স্বাধীনতার পরে পাঁচ দশকে আ.লীগের ১৫ এমপি খুন
- প্রকাশের সময় : ০২:০০:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ জুন ২০২৪
- / ৮৪ বার পঠিত
জাতীয় সংসদের সদস্য তথা আইনপ্রণেতারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্যতম। দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয়ে থাকা রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সংসদ সদস্যের হত্যাজনিত মৃত্যু বিস্ময় সৃষ্টি করে জনমনে। দেশজুড়ে তৈরি হয় আলোড়ন। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কলকাতায় বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের খুন হওয়ার ঘটনা দেশ-বিদেশে তুমুল হইচই ফেলে দিয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে এই হত্যার রহস্য উন্মোচনে চেষ্টা চালালেও এখনো পর্যন্ত আনারের লাশ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের সংসদ সদস্য খুনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫৩ বছরে এ পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় ১৫ জন সংসদ সদস্য হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আনারই হলেন প্রথম যিনি বিদেশের মাটিতে খুনের শিকার হন।
যখন যারা যেভাবে খুন হন:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল ১৯৭২-১৯৭৫ সালে (তিন বছরে) সর্বোচ্চ ৭ জন সংসদ সদস্য হত্যার শিকার হন। এছাড়া সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের শাসনের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দি অবস্থায় থাকা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের প্রধান হওয়ার পর ১৯৮১ সাল থেকে সর্বশেষ ২০২৪ সাল পর্যন্ত আরও ৪ সংসদ সদস্য খুন হন। এই চার জনের মধ্যে গাজীপুরে ২০০৪ সালে আহসান উল্লাহ মাস্টার ও ২০০৫ সালে শাহ এ এম এস কিবরিয়া হবিগঞ্জে নিহত হন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ দলীয় দুজন সংসদ সদস্য খুন হন চার দলীয় জোট সরকার আমলে।
এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকারের সময় ২০১৬ সালে গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিজ বাড়িতে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে খুন হন। সবশেষ ভারতের কলকাতায় খুন হলেন আনোয়ারুল আজীম আনার।
বঙ্গবন্ধুর আমলে যারা খুন হন
১. আব্দুল গফুর এমপি: সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে ৭ জন সংসদ সদস্য হত্যার শিকার হন। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথম হত্যার শিকার হন খুলনার ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর। খুলনার পাইকগাছা ও আশাশুনি আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এই সদস্যকে ১৯৭২ সালের ৬ জুন গুলি করে হত্যা করা হয়।
২. নুরুল হক হাওলাদার এমপি: ১৯৭৩ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শরীয়তপুরের নড়িয়া আসনের এমপি নুরুল হক। তিনি তৎকালীন ফরিদপুর-১৭ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৩০ মে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় নিজ বাড়ির বৈঠকখানায় আততায়ীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
৩. আবদুল মুকিম এমপি: একই বছর খুন হন ঝালকাঠির এমপি আবদুল মুকিম। তিনি ১৯৭৩ সালে ঝালকাঠি ও নলছিটি থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা গ্রুপ তাকে গুলি করে হত্যা করে।
৪. মোতাহার উদ্দিন আহমেদ মাস্টার এমপি: ১৯৭৪ সালে ভোলার মোতাহার উদ্দিন আহমেদ মাস্টার হত্যার শিকার হন। তিনি ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ১১৪ নং আসন এবং বাকেরগঞ্জ ৩, বর্তমানে ভোলা ৩, লালমোহন ও চরফ্যাশন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ১০ জানুয়ারি সন্ত্রাসীরা তাকে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে।
৫. গাজী ফজলুর রহমান এমপি: ১৯৭৩ সালে তৎকালীন ঢাকা-২২ আসনের নরসিংদীর মনোহরদী এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন গাজী ফজলুর রহমান। তিনি হাতিরদিয়া সাদত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। ১৯৭৪ সালের ১৬ মার্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্বপালন অবস্থায় সর্বহারা সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
৬. গোলাম কিবরিয়া এমপি: কুষ্টিয়ার গোলাম কিবরিয়া হত্যার শিকার হন ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে। তিনি কুষ্টিয়া জেলার খোকসা-কুমারখালী থেকে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সকালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার সামনে কোরবানির ঈদের জামাত হয়। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে ঈদের নামাজে দাঁড়িয়েছিলেন এমপি গোলাম কিবরিয়া। ঠিক নামাজ শুরুর হওয়ার মুহূর্তে জাসদের গণবাহিনীর কর্মীরা তাকে ব্রাশফায়ার করে। এতে গোলাম কিবরিয়াসহ মোহাম্মদ আলী নামের স্থানীয় এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নিহত হন।
৭. আবদুল খালেক এমপি: নেত্রকোনা-১ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি এবং নেত্রকোনা মহকুমা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ছিলেন আব্দুল খালেক। নেত্রকোনার মদন-খালিয়াজুরি থেকে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তারপুর মাঠে একটি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরছিলেন। কিন্তু বাড়ি না ফিরে তিনি চলে যান চিরতরে না ফেরার দেশে। পথে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু আমলে আরও বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা খুন হন। যারা ১৯৭০ এ আওয়ামী লীগের হয়ে গণপরিষদে নির্বাচিত এমপি ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে যারা খুন হন
১. আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপি: গাজীপুর-২ আসন থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার। ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। বিচারিক আদালতে রায়ের পর মামলাটি হাইকোর্টেও শুনানি হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায় দেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে পৃথক পৃথক আপিল আবেদন জানায় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিরা। এরপর আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষায় মামলাটি এখনো ঝুলে আছে।
২. শাহ এ এম এস কিবরিয়া এমপি: ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক জনসভা শেষে ফেরার পথে হত্যার শিকার হন তিনি। এ হামলায় কিবরিয়াসহ আরও পাঁচজন নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের পর ১৯ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো এই মামলার বিচার শেষ হয়নি।
৩. মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন এমপি: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থ দফায় সরকার গঠনের দ্বিতীয় দফায় ১৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা (মাস্টারপাড়া) গ্রামে নিজ বাড়িতে খুন হন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় নির্বাচিত এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। সেই হত্যাকাণ্ডের দুই বছর ১১ মাসের মাথায় (২০১৯) জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আব্দুল কাদের খানসহ সাত আসামির সবার ফাঁসির রায় দেন আদালত।
৪. আনোয়ারুল আজীম আনার এমপি: চলতি বছর ৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত ২২ মে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা শিকার হয়েছেন মর্মে তথ্য প্রকাশ করে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইডি)। তবে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তার ‘লাশের’ সন্ধান পাওয়া যায়নি। মৃতদেহ ও হত্যার রহস্য উন্মোচনে তদন্ত করছে ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দারা।
এদিকে আনোয়ারুল আজীম আনারের মৃত্যুর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ঝিনাইদহ-৪ আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারছে না জাতীয় সংসদ সচিবালয়। যদিও হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশের দিনই (২২ মে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না করলে জাতীয় সংসদ আনারের আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারছে না। তবে সংসদের বাজেট অধিবেশনের আগেই বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আগামী ৫ জুন বাজেট অধিবেশন শুরুর দিন কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হবে। সেখানে ঝিনাইদহ-৪ আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ সূত্র : ঢাকা টাইমস