নিউইয়র্ক ০৬:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

তছনছ স্থানীয় সরকারে আ’লীগের সাম্রাজ্য

হককথা ডেস্ক
  • প্রকাশের সময় : ০২:১০:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৫৬ বার পঠিত

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবার স্থানীয় সরকারের আওয়ামী লীগের সাজানো সাম্রাজ্যও তছনছ হয়ে গেছে। গতকাল সোমবার প্রায় সব পর্যায়ের শীর্ষ ১ হাজার ৮৭৭ জনপ্রতিনিধিকে একযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এ ঘটনা নজিরবিহীন। দ্রুততার সঙ্গে আইন সংশোধন করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মেয়ররা বাদ পড়লেও পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং জেলা পরিষদের সদস্যরা যথারীতি দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এরই মধ্যে স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বরখাস্ত করে বসানো হয়েছে প্রশাসক। পৌরসভা, উপজেলা পরিষদে নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা পরিষদে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একমাত্র জেলা পরিষদ ছাড়া বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। অবশ্য যেসব নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়েছিলেন, সেসব ভোটের স্বচ্ছতা ও ভোটার অংশগ্রহণ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

এসব জনপ্রতিনিধির হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতা ও অনুসারী। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিটি করপোরেশনগুলোর বেশির ভাগের মেয়াদ আগামী ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে শেষ হবে। পৌরসভার মেয়াদও আগামী বছরের প্রথমার্ধে শেষ হওয়ার কথা ছিল। শুধু ৪৯৪ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন কয়েক মাস আগে শেষ হয়।

একের পর এক অপসারণ
গতকাল সোমবার আলাদা আদেশে ৪৯৪ উপজেলা পরিষদের ১ হাজার ৪৮২ জন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান; ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়। একই সঙ্গে বিভাগীয় পর্যায়ের জেলা পরিষদে বিভাগীয় কমিশনার, বাকিগুলোতে ডিসিদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ আদেশ জারির কিছু সময় পর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর আলাদা আদেশে এসব সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। দু’দিন আগেই আরেক আদেশে পলাতক মেয়র, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিজনিত কারণ উল্লেখ করে ওই সব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। গতকাল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট প্যানেল চেয়ারম্যানকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে পরিপত্র জারি করা হয়েছে।

বরখাস্তের জন্যই আইন সংশোধন
জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করতেই ১৭ আগস্ট একটি অধ্যাদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইনের অধ্যাদেশের খসড়া সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার, অত্যাবশ্যক বিবেচনা করিলে জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলার মেয়র, কাউন্সিলর এবং চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া নিশ্চিত করতে তাদের স্থলে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে প্ৰশাসনিক কার্যক্রম চলমান রাখা ও জরুরি কারণে, সময়ের প্রয়োজনে, জনস্বার্থে প্রশাসক নিয়োগ করা যাবে।’ ওই দিনই ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়।

তবে এতদিন স্থানীয় সরকার উপজেলা পরিষদ আইনে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ সম্পর্কে বলা ছিল, ‘যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া যদি পরিষদের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; পরিষদ বা রাষ্ট্রের স্বার্থের হানিকর কোনো কার্যকলাপে যদি জড়িত থাকেন; অথবা যদি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হন; অসদাচরণ, দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে অথবা পরিষদের কোনো অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন বা আত্মসাতের বা অপপ্রয়োগের জন্য দায়ী হলে; দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে যদি অক্ষম হন, তাহলে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে অপসারণ করতে পারে। তবে শর্ত থাকে, অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করিবার আগে বিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে তদন্ত করতে ও অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।’ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাতেও একই বিধান।

এ ব্যাপারে মাগুরা সদর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রানা আমীর ওসমান বলেন, ভোট নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। তবে গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল। বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররাও কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। নির্দলীয় একটি প্রতীকে ভোট হয়েছে। আমার উপজেলায় ৩ লাখ ২৪ হাজার ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার জন ভোট দিয়েছেন। প্রায় ১ লাখ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছি। গত ৫ জুন দায়িত্ব নেওয়ার পর এক দিনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকিনি। অথচ একটা চিঠির মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমি আর উপজেলা পরিষদের কেউ না। আমার অপরাধটা কোথায়? মানুষের কাছে আমাদের ওয়াদা ছিল। তাদেরও প্রত্যাশা ছিল। সে প্রশ্নের জবাব এখন কে দেবে?

উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশীদ হাওলাদার বলেন, কোনো জনপ্রতিনিধি যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই পরিষদের পরপর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে, রাষ্ট্রের স্বার্থ হানিকর কোনো কার্যকলাপে জড়িত থাকলে বিদ্যমান আইনেই সরকার তাদের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপসারণের বিধান আছে। তবে এটা করা হয়েছে ঢালাওভাবে প্রশাসক নিয়োগের লক্ষ্যে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মানুষের ধারণা নির্বাচনগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই ভোটার উপস্থিতি ছিলেন না। প্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। কিছু জায়গায় ভালো নির্বাচন হলেও সেগুলো বেছে নেওয়া দুরূহ। কিছু কিছু জায়গায় সুবিচার হয়তো হয়নি। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই এটা করা হয়েছে। অচিরেই হয়তো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হবেন।

কাউন্সিলর-ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যরা থাকছেন
গত ৮ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর ১১ আগস্ট থেকে অফিস শুরু করেন উপদেষ্টারা। স্থানীয় সরকার বিভাগের সব বৈঠকের মূল এজেন্ডাই ছিল জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ। তবে ওইসব বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের অব্যাহতি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের অব্যাহতি দিলে স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের সেবা বিঘ্নিত হতে পারে। কারণ তারা সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবশ্য এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, এখন একটা ভিন্ন পরস্থিতির মধ্যে আমরা আছি। এ প্রেক্ষাপটে সরকার মনে করলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রশাসক বসাতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৫০ জন সরকারি কর্মকর্তা থাকেন। তাদের মধ্য থেকে কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে পারে। তবে সেটা হয়তো হবে না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও পৌরসভা-সিটি করপোরেশেনর কাউন্সিলররা বহাল থাকবেন। কারণ তারা সরাসরি জনগণের সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ভোটে স্বচ্ছতার ঘাটতিতে এ বেহাল অবস্থা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দখলে ছিল। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টির মেয়র চলে যান আত্মগোপনে। অনেক কাউন্সিলরও পলাতক। জেলা পরিষদের বেশির ভাগ চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। ৪৯৪ উপজেলা পরিষদের তিন শতাধিক চেয়ারম্যান গা-ঢাকা দিয়েছেন। ৩২৩ পৌরসভার মধ্যে দুই শতাধিক মেয়রও দপ্তরে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়। আবার এসব জনপ্রতিনিধি যেভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী থাকলেও সরকারি দলের প্রার্থী ছাড়া অন্যরা ছিলেন ব্যাপক পীড়নে। পৌরসভা নির্বাচনেও ছিল একই অবস্থা। সাম্প্রতিক উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় হলেও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করে। যারা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে অংশ নেন, তারাও ছিলেন সরকারি দলের রোষানলে।

কারা পেলেন সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মহশের আলী, ঢাকা উত্তর সিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুল হাসান, নারায়ণগঞ্জ সিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং কুমিল্লা সিটিতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্য সিটি করপোরেশনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কমিশনারদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার ভাষ্য
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হলেও কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রশাসক থাকলে কাউন্সিলররা দায়িত্ব পালন করবেন কি করবেন না, সেটা এখন তাদের ব্যাপার। মূল কথা হচ্ছে, মেয়র ও চেয়ারম্যানের জায়গায় প্রশাসক দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করব। এখানে মারমার কাটকাটের কোনো বিষয় নেই। এটি স্থানীয় সরকারকে পরিচ্ছন্ন করার একটি প্রচেষ্টা।সূত্র: সমকাল।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

তছনছ স্থানীয় সরকারে আ’লীগের সাম্রাজ্য

প্রকাশের সময় : ০২:১০:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবার স্থানীয় সরকারের আওয়ামী লীগের সাজানো সাম্রাজ্যও তছনছ হয়ে গেছে। গতকাল সোমবার প্রায় সব পর্যায়ের শীর্ষ ১ হাজার ৮৭৭ জনপ্রতিনিধিকে একযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এ ঘটনা নজিরবিহীন। দ্রুততার সঙ্গে আইন সংশোধন করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মেয়ররা বাদ পড়লেও পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং জেলা পরিষদের সদস্যরা যথারীতি দায়িত্ব পালন করে যাবেন। এরই মধ্যে স্থানীয় সরকারের শীর্ষ পদগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বরখাস্ত করে বসানো হয়েছে প্রশাসক। পৌরসভা, উপজেলা পরিষদে নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা পরিষদে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একমাত্র জেলা পরিষদ ছাড়া বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। অবশ্য যেসব নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়েছিলেন, সেসব ভোটের স্বচ্ছতা ও ভোটার অংশগ্রহণ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

এসব জনপ্রতিনিধির হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতা ও অনুসারী। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিটি করপোরেশনগুলোর বেশির ভাগের মেয়াদ আগামী ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে শেষ হবে। পৌরসভার মেয়াদও আগামী বছরের প্রথমার্ধে শেষ হওয়ার কথা ছিল। শুধু ৪৯৪ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন কয়েক মাস আগে শেষ হয়।

একের পর এক অপসারণ
গতকাল সোমবার আলাদা আদেশে ৪৯৪ উপজেলা পরিষদের ১ হাজার ৪৮২ জন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান; ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ৩২৩ পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়। একই সঙ্গে বিভাগীয় পর্যায়ের জেলা পরিষদে বিভাগীয় কমিশনার, বাকিগুলোতে ডিসিদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ আদেশ জারির কিছু সময় পর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর আলাদা আদেশে এসব সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। দু’দিন আগেই আরেক আদেশে পলাতক মেয়র, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিজনিত কারণ উল্লেখ করে ওই সব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। গতকাল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট প্যানেল চেয়ারম্যানকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে পরিপত্র জারি করা হয়েছে।

বরখাস্তের জন্যই আইন সংশোধন
জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করতেই ১৭ আগস্ট একটি অধ্যাদেশ জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইনের অধ্যাদেশের খসড়া সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার, অত্যাবশ্যক বিবেচনা করিলে জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলার মেয়র, কাউন্সিলর এবং চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া নিশ্চিত করতে তাদের স্থলে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে প্ৰশাসনিক কার্যক্রম চলমান রাখা ও জরুরি কারণে, সময়ের প্রয়োজনে, জনস্বার্থে প্রশাসক নিয়োগ করা যাবে।’ ওই দিনই ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়।

তবে এতদিন স্থানীয় সরকার উপজেলা পরিষদ আইনে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ সম্পর্কে বলা ছিল, ‘যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া যদি পরিষদের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; পরিষদ বা রাষ্ট্রের স্বার্থের হানিকর কোনো কার্যকলাপে যদি জড়িত থাকেন; অথবা যদি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হন; অসদাচরণ, দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে অথবা পরিষদের কোনো অর্থ বা সম্পত্তির ক্ষতিসাধন বা আত্মসাতের বা অপপ্রয়োগের জন্য দায়ী হলে; দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে যদি অক্ষম হন, তাহলে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে অপসারণ করতে পারে। তবে শর্ত থাকে, অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করিবার আগে বিধি নির্ধারিত পদ্ধতিতে তদন্ত করতে ও অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।’ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাতেও একই বিধান।

এ ব্যাপারে মাগুরা সদর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রানা আমীর ওসমান বলেন, ভোট নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। তবে গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের যথেষ্ট উপস্থিতি ছিল। বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররাও কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। নির্দলীয় একটি প্রতীকে ভোট হয়েছে। আমার উপজেলায় ৩ লাখ ২৪ হাজার ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার জন ভোট দিয়েছেন। প্রায় ১ লাখ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছি। গত ৫ জুন দায়িত্ব নেওয়ার পর এক দিনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকিনি। অথচ একটা চিঠির মাধ্যমে জানতে পারলাম, আমি আর উপজেলা পরিষদের কেউ না। আমার অপরাধটা কোথায়? মানুষের কাছে আমাদের ওয়াদা ছিল। তাদেরও প্রত্যাশা ছিল। সে প্রশ্নের জবাব এখন কে দেবে?

উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশীদ হাওলাদার বলেন, কোনো জনপ্রতিনিধি যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই পরিষদের পরপর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে, রাষ্ট্রের স্বার্থ হানিকর কোনো কার্যকলাপে জড়িত থাকলে বিদ্যমান আইনেই সরকার তাদের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপসারণের বিধান আছে। তবে এটা করা হয়েছে ঢালাওভাবে প্রশাসক নিয়োগের লক্ষ্যে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মানুষের ধারণা নির্বাচনগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই ভোটার উপস্থিতি ছিলেন না। প্রশাসন নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। কিছু জায়গায় ভালো নির্বাচন হলেও সেগুলো বেছে নেওয়া দুরূহ। কিছু কিছু জায়গায় সুবিচার হয়তো হয়নি। আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই এটা করা হয়েছে। অচিরেই হয়তো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হবেন।

কাউন্সিলর-ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যরা থাকছেন
গত ৮ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর ১১ আগস্ট থেকে অফিস শুরু করেন উপদেষ্টারা। স্থানীয় সরকার বিভাগের সব বৈঠকের মূল এজেন্ডাই ছিল জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ। তবে ওইসব বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের অব্যাহতি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের অব্যাহতি দিলে স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের সেবা বিঘ্নিত হতে পারে। কারণ তারা সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবশ্য এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, এখন একটা ভিন্ন পরস্থিতির মধ্যে আমরা আছি। এ প্রেক্ষাপটে সরকার মনে করলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রশাসক বসাতে পারে। উপজেলা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৫০ জন সরকারি কর্মকর্তা থাকেন। তাদের মধ্য থেকে কাউকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে পারে। তবে সেটা হয়তো হবে না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও পৌরসভা-সিটি করপোরেশেনর কাউন্সিলররা বহাল থাকবেন। কারণ তারা সরাসরি জনগণের সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ভোটে স্বচ্ছতার ঘাটতিতে এ বেহাল অবস্থা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দখলে ছিল। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টির মেয়র চলে যান আত্মগোপনে। অনেক কাউন্সিলরও পলাতক। জেলা পরিষদের বেশির ভাগ চেয়ারম্যান আত্মগোপনে। ৪৯৪ উপজেলা পরিষদের তিন শতাধিক চেয়ারম্যান গা-ঢাকা দিয়েছেন। ৩২৩ পৌরসভার মধ্যে দুই শতাধিক মেয়রও দপ্তরে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়। আবার এসব জনপ্রতিনিধি যেভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী থাকলেও সরকারি দলের প্রার্থী ছাড়া অন্যরা ছিলেন ব্যাপক পীড়নে। পৌরসভা নির্বাচনেও ছিল একই অবস্থা। সাম্প্রতিক উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় হলেও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করে। যারা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে অংশ নেন, তারাও ছিলেন সরকারি দলের রোষানলে।

কারা পেলেন সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মহশের আলী, ঢাকা উত্তর সিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুল হাসান, নারায়ণগঞ্জ সিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং কুমিল্লা সিটিতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্য সিটি করপোরেশনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কমিশনারদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার ভাষ্য
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হলেও কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রশাসক থাকলে কাউন্সিলররা দায়িত্ব পালন করবেন কি করবেন না, সেটা এখন তাদের ব্যাপার। মূল কথা হচ্ছে, মেয়র ও চেয়ারম্যানের জায়গায় প্রশাসক দায়িত্ব পালন করবেন। আমরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করব। এখানে মারমার কাটকাটের কোনো বিষয় নেই। এটি স্থানীয় সরকারকে পরিচ্ছন্ন করার একটি প্রচেষ্টা।সূত্র: সমকাল।