গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপের দল লেবার পার্টিসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে নিশ্চিত করেছে, কিংস ক্রস এলাকায় অবস্থিত ফ্ল্যাটটি আসলেই ওই আবাসন ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে ‘কৃতজ্ঞতার প্রতীক’ হিসেবে তাকে উপহার দেয়া হয়েছিল। টিউলিপ সিদ্দিক ওই প্রপার্টি ২০১৩ সাল থেকে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। সে সময় উত্তর লন্ডনের ক্যামডেনে লেবার পার্টির কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এ বাবদ আয় প্রসঙ্গে প্রথম ঘোষণা দেন। পার্লামেন্টারি রেকর্ড অনুযায়ী, ওই প্রপার্টি থেকে তিনি ভাড়া বাবদ ১০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৫ লাখ টাকার বেশি) আয় করেন। ২০১৮ সালে ৯৫ হাজার পাউন্ডে এটির লিজ নবায়ন করেছিলেন তিনি।
কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটি নিয়ে বিতর্ককে নতুন করে সামনে আনে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটিতে শনিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, টিউলিপের বাবা-মা তাদের পরিচিত আবদুল মোতালিফ (৭০) নামের এক ব্যবসায়ীকে তার এক কঠিন সময়ে সহযোগিতা করেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে নিজ মালিকানাধীন ফ্ল্যাটটি টিউলিপকে দিয়ে দেন আবদুল মোতালিফ।
এফটিকে আবদুল মোতালিফ নিশ্চিত করেছেন, তিনি কিংস ক্রসের সম্পত্তিটি কিনেছিলেন। তবে ফ্ল্যাটটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। বর্তমানে আবদুল মোতালিফ দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনে বসবাস করেন। ভোটার নিবন্ধনসংশ্লিষ্ট নথি থেকে জানা গেছে, ওই এলাকায় আবদুল মোতালিফের ঠিকানায় এখন মজিবুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি বসবাস করছেন। মজিবুলের বাবা ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।
এফটি এ কথা প্রকাশের পর পরই লেবারসংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করে, তারা বিষয়টি নিয়ে দুই বছর আগে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেনি। যদিও এটি সামনে আসার পর টিউলিপের পদত্যাগের দাবিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঝড় তুলতে শুরু করেন বিরোধী রক্ষণশীল এমপিরা। টিউলিপ সিদ্দিক এখন যুক্তরাজ্যের ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য সেক্রেটারি ও সিটি মিনিস্টার পদে নিয়োজিত আছেন। প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদার এ পদে নিয়োজিতদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো ব্রিটিশ আর্থিক খাতের দুর্নীতিকে নির্মূল করা। যদিও বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে এক ঘুস কেলেঙ্কারির অভিযোগে পরিবারের চার সদস্যসহ তিনি নিজেই তদন্তের মুখে রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই পদত্যাগের জন্য চাপের মুখে ছিলেন তিনি। আর এফটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে এ চাপ আরো বেড়ে চলেছে। স্থানীয় সময় অনুযায়ী শনিবার রাত থেকে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবিতে ঝড় তুলছেন ব্রিটিশ বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরা। তাদের দাবি, টিউলিপ যদি বিষয়টি ব্যাখ্যা না করেন, তবে তার পক্ষে বর্তমান পদ ধরে রাখা অসম্ভব।
হ্যারো ইস্টের টোরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তিসংক্রান্ত বিষয় পরিষ্কার করতে হবে, প্রথমে কী বলেছিলেন এবং কেন বলেছিলেন তা ব্যাখ্যা করতে হবে। যদি তিনি তা না করেন, তাহলে তার মন্ত্রী হিসেবে থাকা অসম্ভব।’ শ্যাডো হোম অফিসমন্ত্রী ম্যাট ভিকার্স বলেন, ‘সরকারের যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়, বিশেষ করে যখন তিনি কিয়ার স্টারমারের (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) অধীনে দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।’
হান্টিংডনের টোরি এমপি বেন ওবেস-জেকটি বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে এ নতুন তথ্য উদ্বেগজনক। এখন যেহেতু এটি প্রমাণ হয়েছে যে ফ্ল্যাটটি তাকে উপহার দেয়া হয়েছিল এবং তিনি এটি কিনেছেন বলে আগের দাবি মিথ্যা, তাই তাকে আরো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’
এফটির প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই লেবার পার্টিসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মেইল অন সানডের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, তারা বিষয়টি নিয়ে অতীতে ‘ইচ্ছাকৃত কোনো বিভ্রান্তি’ তৈরি করেনি। যখন তারা বিষয়টি নিয়ে জানতে চেয়েছিল, সে সময় টিউলিপ সিদ্দিককে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ফ্ল্যাটটি একটি হাউজ সেল থেকে কেনা হয়েছিল। যদিও এখন বিষয়টি নিয়ে তার পরিবারের ভাষ্য বদলে গেছে। টিউলিপ সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, ‘টিউলিপ যে পদ্ধতিতে ফ্ল্যাটের মালিকানা পেয়েছেন সে সম্পর্কে তার আগের ধারণা বদলে গেছে। তিনি ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে আগে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা সাংবাদিককে জানিয়েছেন।’
লন্ডনের ভূমি রেজিস্ট্রির রেকর্ড থেকে জানা যায়, টিউলিপ সিদ্দিক ২০০৪ সালের নভেম্বরে ফ্ল্যাটটির একক মালিক হন। তখন তিনি কিংস কলেজ লন্ডন থেকে এমএ শেষ করেন এবং তার কোনো উল্লেখযোগ্য আয় ছিল না। সম্পত্তিটির কোনো বন্ধকি সম্পত্তি ছিল না এবং কোনো মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় এটি কেনা হয়নি বরং হস্তান্তর হয়েছে। ফ্ল্যাটটির আগের মালিক আবদুল মোতালিফ ২০০১ সালে এটি ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে কিনেছিলেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ পাউন্ডে। ২০২২ সালের এপ্রিলে ফ্ল্যাটটি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে মেইল অন সানডে। সে সময় লেবার পার্টির পক্ষ থেকে এক ই-মেইলে জানানো হয়, ‘২০ বছর আগে টিউলিপের বাবা-মা যখন আলাদা হন, তারা তাদের পারিবারিক বাড়ি বিক্রি করে কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন। অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থ আসার যেকোনো ইঙ্গিত সম্পূর্ণ ভুল এবং মানহানিকর।’
ডেইলি মেইলের দাবি, সংবাদমাধ্যমটির পক্ষ থেকে টিউলিপের পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর করে দেখা হয়েছে। তবে ২০০২ সালের কাছাকাছি সময় তাদের এমন কোনো বাড়ি বিক্রির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালের জুলাইয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও লেবার পার্টিকে এ বিষয়ে আরো প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু জবাবে টিউলিপ তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দেন।
তার সংসদীয় অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো একটি ই-মেইলে বলা হয়, অভিযোগগুলো ভুল এবং অত্যন্ত মানহানিকর। এগুলো নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে টিউলিপ আইনি ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবেন না। আর তার বাবা-মা তাদের পারিবারিক বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন—এমন দাবির ফলে বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি বলে দাবি ডেইলি মেইলের।
ফ্ল্যাট উপহারের বিষয়টি এমন এক সময়ে উঠে এল যখন টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি তদন্ত শুরু করেছে। এ বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিককে ব্রিটিশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারাও জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ও তার পরিবারের চার সদস্য রাশিয়া সমর্থিত একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প থেকে কমিশন বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সূত্র : বণিক বার্তা।