নিউইয়র্ক ০৮:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ভাঙলো ভাতঘুম, জিআই নিতে হঠাৎ তাড়াহুড়া

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:১০:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • / ৫২ বার পঠিত

ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতির সনদ নেওয়ার পর টনক নড়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের। এর এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এর পাঁচদিন বাদে আরও কয়েকটি পণ্যকে জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই ভারতের হাতে চলে যাওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের পণ্য হলেও সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পণ্যটির জিআই নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডিপিডিটি জিআই স্বীকৃতিতে বিলম্ব করেছে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব দেশের অভিন্ন পণ্যগুলো জিআই সনদভুক্ত করার তাগিদ অর্থনীতিবিদ ও জিআই বিশেষজ্ঞদের।

জানা যায়, ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল ২০২০ সালে। এরপর চার বছর এ নিয়ে কাজ হয়েছে। এসব তথ্য ওয়েবসাইটেই ছিল। কিন্তু এতদিন ধরে ডিপিডিটি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কোনো তাগাদা দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশে এ পণ্যের জিআইয়ের জন্য টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও শাড়ির জিআইয়ের আবেদন করা হয়নি। শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ভারত ঘোষণা দেওয়ার পর যেন সবার ঘুম ভেঙেছে।

অনেকে বলছেন, এতদিন চুপ থেকে তাড়াহুড়া করে জিআই নিতে গিয়ে ভুল করলে আমরা সমস্যায় পড়তে পারি। জিআই হাতছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকবে। কারণ, জিআইয়ের জন্য বেশ কিছু নিয়ে নিয়ম মানতে হয়, তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়। এগুলো যদি আমরা ঠিকঠাক না দিতে পারি তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সাবধানে এগোতে হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘এখন জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। এতদিন ধরে আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করলো? শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এটা আমাদের অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা। কিন্তু এখন যেভাবে তাড়াহুড়া করে এর জিআই করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা অমূলক। এত তাড়াহুড়ায় আমরা আবার ভুল করে বসতে পারি।’

টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের নাকি বাংলাদেশের
টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি বিষয়ে জিআই বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, অধিকারকর্মীরা বলছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। ভারতে ‘টাঙ্গাইল’ নামে কোনো এলাকা নেই। তাই ভারতের উদ্যোগ অন্যায্য। তারা বলছেন, ভারত দাবি করছে দেশভাগের পর টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিরা ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে তারা টাঙ্গাইল শাড়ি বুনেছেন। তা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইল অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও এই শাড়ি বয়ন করেন। সেক্ষেত্রে ভারত যে যুক্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করেছে, তা ঠিক নয়। এক দেশের তাঁতিরা অন্য দেশে চলে গেলে শাড়ির ভৌগোলিক পরিচয় মুছে যায় না।

এখন বাংলাদেশের করণীয়
পণ্যের জিআই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে জরুরি হলো বাংলাদেশের পক্ষের যুক্তি ও তথ্য–উপাত্তগুলো তুলে ধরা। এ বিষয়ে ভারত বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে সেটি সমাধান করা। আর দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান না হলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে আপত্তি থাকলে তা করতে হবে। এখন বাংলাদেশের উচিত ভারতের আদালতে গিয়ে মামলা করা। এবং সেটা তিন মাসের মধ্যে করতে হবে। ভারত যেসব যুক্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করেছে, সেগুলো তথ্যনির্ভর নয়। সেগুলো ধোপে টিকবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাল্লাই ভারী। কিন্তু সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।’ মেধাসম্পদ সুরক্ষা মঞ্চের (মেধাসুম) আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ববর্ধমান অঞ্চলে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্রকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার মধ্য দিয়ে কেবল ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নয় বরং সেসব অঞ্চলের তাঁত-ঐতিহ্যের ভৌগোলিক নির্দেশনাকেও এ প্রক্রিয়ায় অমান্য করা হয়েছে।’

‘বাংলাদেশে টাঙ্গাইল শাড়ির উদ্ভব এবং কয়েকশ বছর ধরে টাঙ্গাইল শাড়ি বোনা হচ্ছে। দেশভাগসহ নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতশিল্পীদের একাংশের দেশান্তর ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ববর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীসময়ে দেশান্তরিত তাঁতিরা ভারতে তৈরি করে চলেছেন তাঁতবস্ত্র, যা সেসব অঞ্চলের ভৌগোলিক নির্দেশনাকে প্রকাশ করলেও কোনোভাবেই টাঙ্গাইল শাড়িকে নয়।’

জিআই কী এবং কেন দরকার
কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। সাধারণত জিআইতে উৎপত্তিস্থলের নাম (শহর, অঞ্চল বা দেশ) অন্তর্ভুক্ত থাকে। জিআই (GI) এর পূর্ণরূপ হলো (Geographical indication) ভৌগলিক নির্দেশক। WIPO (world intellectual property organization) হলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান। কোনো দেশ জিআই নিবন্ধনের জন্য অবেদনের পরে ওই প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে পণ্যের চূড়ান্ত জিআই দেয়।

কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। যাচাই-বাছাইয়ের পর এগুলোর কোনোটি যদি জিআই সনদ পেয়ে যায়, তাহলে তখন সেগুলো ওই দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে যে পণ্যের জিআই হবে, সে পণ্যের জন্য সুবিধাভোগী হবে শুধু বাংলাদেশ।

২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। এর দুই বছর পর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। ডিপিডিটি এ সংক্রান্ত সরকারি নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান। একদম শুরুতেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য চিহ্নিত করে ওই জেলার প্রশাসক আবেদন করেন ডিপিডিটিতে। সেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সনদ দেওয়ার আইনি ক্ষমতা ডিপিডিটিকে দেওয়া হয়েছে। কোনো দেশ নির্ধারিত কোনো পণ্যের চূড়ান্ত জিআইয়ের জন্য WIPO-তে আবেদন করে। তবে আবেদনের অর্থ এই নয় যে সেগুলোর জিআই সনদ ওই দেশই পাবে। অথবা ওই পণ্যই পাবে। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারিত হয় যে কোন পণ্য বিশ্বব্যাপী জিআই-এর তালিকায় উঠবে।

বাংলাদেশের জিআই পণ্য ৩১টি
বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা এখন ৩১টি। ২০১৬ সালে জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশে প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর স্বীকৃতি পায় আরও ২০টি পণ্য। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারীভোগ, বাংলাদেশ কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসিমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজরের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর, মুক্তগাছার মন্ডা, যশোরের খেজুরের গুড়, রাজশাহীর মিষ্টি পান এবং জামালপুরের নকশিকাঁথা।

আট পণ্যের জিআই ভারত ও বাংলাদেশের উভয়ের
টাঙ্গাইলের শাড়ির মতো ভারতে আটটি পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশেও আছে। এমন পণ্যগুলো হচ্ছে- জামদানি শাড়ি, ফজলি আম, লক্ষ্মণভোগ আম, খিরসাপাত আম, নকশিকাঁথা, রসগোল্লা, গরদ শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু। এমন আরও পণ্য আছে যেগুলোর এখনো কোনো দেশ জিআই করেনি, তবে ভৌগলিক কারণে উভয় দেশে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নানা জাতের ফুল, ফল, মাছ, সুন্দরবনের গাছ, চা, পাটের মতো পণ্য।

এসব পণ্য নিয়ে দ্রুত ভাবনার তাগিদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে ভারত-বাংলাদেশের অভিবাসনের কারণে পাশাপাশি দুই দেশই একই পণ্যের জিআই দাবি করতে পারে। যৌথ মালিকানার যে পণ্যগুলো আছে যেমন আম, নকশিকাঁথা এগুলো নিয়ে সমস্যা না করে কীভাবে উভয় দেশে আমরা জিআই দিতে পারি সেটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। যদিও আমাদের আইনে এ নিয়ে এখনো কিছু বলা নেই।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পণ্যগুলো নিয়ে আমরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে পারি ভারতের সঙ্গে। সেক্ষেত্রে যৌথ মালিকানার পণ্যগুলোকে কীভাবে জিআই দিতে পারি এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অথবা সার্কে অন্য চুক্তির মতো এই আন্তঃসীমান্ত পণ্যগুলো নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। যৌথ নিবন্ধনের প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাতে পারি।’

এখন জিআই নিয়ে সতর্ক সরকার
রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠকে টাঙ্গাইল শাড়িসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক এবং আটটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারকে প্রতিটি জেলায় জিআই পণ্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে ওই বৈঠকে।

এদিকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ভারত জিআই সনদ নিলেও টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ছিল, আমাদের আছে, আমাদের থাকবে। এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়াসহ যা যা করা দরকার, তা করা হবে। সূত্র : জাগোনিউজ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ভাঙলো ভাতঘুম, জিআই নিতে হঠাৎ তাড়াহুড়া

প্রকাশের সময় : ১১:১০:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতির সনদ নেওয়ার পর টনক নড়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের। এর এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। এর পাঁচদিন বাদে আরও কয়েকটি পণ্যকে জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইলের শাড়ির জিআই ভারতের হাতে চলে যাওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের পণ্য হলেও সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পণ্যটির জিআই নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। ডিপিডিটি জিআই স্বীকৃতিতে বিলম্ব করেছে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব দেশের অভিন্ন পণ্যগুলো জিআই সনদভুক্ত করার তাগিদ অর্থনীতিবিদ ও জিআই বিশেষজ্ঞদের।

জানা যায়, ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল ২০২০ সালে। এরপর চার বছর এ নিয়ে কাজ হয়েছে। এসব তথ্য ওয়েবসাইটেই ছিল। কিন্তু এতদিন ধরে ডিপিডিটি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কোনো তাগাদা দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশে এ পণ্যের জিআইয়ের জন্য টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও শাড়ির জিআইয়ের আবেদন করা হয়নি। শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ভারত ঘোষণা দেওয়ার পর যেন সবার ঘুম ভেঙেছে।

অনেকে বলছেন, এতদিন চুপ থেকে তাড়াহুড়া করে জিআই নিতে গিয়ে ভুল করলে আমরা সমস্যায় পড়তে পারি। জিআই হাতছাড়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকবে। কারণ, জিআইয়ের জন্য বেশ কিছু নিয়ে নিয়ম মানতে হয়, তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়। এগুলো যদি আমরা ঠিকঠাক না দিতে পারি তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সাবধানে এগোতে হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘এখন জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। এতদিন ধরে আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করলো? শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এটা আমাদের অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা। কিন্তু এখন যেভাবে তাড়াহুড়া করে এর জিআই করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা অমূলক। এত তাড়াহুড়ায় আমরা আবার ভুল করে বসতে পারি।’

টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের নাকি বাংলাদেশের
টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি বিষয়ে জিআই বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, অধিকারকর্মীরা বলছেন, টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। ভারতে ‘টাঙ্গাইল’ নামে কোনো এলাকা নেই। তাই ভারতের উদ্যোগ অন্যায্য। তারা বলছেন, ভারত দাবি করছে দেশভাগের পর টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিরা ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে তারা টাঙ্গাইল শাড়ি বুনেছেন। তা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে টাঙ্গাইল অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও এই শাড়ি বয়ন করেন। সেক্ষেত্রে ভারত যে যুক্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করেছে, তা ঠিক নয়। এক দেশের তাঁতিরা অন্য দেশে চলে গেলে শাড়ির ভৌগোলিক পরিচয় মুছে যায় না।

এখন বাংলাদেশের করণীয়
পণ্যের জিআই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে জরুরি হলো বাংলাদেশের পক্ষের যুক্তি ও তথ্য–উপাত্তগুলো তুলে ধরা। এ বিষয়ে ভারত বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে সেটি সমাধান করা। আর দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান না হলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে আপত্তি থাকলে তা করতে হবে। এখন বাংলাদেশের উচিত ভারতের আদালতে গিয়ে মামলা করা। এবং সেটা তিন মাসের মধ্যে করতে হবে। ভারত যেসব যুক্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করেছে, সেগুলো তথ্যনির্ভর নয়। সেগুলো ধোপে টিকবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাল্লাই ভারী। কিন্তু সেটাকে কাজে লাগাতে হবে।’ মেধাসম্পদ সুরক্ষা মঞ্চের (মেধাসুম) আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ববর্ধমান অঞ্চলে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্রকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার মধ্য দিয়ে কেবল ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নয় বরং সেসব অঞ্চলের তাঁত-ঐতিহ্যের ভৌগোলিক নির্দেশনাকেও এ প্রক্রিয়ায় অমান্য করা হয়েছে।’

‘বাংলাদেশে টাঙ্গাইল শাড়ির উদ্ভব এবং কয়েকশ বছর ধরে টাঙ্গাইল শাড়ি বোনা হচ্ছে। দেশভাগসহ নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতশিল্পীদের একাংশের দেশান্তর ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ববর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীসময়ে দেশান্তরিত তাঁতিরা ভারতে তৈরি করে চলেছেন তাঁতবস্ত্র, যা সেসব অঞ্চলের ভৌগোলিক নির্দেশনাকে প্রকাশ করলেও কোনোভাবেই টাঙ্গাইল শাড়িকে নয়।’

জিআই কী এবং কেন দরকার
কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। সাধারণত জিআইতে উৎপত্তিস্থলের নাম (শহর, অঞ্চল বা দেশ) অন্তর্ভুক্ত থাকে। জিআই (GI) এর পূর্ণরূপ হলো (Geographical indication) ভৌগলিক নির্দেশক। WIPO (world intellectual property organization) হলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান। কোনো দেশ জিআই নিবন্ধনের জন্য অবেদনের পরে ওই প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে পণ্যের চূড়ান্ত জিআই দেয়।

কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। যাচাই-বাছাইয়ের পর এগুলোর কোনোটি যদি জিআই সনদ পেয়ে যায়, তাহলে তখন সেগুলো ওই দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে যে পণ্যের জিআই হবে, সে পণ্যের জন্য সুবিধাভোগী হবে শুধু বাংলাদেশ।

২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। এর দুই বছর পর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বিধিমালা, ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। ডিপিডিটি এ সংক্রান্ত সরকারি নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান। একদম শুরুতেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য চিহ্নিত করে ওই জেলার প্রশাসক আবেদন করেন ডিপিডিটিতে। সেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সনদ দেওয়ার আইনি ক্ষমতা ডিপিডিটিকে দেওয়া হয়েছে। কোনো দেশ নির্ধারিত কোনো পণ্যের চূড়ান্ত জিআইয়ের জন্য WIPO-তে আবেদন করে। তবে আবেদনের অর্থ এই নয় যে সেগুলোর জিআই সনদ ওই দেশই পাবে। অথবা ওই পণ্যই পাবে। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারিত হয় যে কোন পণ্য বিশ্বব্যাপী জিআই-এর তালিকায় উঠবে।

বাংলাদেশের জিআই পণ্য ৩১টি
বাংলাদেশে অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা এখন ৩১টি। ২০১৬ সালে জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশে প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর স্বীকৃতি পায় আরও ২০টি পণ্য। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারীভোগ, বাংলাদেশ কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসিমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম, মৌলভীবাজরের আগর, মৌলভীবাজারের আগর আতর, মুক্তগাছার মন্ডা, যশোরের খেজুরের গুড়, রাজশাহীর মিষ্টি পান এবং জামালপুরের নকশিকাঁথা।

আট পণ্যের জিআই ভারত ও বাংলাদেশের উভয়ের
টাঙ্গাইলের শাড়ির মতো ভারতে আটটি পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশেও আছে। এমন পণ্যগুলো হচ্ছে- জামদানি শাড়ি, ফজলি আম, লক্ষ্মণভোগ আম, খিরসাপাত আম, নকশিকাঁথা, রসগোল্লা, গরদ শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু। এমন আরও পণ্য আছে যেগুলোর এখনো কোনো দেশ জিআই করেনি, তবে ভৌগলিক কারণে উভয় দেশে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নানা জাতের ফুল, ফল, মাছ, সুন্দরবনের গাছ, চা, পাটের মতো পণ্য।

এসব পণ্য নিয়ে দ্রুত ভাবনার তাগিদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে ভারত-বাংলাদেশের অভিবাসনের কারণে পাশাপাশি দুই দেশই একই পণ্যের জিআই দাবি করতে পারে। যৌথ মালিকানার যে পণ্যগুলো আছে যেমন আম, নকশিকাঁথা এগুলো নিয়ে সমস্যা না করে কীভাবে উভয় দেশে আমরা জিআই দিতে পারি সেটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। যদিও আমাদের আইনে এ নিয়ে এখনো কিছু বলা নেই।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পণ্যগুলো নিয়ে আমরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে পারি ভারতের সঙ্গে। সেক্ষেত্রে যৌথ মালিকানার পণ্যগুলোকে কীভাবে জিআই দিতে পারি এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অথবা সার্কে অন্য চুক্তির মতো এই আন্তঃসীমান্ত পণ্যগুলো নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি। যৌথ নিবন্ধনের প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাতে পারি।’

এখন জিআই নিয়ে সতর্ক সরকার
রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠকে টাঙ্গাইল শাড়িসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক এবং আটটি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারকে প্রতিটি জেলায় জিআই পণ্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে ওই বৈঠকে।

এদিকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ভারত জিআই সনদ নিলেও টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ছিল, আমাদের আছে, আমাদের থাকবে। এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়াসহ যা যা করা দরকার, তা করা হবে। সূত্র : জাগোনিউজ।