নিউইয়র্ক ০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

জাতির পাপমোচন : বিএনপির গতিপ্রকৃতি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৩৭:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৩৭ বার পঠিত

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ (কুসুমকুমারী দাশ)। দেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কবির এই প্রত্যাশা খুবই প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দিল্লির খুঁটির জোরে ১৫ বছর জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। দীর্ঘ দেড় যুগ ১৮ কোটি মানুষ অন্ধকারে বাস করেছে। দানব হাসিনার কবল থেকে কেউ জাতিকে রক্ষা করতে পারেনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা তার আপন ঠিকানাÑ ভারতে পালিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম তথা ছাত্ররা নেতৃত্বে দিয়ে ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে জাতির পাপমোচন করেছে। নব্য ঘষেটি বেগম হাসিনা পালিয়েছে কিন্তু দেশ এখনো রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার মতোই ‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন’ আভাস পাওয়া যায়। হাসপাতালের বেডে কাতরানো জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হাত-পা-চোখ হারানো, পঙ্গু সূর্যসন্তানদের আর্তচিৎকার শুনে চোখ বন্ধ করলে কবির মতোই চোখের সামনে ভেসে ওঠেÑ ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি/বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে/মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।’ জাতির প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারপরও হিন্দুত্ববাদী ভারত পুরোনো শকুনের মতোই বাংলাদেশকে খামচে ধরার চেষ্টা করছে। এ কাজে তারা আমলা-কামলা ও কিছু উপদেষ্টাকে ব্যবহার করছে। ভারত নামের শকুনের চানক্যনীতিতে দেশের চরম অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা চলছে। বাইরে শান্ত দৃশ্যমান হলেও ভেতরে চরম অস্থিরতা। এ অবস্থায় কে হবেন জাতির কা-ারী? ‘কথায় নয় কাজে বড় হয়ে’ কে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো ‘খামোশ’ গর্জে উঠবেন!

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘শাসন’ করেছে তিনটি দল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি কার্যত রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে গণবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দলটি নাম মুখে উচ্চারণ করতেও অনেকেই ঘৃণাবোধ করেন। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সাড়ে ১৫ বছর হাসিনা দেশ শাসনের নামে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে। ফলে ৫ আগস্টে হাসিনা পালানোর পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের রাজনীতির চালিকাশক্তিতে রয়েছে বিএনপি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, শহর থেকে বন্দর বিএনপির লাখো-কোটি কর্মী-সমর্থক রয়েছে। হঠাৎ করে গণমাধ্যমে ইসলামী ধারার দল জামায়াতের উত্থান দৃশ্যমান হলেও জনসমর্থন দলটি যোজন যোজন মাইল পিছিয়ে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের চানক্যনীতির সাফল্যে ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপির হাজার হাজার নেতা ও লাখো কর্মীর জীবনে জুলুম নির্যাতন শুরু হয়। হাজার হাজার নেতাকর্মী এলাকা ছাড়া, দেশছাড়া হয়। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন-নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে মাসের পর মাস ধানক্ষেতে, জঙ্গলে, রাস্তার মোড়ে, মাঝনদীতে কলাগাছের ভেলায় ঘুমিয়েছে। অনেক শিক্ষিত ছেলে দূরদূরান্তে রিকশা, সিএনজি, বাইক চালিয়ে জীবন চালিয়েছেন। হাসিনার জুলুম থেকে রক্ষা পেতে সন্তানের মুখ মা-বোন-স্ত্রীর মুখ পাঁচ বছর ১০ বছর দেখতে পাননি এমন অনেক নেতা রয়েছেন। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। এ সময় দানবীয় কায়দায় হাসিনা বিএনপিকে কয়েক দফায় ভাঙনের চেষ্টা করেন। বিএনপির নেতাদের কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো লোভ দেখিয়ে, কখনো কোটি কোটি টাকার অফার দিয়ে পৃথক বিএনপির করে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা করেছে। কখনো তারেক রহমানকে মাইনাস করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শের নেতাকর্মীদের বিএনপি থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, তারেক রহমানকে ভুলে যায়নি। ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের দু’চারজন লোভী কাঁচা টাকার লোভ সংবরণ করতে না পেরে বিএনপি ছেড়ে গেছেন। আর জেল-জুলুম শত শত মামলা, কারগারের অন্ধ কুঠুরিতে বছরের পর বছর আটক থেকেও বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি দানব হাসিনা। গত ৫ আগস্ট হাসিনার পালানোর মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমের অবসান ঘটেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিএনপি এখন কী করবে? জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বিএনপি কী আগামীর কর্মপন্থা ঠিক করছে? ভারতের জাদুমন্ত্রে নাকি পথ হারিয়ে ফেলছে? হাসিনা পালানোর পাঁচ মাস পর মানুষের মধ্যে এমন হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরসহ তারও আগে দেশের রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির চেষ্টা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা পদ-পদবি আকড়ে থাকায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করেননি। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্বের বন্ধাত্ব্যের কপাট খুলে গেছে। নতুন প্রজন্ম তথা জেনজির প্রতিনিধিরা আন্দোলনে পুলিশের গুলির সামনে বুক উঁচিয়ে ধরে ঢাকার রাজপথে রক্ত ভিজিয়ে হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছে। এর মধ্য দিয়ে সামনে চলে এসেছে এক ঝাঁক তরুণ নেতা। অনেকেই হঠাৎ গজিয়ে উঠা এই নেতাদের পছন্দ না করলেও জাতির জন্য এরা আশীর্বাদ।

দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় বিএনপির প্রতি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বেড়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিএনপি কী করবে? জিয়ার পথ অনুসরণ করবে নাকি অন্য পথ? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দিকে তাকালে কী দেখি? তখন ছিল হিন্দুত্ববাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদের উলঙ্গ নৃত্য। সে সময় ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান পয়লা সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ গোড়াপত্তনের মাধ্যমে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বভাবে ধীর-স্থির জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতার মাধ্যমে এক-পা, দুই-পা করে এগিয়ে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং দিশাহারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন বিএনপির ছায়াতলে। তিনি ‘আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে কষ্টিপাথরের মতো সেকে সেকে দেশের বরেণ্য-অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যারা যে সেক্টরে ‘তারকা’ তাদের নিয়ে আসেন বিএনপিতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, এস এ বারী এটি, বি এম আব্বাসের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের মেধা-মননকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও দলকে এগিয়ে নেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে যখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে ‘এক নেতার এক দেশ’ স্লেøাগান তুলে বাকশাল গঠন করেন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ চালু ও বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দিয়ে দিল্লিকে তুষ্ট করেন; সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণ এবং রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দেয়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের উপর থেকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ভূত ঝেটিয়ে বিদায় করেন। জিয়াউর রহমান যে রাজনীতি করে গেছেন, বেগম খালেদা জিয়া ৪০ বছর ধরে যে ধারায় রাজনীতি করেন, তারেক রহমান কী সে পথে চলবেন নাকি ‘ভারতের আশীর্বাদ ছাড়া ক্ষমতার যাওয়া সম্ভব নয়’ মানসিকতায় পর্দার আড়ালে ভারততুষ্টির পথ অনুসরণ করবেন?

বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। মিথ্যা অভিযোগের মামলায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে রেখেছে। এমনকি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়নি। সেই হাসিনাকে দেশছাড়া করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আন্দোলনের সময় তাদের সঙ্গে হিং¯্র্র পশুর মতো আচরণ করেছে হাসিনার অলিগার্করা। জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে তারা আন্দোলন করে হাসিনাকে দেশছাড়া করেন। বিশ্বের কোনো দেশ জায়গা না দিলেও ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল করতে ভারত একের পর এক ‘ষড়যন্ত্রের মিশাইল’ ছুড়ছে। সেই ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ছাত্ররা। একই সঙ্গে তারা ‘আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক’ করতে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে যদিও সরকারের কথায় সেখান থেকে সরে এসে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করে। ছাত্ররা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ইস্যুতে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সংবিধান মানতে বাধ্য করে জাতিকে মুজিব বন্দনায় বাধ্য করেছে। মুজিবকে হিরো বানাতে সংবিধান সংশোধন করেছে। ফলে ছাত্ররা হাসিনা পালানোর পর মুজিবের ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছে। ছাত্রদের কোনো কোনো নেতা ‘বাহাত্তরের সংবিধান’ বাদ দেয়ার দাবি তুলেছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ বাহাত্তরের সংবিধান আর মুক্তিযুদ্ধ কি এক জিনিস? বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে লন্ডন-দিল্লি হয়ে দেশে ফেরার পর শেখ মুজিব সংবিধান রচনায় হাত দেন। ওই বছরের ৪ নভেম্বর সংবিধান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। মুজিব তার নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আড়াই বছরে চার দফায় সংবিধান সংশোধন করেন। বাহাত্তরের সংবিধান বলতে যা বোঝায় সোজা কথায় তা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজাধিরাজ’ হিসেবে ক্ষমতায়ন। বিএনপির কিছু নেতা বাহাত্তরের সংবিধান বাদ গেলে মুক্তিযুদ্ধ ধামাচাপা পড়ে যাবেÑ এতে করে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার স্বর্ণালি ইতিহাস কার্পেটের নিচে চলে যাবে এমন ভাবনা থেকে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে মায়াকান্না করছেন। ওই সংবিধান নিয়ে তো এতদিন সিপিবির ছাড়া আওয়ামী লীগও মায়াকান্না করেনি। বাহাত্তরের সংবিধানে তো ’৪৭ কে বাদ দেয়া হয়েছে। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে বাহাত্তরের সংবিধা যদি বাদ দেয়া হয় বা সংশোধন করা হয় তাতে ’৪৭ এর ইতিহাস, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস সামান্যতম বাদ যাবে না; বরং আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে ‘মহানায়ক’ বানাতে গিয়ে অন্যান্য যেসব নেতার অবদানকে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়েছে সেগুলো সংযোজন হবে। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সংযোজিত হবে।

বর্তমান রাজনীতিতে নানা দল থাকলেও বিএনপির উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের দেশের গতিপ্রকৃতি। কারণ আওয়ামী লীগ মাইনাস হওয়ার পর বিএনপির জনসমর্থনের ধারেকাছেও নেই কোনো দল। ফলে বিএনপির অনেক কিছু করার রয়েছে। প্রবাদে রয়েছেÑ ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও সেটি অনুধাবন করছেন। বিএনপির কয়েকটি জেলার প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘কোনো কিছুই বিএনপির একার পক্ষে সম্ভব নয়। যেসব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একসঙ্গে আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। সমাজের অনেক মানুষ আছেন, যারা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত নন কিন্তু দেশের জন্য কাজ করতে চান; তারা বিভিন্ন পেশার মানুষ হতে পারেন। তাদের জন্য ৩১ দফায় উচ্চকক্ষ রাখা হয়েছে। এতে তাদের মতামত ভূমিকা রাখতে পারবে দেশ পুনর্গঠনে।’ এটিই হলো নেতার উপলব্ধি। গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছেÑ বিএনপির সঙ্গে যুগপদ এবং সমান্তরাল কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করেছে এমন মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক নূর, আ স ম রব, রাশেদ খানসহ কয়েকজনকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় সংগঠনিক কর্মকা- জোরদারের লক্ষ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে। অতএব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া নতুন প্রজন্মের নেতাদের ‘সুযোগ’ নয় কেন? নতুন প্রজন্মের এই ছাত্রনেতারা তো বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছে। বিএনপি ১৫ বছর যেটি করতে পারেনি তারা সেটি করেছে। তারা নতুন দল গঠন করুক আর না করুক, বিএনপির উচিত তাদের কাছে টানা। সন্তানতুল্য ছাত্রনেতাদের প্রতিপক্ষ না ভেবে তারেক রহমান কাছে ডেকে কথা বলতে পারেন। হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, উমামা ফাতেমাসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ থিউরিতে বুকে তুলে নিতে পারেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না ভেবে ‘ওরা আমাদের লোক’ মানসিকতায় তাদের আগামী নির্বাচনে ৮-১০টি আসন দিয়ে হলেও ধরে রাখা উচিত। নতুন প্রজন্মের ছাত্রনেতারা যা দেখিয়েছেন জাতি হিসেবে গর্ব করার মতোই। বহু বছর ধরে দেশের নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে আগামী দিনে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়ার মুহূর্তে ছাত্রনেতারা যেভাবে গুলির সামনে বুক চিতিয়ে সাহস দেখিয়ে সামনে চলে এসেছেন তা জাতির জন্য উপরি পাওনা। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। দলের শত শত নেতার চেয়ে সাহসী দু’চারজন নেতা অনেক বেশি কার্যকর। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের মূল্যায়ন করলে রাজনীতিতে বিএনপিই লাভবান হবে। কারণ নতুন প্রজন্মের এই তরুণরা শুধু মুজিববাদী রাজনীতির কবর রচনা করেনি; তারা দিল্লির চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে। দিল্লির হুমকির পাল্টা হুমকি দিচ্ছে। ৫ আগস্টের সাফল্যকে ধারণ না করে বিএনপি যদি এখনো ‘দিনে ভারত বিরোধিতা রাতে ভারতের অনুকম্পা’ ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল নেয় তাহলে কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ এখনো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ বাইরে শান্ত মনে হলেও ভেতরে চরম অস্থিরতা। সিনিয়র নেতাদের নতুন প্রজন্মের নেতা তথা ৫ আগস্টের নায়কদের হেলাফেলা করা উচিত নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি, মাথা করো নত/এ আমার এ তোমার পাপ।’ সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

জাতির পাপমোচন : বিএনপির গতিপ্রকৃতি

প্রকাশের সময় : ০১:৩৭:১৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’ (কুসুমকুমারী দাশ)। দেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কবির এই প্রত্যাশা খুবই প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দিল্লির খুঁটির জোরে ১৫ বছর জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। দীর্ঘ দেড় যুগ ১৮ কোটি মানুষ অন্ধকারে বাস করেছে। দানব হাসিনার কবল থেকে কেউ জাতিকে রক্ষা করতে পারেনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা তার আপন ঠিকানাÑ ভারতে পালিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম তথা ছাত্ররা নেতৃত্বে দিয়ে ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে জাতির পাপমোচন করেছে। নব্য ঘষেটি বেগম হাসিনা পালিয়েছে কিন্তু দেশ এখনো রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার মতোই ‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন’ আভাস পাওয়া যায়। হাসপাতালের বেডে কাতরানো জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হাত-পা-চোখ হারানো, পঙ্গু সূর্যসন্তানদের আর্তচিৎকার শুনে চোখ বন্ধ করলে কবির মতোই চোখের সামনে ভেসে ওঠেÑ ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি/বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে/মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।’ জাতির প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তারপরও হিন্দুত্ববাদী ভারত পুরোনো শকুনের মতোই বাংলাদেশকে খামচে ধরার চেষ্টা করছে। এ কাজে তারা আমলা-কামলা ও কিছু উপদেষ্টাকে ব্যবহার করছে। ভারত নামের শকুনের চানক্যনীতিতে দেশের চরম অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা চলছে। বাইরে শান্ত দৃশ্যমান হলেও ভেতরে চরম অস্থিরতা। এ অবস্থায় কে হবেন জাতির কা-ারী? ‘কথায় নয় কাজে বড় হয়ে’ কে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো ‘খামোশ’ গর্জে উঠবেন!

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ‘শাসন’ করেছে তিনটি দল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি কার্যত রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে গণবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দলটি নাম মুখে উচ্চারণ করতেও অনেকেই ঘৃণাবোধ করেন। আওয়ামী লীগের ব্যানারে সাড়ে ১৫ বছর হাসিনা দেশ শাসনের নামে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে। ফলে ৫ আগস্টে হাসিনা পালানোর পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের রাজনীতির চালিকাশক্তিতে রয়েছে বিএনপি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, শহর থেকে বন্দর বিএনপির লাখো-কোটি কর্মী-সমর্থক রয়েছে। হঠাৎ করে গণমাধ্যমে ইসলামী ধারার দল জামায়াতের উত্থান দৃশ্যমান হলেও জনসমর্থন দলটি যোজন যোজন মাইল পিছিয়ে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের চানক্যনীতির সাফল্যে ওয়ান-ইলেভেনের মাধ্যমে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপির হাজার হাজার নেতা ও লাখো কর্মীর জীবনে জুলুম নির্যাতন শুরু হয়। হাজার হাজার নেতাকর্মী এলাকা ছাড়া, দেশছাড়া হয়। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন-নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে মাসের পর মাস ধানক্ষেতে, জঙ্গলে, রাস্তার মোড়ে, মাঝনদীতে কলাগাছের ভেলায় ঘুমিয়েছে। অনেক শিক্ষিত ছেলে দূরদূরান্তে রিকশা, সিএনজি, বাইক চালিয়ে জীবন চালিয়েছেন। হাসিনার জুলুম থেকে রক্ষা পেতে সন্তানের মুখ মা-বোন-স্ত্রীর মুখ পাঁচ বছর ১০ বছর দেখতে পাননি এমন অনেক নেতা রয়েছেন। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। এ সময় দানবীয় কায়দায় হাসিনা বিএনপিকে কয়েক দফায় ভাঙনের চেষ্টা করেন। বিএনপির নেতাদের কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো লোভ দেখিয়ে, কখনো কোটি কোটি টাকার অফার দিয়ে পৃথক বিএনপির করে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টা করেছে। কখনো তারেক রহমানকে মাইনাস করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শের নেতাকর্মীদের বিএনপি থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, তারেক রহমানকে ভুলে যায়নি। ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের দু’চারজন লোভী কাঁচা টাকার লোভ সংবরণ করতে না পেরে বিএনপি ছেড়ে গেছেন। আর জেল-জুলুম শত শত মামলা, কারগারের অন্ধ কুঠুরিতে বছরের পর বছর আটক থেকেও বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি দানব হাসিনা। গত ৫ আগস্ট হাসিনার পালানোর মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমের অবসান ঘটেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিএনপি এখন কী করবে? জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বিএনপি কী আগামীর কর্মপন্থা ঠিক করছে? ভারতের জাদুমন্ত্রে নাকি পথ হারিয়ে ফেলছে? হাসিনা পালানোর পাঁচ মাস পর মানুষের মধ্যে এমন হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরসহ তারও আগে দেশের রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির চেষ্টা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা পদ-পদবি আকড়ে থাকায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করেননি। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্বের বন্ধাত্ব্যের কপাট খুলে গেছে। নতুন প্রজন্ম তথা জেনজির প্রতিনিধিরা আন্দোলনে পুলিশের গুলির সামনে বুক উঁচিয়ে ধরে ঢাকার রাজপথে রক্ত ভিজিয়ে হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছে। এর মধ্য দিয়ে সামনে চলে এসেছে এক ঝাঁক তরুণ নেতা। অনেকেই হঠাৎ গজিয়ে উঠা এই নেতাদের পছন্দ না করলেও জাতির জন্য এরা আশীর্বাদ।

দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় বিএনপির প্রতি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বেড়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিএনপি কী করবে? জিয়ার পথ অনুসরণ করবে নাকি অন্য পথ? শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দিকে তাকালে কী দেখি? তখন ছিল হিন্দুত্ববাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদের উলঙ্গ নৃত্য। সে সময় ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান পয়লা সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ গোড়াপত্তনের মাধ্যমে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বভাবে ধীর-স্থির জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতার মাধ্যমে এক-পা, দুই-পা করে এগিয়ে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং দিশাহারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন বিএনপির ছায়াতলে। তিনি ‘আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে কষ্টিপাথরের মতো সেকে সেকে দেশের বরেণ্য-অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যারা যে সেক্টরে ‘তারকা’ তাদের নিয়ে আসেন বিএনপিতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, এস এ বারী এটি, বি এম আব্বাসের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের মেধা-মননকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও দলকে এগিয়ে নেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে যখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে ‘এক নেতার এক দেশ’ স্লেøাগান তুলে বাকশাল গঠন করেন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকতে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ চালু ও বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দিয়ে দিল্লিকে তুষ্ট করেন; সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণ এবং রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দেয়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের উপর থেকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ভূত ঝেটিয়ে বিদায় করেন। জিয়াউর রহমান যে রাজনীতি করে গেছেন, বেগম খালেদা জিয়া ৪০ বছর ধরে যে ধারায় রাজনীতি করেন, তারেক রহমান কী সে পথে চলবেন নাকি ‘ভারতের আশীর্বাদ ছাড়া ক্ষমতার যাওয়া সম্ভব নয়’ মানসিকতায় পর্দার আড়ালে ভারততুষ্টির পথ অনুসরণ করবেন?

বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাড়ে ১৫ বছর বিএনপির হাজারো নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। মিথ্যা অভিযোগের মামলায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে সাজা দিয়ে কারাগারে রেখেছে। এমনকি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়নি। সেই হাসিনাকে দেশছাড়া করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আন্দোলনের সময় তাদের সঙ্গে হিং¯্র্র পশুর মতো আচরণ করেছে হাসিনার অলিগার্করা। জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে তারা আন্দোলন করে হাসিনাকে দেশছাড়া করেন। বিশ্বের কোনো দেশ জায়গা না দিলেও ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল করতে ভারত একের পর এক ‘ষড়যন্ত্রের মিশাইল’ ছুড়ছে। সেই ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ছাত্ররা। একই সঙ্গে তারা ‘আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক’ করতে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে যদিও সরকারের কথায় সেখান থেকে সরে এসে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করে। ছাত্ররা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ইস্যুতে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সংবিধান মানতে বাধ্য করে জাতিকে মুজিব বন্দনায় বাধ্য করেছে। মুজিবকে হিরো বানাতে সংবিধান সংশোধন করেছে। ফলে ছাত্ররা হাসিনা পালানোর পর মুজিবের ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছে। ছাত্রদের কোনো কোনো নেতা ‘বাহাত্তরের সংবিধান’ বাদ দেয়ার দাবি তুলেছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ বাহাত্তরের সংবিধান আর মুক্তিযুদ্ধ কি এক জিনিস? বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে লন্ডন-দিল্লি হয়ে দেশে ফেরার পর শেখ মুজিব সংবিধান রচনায় হাত দেন। ওই বছরের ৪ নভেম্বর সংবিধান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। মুজিব তার নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আড়াই বছরে চার দফায় সংবিধান সংশোধন করেন। বাহাত্তরের সংবিধান বলতে যা বোঝায় সোজা কথায় তা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজাধিরাজ’ হিসেবে ক্ষমতায়ন। বিএনপির কিছু নেতা বাহাত্তরের সংবিধান বাদ গেলে মুক্তিযুদ্ধ ধামাচাপা পড়ে যাবেÑ এতে করে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার স্বর্ণালি ইতিহাস কার্পেটের নিচে চলে যাবে এমন ভাবনা থেকে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে মায়াকান্না করছেন। ওই সংবিধান নিয়ে তো এতদিন সিপিবির ছাড়া আওয়ামী লীগও মায়াকান্না করেনি। বাহাত্তরের সংবিধানে তো ’৪৭ কে বাদ দেয়া হয়েছে। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে বাহাত্তরের সংবিধা যদি বাদ দেয়া হয় বা সংশোধন করা হয় তাতে ’৪৭ এর ইতিহাস, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস সামান্যতম বাদ যাবে না; বরং আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে ‘মহানায়ক’ বানাতে গিয়ে অন্যান্য যেসব নেতার অবদানকে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়েছে সেগুলো সংযোজন হবে। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সংযোজিত হবে।

বর্তমান রাজনীতিতে নানা দল থাকলেও বিএনপির উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের দেশের গতিপ্রকৃতি। কারণ আওয়ামী লীগ মাইনাস হওয়ার পর বিএনপির জনসমর্থনের ধারেকাছেও নেই কোনো দল। ফলে বিএনপির অনেক কিছু করার রয়েছে। প্রবাদে রয়েছেÑ ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও সেটি অনুধাবন করছেন। বিএনপির কয়েকটি জেলার প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘কোনো কিছুই বিএনপির একার পক্ষে সম্ভব নয়। যেসব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একসঙ্গে আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। সমাজের অনেক মানুষ আছেন, যারা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত নন কিন্তু দেশের জন্য কাজ করতে চান; তারা বিভিন্ন পেশার মানুষ হতে পারেন। তাদের জন্য ৩১ দফায় উচ্চকক্ষ রাখা হয়েছে। এতে তাদের মতামত ভূমিকা রাখতে পারবে দেশ পুনর্গঠনে।’ এটিই হলো নেতার উপলব্ধি। গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছেÑ বিএনপির সঙ্গে যুগপদ এবং সমান্তরাল কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করেছে এমন মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক নূর, আ স ম রব, রাশেদ খানসহ কয়েকজনকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় সংগঠনিক কর্মকা- জোরদারের লক্ষ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে। অতএব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া নতুন প্রজন্মের নেতাদের ‘সুযোগ’ নয় কেন? নতুন প্রজন্মের এই ছাত্রনেতারা তো বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছে। বিএনপি ১৫ বছর যেটি করতে পারেনি তারা সেটি করেছে। তারা নতুন দল গঠন করুক আর না করুক, বিএনপির উচিত তাদের কাছে টানা। সন্তানতুল্য ছাত্রনেতাদের প্রতিপক্ষ না ভেবে তারেক রহমান কাছে ডেকে কথা বলতে পারেন। হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, উমামা ফাতেমাসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ থিউরিতে বুকে তুলে নিতে পারেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না ভেবে ‘ওরা আমাদের লোক’ মানসিকতায় তাদের আগামী নির্বাচনে ৮-১০টি আসন দিয়ে হলেও ধরে রাখা উচিত। নতুন প্রজন্মের ছাত্রনেতারা যা দেখিয়েছেন জাতি হিসেবে গর্ব করার মতোই। বহু বছর ধরে দেশের নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে আগামী দিনে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়ার মুহূর্তে ছাত্রনেতারা যেভাবে গুলির সামনে বুক চিতিয়ে সাহস দেখিয়ে সামনে চলে এসেছেন তা জাতির জন্য উপরি পাওনা। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। দলের শত শত নেতার চেয়ে সাহসী দু’চারজন নেতা অনেক বেশি কার্যকর। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের মূল্যায়ন করলে রাজনীতিতে বিএনপিই লাভবান হবে। কারণ নতুন প্রজন্মের এই তরুণরা শুধু মুজিববাদী রাজনীতির কবর রচনা করেনি; তারা দিল্লির চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে। দিল্লির হুমকির পাল্টা হুমকি দিচ্ছে। ৫ আগস্টের সাফল্যকে ধারণ না করে বিএনপি যদি এখনো ‘দিনে ভারত বিরোধিতা রাতে ভারতের অনুকম্পা’ ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল নেয় তাহলে কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ এখনো দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ বাইরে শান্ত মনে হলেও ভেতরে চরম অস্থিরতা। সিনিয়র নেতাদের নতুন প্রজন্মের নেতা তথা ৫ আগস্টের নায়কদের হেলাফেলা করা উচিত নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি, মাথা করো নত/এ আমার এ তোমার পাপ।’ সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব।