নিউইয়র্ক ০৩:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কিশোরদের অপরাধে বড়দের মদদ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৪৮:২৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অগাস্ট ২০২০
  • / ৩৬ বার পঠিত

এস এম আজাদ: রাজধানী ঢাকার উত্তরায় তিন বছর আগে কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে আদনান কবীর নামের এক স্কুলশিক্ষার্থীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস নামের তিনটি কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধের কারণে ওই হত্যাকান্ড ঘটে। উত্তরা এলাকা কেন্দ্রিক সক্রিয় ৩০টিরও বেশি গ্যাংয়ের তথ্য উঠে আসে তখন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিসকো বয়েজের দলনেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার ওরফে সেতু (২২), বিগ বস গ্রæপের নেতা আকতারুজ্জামান ওরফে ছোটন (১৯) বয়সে বড় হলেও তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বয়সে ছোট কিশোরদের। ভূমি দখল, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে তাদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন এই বড় ভাইয়েরা। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, তাঁদের নেতৃত্বে কিশোররা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা ছাড়াও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেও অংশ নিয়েছে। আদদান হত্যাকান্ডে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং র‌্যাবের অভিযানে কিশোর গ্যাংগুলোর অপতৎপরতা কমলেও অনলাইনে তারা সক্রিয়।
রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট স্টার বন্ড নামের একটি গ্যাংয়ের সদস্য আমিনুল ইসলাম নিহত হয় প্রতিপক্ষ মোল্লা রাব্বি গ্রæপের হাতে। একই রকম পোশাক ও চুলের স্টাইল করে এলাকায় ঘুরে বেড়ানো দল দুটির সদস্যরা এখনো অনলাইনে সক্রিয়। স্টার বন্ডের প্রধান মুন্না এবং মোল্লা রাব্বি গ্রæপের প্রধান রাব্বি বয়সে তরুণ হলেও তাদের দলে আছে কম বয়সী কিশোররা।
র‌্যাবের সূত্র জানায়, ছিনতাই, মাদক কারবার ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার পাশাপাশি এলাকায় রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিস্তার করতেও কাজ করে এই দুই গ্রæপের অনুসারীরা। দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রæহণ করবে- এই আশায় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের মাঝেমধ্যেই কাছে টানেন। রাজধানীতে সক্রিয় ৪২ কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত বছর ঢাকায় র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক অভিযানে অন্তত ৩০টি কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তখন শনাক্ত হওয়া ৬২টি গ্রæপের মধ্যে অন্তত ৪২টি এখনো সক্রিয়। করোনা মহামারির মধ্যেও হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকান্ডের ঘটনায় আলোচনায় আসছে কিশোর গ্যাং।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজেদের বড় ও প্রভাবশালী বলে উপস্থাপন করতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, বাইক রাইডিং, অনলাইন ক্যাম্পিং, দেয়াল লিখনের মাধমে গ্যাংগুলো গড়ে উঠছে। এরপর মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, দল বেঁধে মাদকসেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্রæপ। প্রতিটি দলে ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অন্তত ১০-১৫ জন করে থাকছে। তবে দলনেতার বয়স তাদের চেয়ে বেশি, ১৮ থেকে ২৫ বছর। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে অপরাধ করতে মহল্লার বড় ভাই এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব দলনেতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁদের হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এবং দখল ও চাঁদাবাজিতে দল ভারী করে উঠতি বয়সী এই অপরাধীরা। বস্তির দিনমজুর থেকে শুরু করে ধনীর দুলালরা এই চোরাবালিতে নিজের অজান্তেই পা দিচ্ছে।
মানবাধিকার, আইন, অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, কিশোর বয়সেই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার প্রবণতা থেকে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অনেকে। বড়রা তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করেন। অনলাইন কালচারের কারণে এখন দল গঠনের ধরন পাল্টাচ্ছে। গ্যাংগুলোকে যারা ব্যবহার করছে, তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি ওই কিশোরদের সংশোধনেও গুরুত্ব দেন তাঁরা।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, শিশু-কিশোররা অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে হিরোইজম বা নিজেকে বড় মনে করা একটি বড় কারণ। এ ছাড়া অভিভাবকদের উদাসীনতা, বেড়ে ওঠার অসুস্থ পরিবেশ এবং অনলাইনের অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয় দায়ী। তবে এর প্রতিকারে আইনের প্রয়োগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। সংশোধন ব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে।
চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, শিশু-কিশোরদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছেন বড়রা। যাঁরা তাদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছেন তাঁদের দ্রæত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনলে আপরাধ কমতে পারে।
২০০১ সালে উত্তরায় কাঁকড়া গ্রæপের মাধ্যমে দলবদ্ধ সন্ত্রাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে মহানগরবাসীর। ২০১৭ সালে সেখানে স্কুলছাত্র আদনান কবীর হত্যাকান্ডের পর ওই এলাকায়ই ৩০টি গ্যাংয়ের সন্ধান মেলে।
ঢাকার শিশু আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব ৯০টির বেশি হত্যাকান্ড ঘটেছে।
জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, নিজেদের সিনিয়র বলে প্রতিষ্ঠার প্রবণতা থেকেই এই গ্রæপগুলো তৈরি হয়েছে। লেখাপড়া না করা কিশোরদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছেলেরাও রয়েছে। দলগুলোর প্রধানরা বয়সে বড় থাকেন। উত্তরার বিগ বস, মাইরা ফালাইমুসহ কয়েকটি গ্রæপের লিডার বড় দেখা গেছে। আবার অনেকে স্বার্থ হাসিলের জন্য এদের ব্যবহার করে। হাতে ইয়াবা দিয়ে, বাইক দিয়ে জমি দখলে নিয়ে যায়। লোকবল বাড়ায়। এসব কারণেই কিশোর গ্যাং পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।
সর্বশেষ গত সোমবার (১৭ আগষ্ট) নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ইস্পাহানী ঘাটে স্থানীয় দুই গ্রæপের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় দুই স্কুলছাত্র। ১৫ জুলাই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসুলপুর ৬ নম্বর গলিতে ছুরিকাঘাতে খুন হয় সজিব নামের এক তরুণ। সজিবের দূর সম্পর্কের চাচা সোহেল মিয়া জানান, সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব তাঁর ভাতিজাকে হত্যা করা হয়।
গত ২৩ ফেব্রæয়ারী হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় হাসনাত শিপন নামের এক তরুণ। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্বর জের ধরে মুগদায় মান্ডার ল্যাটকার গলি বালুর মাঠে ছুরিকাঘাতে খুন হয় তরুণ মাহিন হোসেন। ১৮ নভেম্বর মিরপুরের শাহ আলী স্কুলের পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আহত হয় শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিফাত ও শাহেদ।
পুলিশ সূত্র জানায়, রায়েরবাজার এলাকায় ইয়াসিন আরাফাত (১৬) নামের এক কিশোর খুন হয় বাংলা ও লাভলেট নামে দুটি গ্রæপের বিরোধে। বাংলা গ্রæপের প্রধান সাখাওয়াত হোসেন সৈকত ওরফে বাংলা বয়সে বড় এবং এলাকার ক্যাডার বলে পরিচিত।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা জিগাতলা ও রায়েরবাজারে একটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা হেজ্জাজ বিন আলম, জিগাতলা নতুন রাস্তা এলাকার ভাইগ্না রনি, মিতালী রোডের রুবেল, ধানমন্ডির তাহাজ্জিব, বাস্টার্ড সেলিম, হাসান আসিফ হোসেন, শরীফ ইসলাম, ইমাম হোসেন প্রতীক ওরফে শুভ, মেহেদী হাসান অনিকসহ কয়েকজন সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে আছে অর্ধশতাধিক কিশোর ও তরুণ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও নেই। সম্প্রতি পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পায় পুলিশ।
গত বছরের ৪ সেপ্টেমর মোহাম্মদপুরে আতঙ্ক গ্রæপ গ্যাং স্টার থেকে সরে আসার কারণে ফিল্ম ঝিরঝির গ্রæপের সদস্য চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মহসিনকে (১৬) হত্যা করা হয়। এর আগে ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে লাড়া দে গ্রæপের প্রধান তামিমুর রহমান মিম, লেভেল হাই গ্রæপের প্রধান মানিককে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁদের বয়স ২০ বছরের ওপরে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ‘লাগাতার অভিযানে এখন আর আগের মতো কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা শোনা যায় না। তার পরও পাড়া-মহল্লায় এদের সহযোগীরা গোপনে কার্যক্রম চালাতে পারে, এটাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি।’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

কিশোরদের অপরাধে বড়দের মদদ

প্রকাশের সময় : ০৯:৪৮:২৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অগাস্ট ২০২০

এস এম আজাদ: রাজধানী ঢাকার উত্তরায় তিন বছর আগে কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে আদনান কবীর নামের এক স্কুলশিক্ষার্থীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস নামের তিনটি কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধের কারণে ওই হত্যাকান্ড ঘটে। উত্তরা এলাকা কেন্দ্রিক সক্রিয় ৩০টিরও বেশি গ্যাংয়ের তথ্য উঠে আসে তখন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিসকো বয়েজের দলনেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার ওরফে সেতু (২২), বিগ বস গ্রæপের নেতা আকতারুজ্জামান ওরফে ছোটন (১৯) বয়সে বড় হলেও তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বয়সে ছোট কিশোরদের। ভূমি দখল, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে তাদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন এই বড় ভাইয়েরা। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, তাঁদের নেতৃত্বে কিশোররা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা ছাড়াও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেও অংশ নিয়েছে। আদদান হত্যাকান্ডে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং র‌্যাবের অভিযানে কিশোর গ্যাংগুলোর অপতৎপরতা কমলেও অনলাইনে তারা সক্রিয়।
রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট স্টার বন্ড নামের একটি গ্যাংয়ের সদস্য আমিনুল ইসলাম নিহত হয় প্রতিপক্ষ মোল্লা রাব্বি গ্রæপের হাতে। একই রকম পোশাক ও চুলের স্টাইল করে এলাকায় ঘুরে বেড়ানো দল দুটির সদস্যরা এখনো অনলাইনে সক্রিয়। স্টার বন্ডের প্রধান মুন্না এবং মোল্লা রাব্বি গ্রæপের প্রধান রাব্বি বয়সে তরুণ হলেও তাদের দলে আছে কম বয়সী কিশোররা।
র‌্যাবের সূত্র জানায়, ছিনতাই, মাদক কারবার ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার পাশাপাশি এলাকায় রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিস্তার করতেও কাজ করে এই দুই গ্রæপের অনুসারীরা। দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রæহণ করবে- এই আশায় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের মাঝেমধ্যেই কাছে টানেন। রাজধানীতে সক্রিয় ৪২ কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গত বছর ঢাকায় র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক অভিযানে অন্তত ৩০টি কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তখন শনাক্ত হওয়া ৬২টি গ্রæপের মধ্যে অন্তত ৪২টি এখনো সক্রিয়। করোনা মহামারির মধ্যেও হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যাকান্ডের ঘটনায় আলোচনায় আসছে কিশোর গ্যাং।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজেদের বড় ও প্রভাবশালী বলে উপস্থাপন করতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, বাইক রাইডিং, অনলাইন ক্যাম্পিং, দেয়াল লিখনের মাধমে গ্যাংগুলো গড়ে উঠছে। এরপর মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, দল বেঁধে মাদকসেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, এমনকি মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্রæপ। প্রতিটি দলে ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অন্তত ১০-১৫ জন করে থাকছে। তবে দলনেতার বয়স তাদের চেয়ে বেশি, ১৮ থেকে ২৫ বছর। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে অপরাধ করতে মহল্লার বড় ভাই এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব দলনেতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁদের হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এবং দখল ও চাঁদাবাজিতে দল ভারী করে উঠতি বয়সী এই অপরাধীরা। বস্তির দিনমজুর থেকে শুরু করে ধনীর দুলালরা এই চোরাবালিতে নিজের অজান্তেই পা দিচ্ছে।
মানবাধিকার, আইন, অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, কিশোর বয়সেই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার প্রবণতা থেকে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অনেকে। বড়রা তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করেন। অনলাইন কালচারের কারণে এখন দল গঠনের ধরন পাল্টাচ্ছে। গ্যাংগুলোকে যারা ব্যবহার করছে, তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি ওই কিশোরদের সংশোধনেও গুরুত্ব দেন তাঁরা।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, শিশু-কিশোররা অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে হিরোইজম বা নিজেকে বড় মনে করা একটি বড় কারণ। এ ছাড়া অভিভাবকদের উদাসীনতা, বেড়ে ওঠার অসুস্থ পরিবেশ এবং অনলাইনের অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয় দায়ী। তবে এর প্রতিকারে আইনের প্রয়োগের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। সংশোধন ব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে।
চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, শিশু-কিশোরদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছেন বড়রা। যাঁরা তাদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছেন তাঁদের দ্রæত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনলে আপরাধ কমতে পারে।
২০০১ সালে উত্তরায় কাঁকড়া গ্রæপের মাধ্যমে দলবদ্ধ সন্ত্রাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে মহানগরবাসীর। ২০১৭ সালে সেখানে স্কুলছাত্র আদনান কবীর হত্যাকান্ডের পর ওই এলাকায়ই ৩০টি গ্যাংয়ের সন্ধান মেলে।
ঢাকার শিশু আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব ৯০টির বেশি হত্যাকান্ড ঘটেছে।
জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, নিজেদের সিনিয়র বলে প্রতিষ্ঠার প্রবণতা থেকেই এই গ্রæপগুলো তৈরি হয়েছে। লেখাপড়া না করা কিশোরদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছেলেরাও রয়েছে। দলগুলোর প্রধানরা বয়সে বড় থাকেন। উত্তরার বিগ বস, মাইরা ফালাইমুসহ কয়েকটি গ্রæপের লিডার বড় দেখা গেছে। আবার অনেকে স্বার্থ হাসিলের জন্য এদের ব্যবহার করে। হাতে ইয়াবা দিয়ে, বাইক দিয়ে জমি দখলে নিয়ে যায়। লোকবল বাড়ায়। এসব কারণেই কিশোর গ্যাং পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।
সর্বশেষ গত সোমবার (১৭ আগষ্ট) নারায়ণগঞ্জের বন্দরের ইস্পাহানী ঘাটে স্থানীয় দুই গ্রæপের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় দুই স্কুলছাত্র। ১৫ জুলাই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর পূর্ব রসুলপুর ৬ নম্বর গলিতে ছুরিকাঘাতে খুন হয় সজিব নামের এক তরুণ। সজিবের দূর সম্পর্কের চাচা সোহেল মিয়া জানান, সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব তাঁর ভাতিজাকে হত্যা করা হয়।
গত ২৩ ফেব্রæয়ারী হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় হাসনাত শিপন নামের এক তরুণ। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্বর জের ধরে মুগদায় মান্ডার ল্যাটকার গলি বালুর মাঠে ছুরিকাঘাতে খুন হয় তরুণ মাহিন হোসেন। ১৮ নভেম্বর মিরপুরের শাহ আলী স্কুলের পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আহত হয় শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন রিফাত ও শাহেদ।
পুলিশ সূত্র জানায়, রায়েরবাজার এলাকায় ইয়াসিন আরাফাত (১৬) নামের এক কিশোর খুন হয় বাংলা ও লাভলেট নামে দুটি গ্রæপের বিরোধে। বাংলা গ্রæপের প্রধান সাখাওয়াত হোসেন সৈকত ওরফে বাংলা বয়সে বড় এবং এলাকার ক্যাডার বলে পরিচিত।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা জিগাতলা ও রায়েরবাজারে একটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা হেজ্জাজ বিন আলম, জিগাতলা নতুন রাস্তা এলাকার ভাইগ্না রনি, মিতালী রোডের রুবেল, ধানমন্ডির তাহাজ্জিব, বাস্টার্ড সেলিম, হাসান আসিফ হোসেন, শরীফ ইসলাম, ইমাম হোসেন প্রতীক ওরফে শুভ, মেহেদী হাসান অনিকসহ কয়েকজন সন্ত্রাসীর নিয়ন্ত্রণে আছে অর্ধশতাধিক কিশোর ও তরুণ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও নেই। সম্প্রতি পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পায় পুলিশ।
গত বছরের ৪ সেপ্টেমর মোহাম্মদপুরে আতঙ্ক গ্রæপ গ্যাং স্টার থেকে সরে আসার কারণে ফিল্ম ঝিরঝির গ্রæপের সদস্য চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মহসিনকে (১৬) হত্যা করা হয়। এর আগে ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থেকে লাড়া দে গ্রæপের প্রধান তামিমুর রহমান মিম, লেভেল হাই গ্রæপের প্রধান মানিককে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁদের বয়স ২০ বছরের ওপরে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ‘লাগাতার অভিযানে এখন আর আগের মতো কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা শোনা যায় না। তার পরও পাড়া-মহল্লায় এদের সহযোগীরা গোপনে কার্যক্রম চালাতে পারে, এটাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি।’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ)