নিউইয়র্ক ০৭:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

৪৮ ঘণ্টা কি গড়াবে ৪৮ বছরে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:০৪:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • / ৪৮ বার পঠিত

‘তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। আসলে ওই ৪৮ ঘণ্টাতেই রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে। সেখান থেকেই ঘুরে গেছে তদন্তের গতিপথ। এখন শুধু টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ চলছে। ১২ বছর হলো তদন্ত শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। এমন আরও কত ১২ বছর যে আসবে-যাবে, কে জানে।’ হতাশার সুরে বলছিলেন সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির।

প্রিয় সন্তান ও পুত্রবধূ মেহেরুন রুনি হত্যারহস্যের জট খোলার অপেক্ষা করতে করতে তিনি ক্লান্ত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি। আর তো কিছু করার নেই। কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী বললেন, ৫০ বছর লাগবে। উনি কীভাবে এ কথা বলতে পারলেন? আর সত্যিই এত সময় লাগলে তো আমি শেষটা দেখে যেতে পারব না। সরকার আন্তরিক হলে অনেক আগেই তদন্ত শেষ হতো।’

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়ার অপেক্ষায় স্বজন ও সহকর্মীদের এক যুগ কাটলেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এরই মধ্যে ১০৭ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। এ প্রসঙ্গে ১ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সঠিকভাবে দোষী নির্ণয় করতে যতদিন সময় লাগে, তাদের (তদন্ত সংস্থাকে) ততটুকু সময় দিতে হবে। সেটা যদি ৫০ বছর হয়, ৫০ বছর দিতে হবে।

মন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, তিনি (আইনমন্ত্রী) হয়তো আক্ষরিক অর্থে ৫০ বছরের কথা বোঝাতে চাননি। বলতে চেয়েছেন, বিলম্বে হলেও বিচার হবে। এতে আমরা আশ্বস্ত হই। তবে আইনজ্ঞরা বলেন, বিলম্বিত বিচার আসলে বিচারহীনতার নামান্তর। অনেক পরে বিচার হলে তখন হয়তো সাগরের মা বেঁচে থাকবেন না, আমরা থাকব না। দ্রুত বিচার হওয়া জরুরি। ইতোমধ্যে দীর্ঘ সময় গড়িয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা রেখেই বলি, তদন্ত সংস্থাকে বারবার সময় দেওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে অস্বস্তির। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না– এমন তথ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। নতুন তথ্য প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি খুব ভালো করে জানেন। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি নিশ্চয়ই সাংবাদিক হত্যার বিচার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এতদিনেও তদন্ত শেষ না হওয়া দুঃখজনক। আমরা সাগর-রুনিসহ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছিলাম। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা কোনো ক্লু পাচ্ছেন না। বিদেশে আলামত পরীক্ষা করানো হয়েছে, তবে লাভ হয়নি। পরিস্থিতিটা এমন, সহ্য করা যাচ্ছে না, তবু অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্লু না থাকলেও বিকল্প উপায়ে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. উমর ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলের আলামত বা ফরেনসিক পরীক্ষায় কিছু না পেলেও অপরাধী শনাক্ত করা যায়। ‘ইনভেস্টিগেটিভ সাইকোলজি’ বলে একটা বিষয় আছে; যেখানে অপরাধীর মনস্তত্ত্বকে তদন্তের আওতায় আনা হয়। উন্নত দেশে এভাবেও অপরাধী শনাক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তের গতিপথ দেখে ধারণা করা যায়, এ ঘটনায় জড়িতরা শক্তিশালী। সে ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া এটি এখন রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার আন্তরিক না হলে কিছুই সম্ভব না। আদালত জনস্বার্থে রুল দিয়ে তদন্তের সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন। তাতে তদন্তে গতি আসতে পারে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র সন্তান মিহির সরওয়ার মেঘ। তখন তার বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। এখন এ-লেভেলে পড়ছে। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে এবং বিপিএলে দুর্দান্ত ঢাকার জার্সি ডিজাইন করে সুনাম কুড়িয়েছে।

‘বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ’
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও ছেলে ও পুত্রবধূকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। প্রতিটি দিন তাঁর মনের কোণে ভেসে ওঠে প্রিয় দুটি মুখ। তিনি বলেন, খুনি কি রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী? তা না হলে এতদিনেও কেন তদন্ত শেষ হচ্ছে না? আমার নাতি মেঘ কি তার মা-বাবা হত্যার বিচার পাবে না? তদন্ত নিয়ে এত নাটক কেন? কাকে বাঁচাতে চায় তারা? নিশ্চয়ই এর সঙ্গে কোনো রাঘববোয়াল জড়িত।

মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, সরকারের কোনো ইচ্ছা নেই তদন্ত শেষ করার। এক যুগেও তদন্তে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। এমন নয় যে কোনো ক্লু ছিল না। ডিএনএ পরীক্ষা, ফোনের কলরেকর্ড দিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব ছিল। হয়তো সরকার-সংশ্লিষ্ট বা প্রভাবশালী কেউ এ ঘটনায় জড়িত, তাকে আড়াল করতেই তদন্তের এই হাল। অথবা তদন্ত সংস্থার দক্ষতা-সক্ষমতার অভাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তর করুক। বছরের পর বছর এভাবে চলতে পারে না। সব মিলিয়ে মনে হয়, এটা বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ ছিল।

সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই জানা যায়নি: র‍্যাব
র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতে ও জড়িতদের শনাক্ত করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে র‍্যাব। তবে এখনও তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই জানা যায়নি। আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষাসহ অন্যান্য উপায়েও কিছু মেলেনি। তাই প্রথাগত নিয়মে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি কোনো সূত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়, তবে সে অনুযায়ী এগোবে তদন্ত। র‍্যাব তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আলামত, তথ্য-প্রমাণ অনেক কিছুই মেলেনি। তখন সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহার কম থাকায় কোনো ফুটেজও পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড় ও সাগরের হাত-পা বাঁধা কাপড় ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। হত্যায় সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তির ডিএনএ নমুনাও বিদেশি ল্যাবে পাঠানো হয়। এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন তদন্ত সংস্থার হাতে এসেছে। তবে তা দিয়ে আসামি শনাক্তের জন্য কার্যকর ক্লু মেলেনি।

তদন্তের গতিপথ
সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় মামলা হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায়। চার দিনের মাথায় তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৬২ দিন পর সংস্থাটি তদন্তে ব্যর্থতা স্বীকার করলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র‍্যাবে স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনর্ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে তোলা হয় দু’জনের লাশ। তখন ভিসেরা আলামতসহ আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই র‍্যাব বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুণ, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। এ ছাড়া ওই মামলায় বিভিন্ন সময়ে রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর দু’দিন পর তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তবে আজও সেই অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। সূত্র : সমকাল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

৪৮ ঘণ্টা কি গড়াবে ৪৮ বছরে

প্রকাশের সময় : ১১:০৪:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

‘তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। আসলে ওই ৪৮ ঘণ্টাতেই রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে। সেখান থেকেই ঘুরে গেছে তদন্তের গতিপথ। এখন শুধু টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ চলছে। ১২ বছর হলো তদন্ত শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। এমন আরও কত ১২ বছর যে আসবে-যাবে, কে জানে।’ হতাশার সুরে বলছিলেন সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির।

প্রিয় সন্তান ও পুত্রবধূ মেহেরুন রুনি হত্যারহস্যের জট খোলার অপেক্ষা করতে করতে তিনি ক্লান্ত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি। আর তো কিছু করার নেই। কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী বললেন, ৫০ বছর লাগবে। উনি কীভাবে এ কথা বলতে পারলেন? আর সত্যিই এত সময় লাগলে তো আমি শেষটা দেখে যেতে পারব না। সরকার আন্তরিক হলে অনেক আগেই তদন্ত শেষ হতো।’

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়ার অপেক্ষায় স্বজন ও সহকর্মীদের এক যুগ কাটলেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এরই মধ্যে ১০৭ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। এ প্রসঙ্গে ১ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সঠিকভাবে দোষী নির্ণয় করতে যতদিন সময় লাগে, তাদের (তদন্ত সংস্থাকে) ততটুকু সময় দিতে হবে। সেটা যদি ৫০ বছর হয়, ৫০ বছর দিতে হবে।

মন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, তিনি (আইনমন্ত্রী) হয়তো আক্ষরিক অর্থে ৫০ বছরের কথা বোঝাতে চাননি। বলতে চেয়েছেন, বিলম্বে হলেও বিচার হবে। এতে আমরা আশ্বস্ত হই। তবে আইনজ্ঞরা বলেন, বিলম্বিত বিচার আসলে বিচারহীনতার নামান্তর। অনেক পরে বিচার হলে তখন হয়তো সাগরের মা বেঁচে থাকবেন না, আমরা থাকব না। দ্রুত বিচার হওয়া জরুরি। ইতোমধ্যে দীর্ঘ সময় গড়িয়েছে। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা রেখেই বলি, তদন্ত সংস্থাকে বারবার সময় দেওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে অস্বস্তির। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না– এমন তথ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। নতুন তথ্য প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি খুব ভালো করে জানেন। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি নিশ্চয়ই সাংবাদিক হত্যার বিচার হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এতদিনেও তদন্ত শেষ না হওয়া দুঃখজনক। আমরা সাগর-রুনিসহ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছিলাম। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা কোনো ক্লু পাচ্ছেন না। বিদেশে আলামত পরীক্ষা করানো হয়েছে, তবে লাভ হয়নি। পরিস্থিতিটা এমন, সহ্য করা যাচ্ছে না, তবু অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্লু না থাকলেও বিকল্প উপায়ে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. উমর ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলের আলামত বা ফরেনসিক পরীক্ষায় কিছু না পেলেও অপরাধী শনাক্ত করা যায়। ‘ইনভেস্টিগেটিভ সাইকোলজি’ বলে একটা বিষয় আছে; যেখানে অপরাধীর মনস্তত্ত্বকে তদন্তের আওতায় আনা হয়। উন্নত দেশে এভাবেও অপরাধী শনাক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যা মামলা তদন্তের গতিপথ দেখে ধারণা করা যায়, এ ঘটনায় জড়িতরা শক্তিশালী। সে ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া এটি এখন রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার আন্তরিক না হলে কিছুই সম্ভব না। আদালত জনস্বার্থে রুল দিয়ে তদন্তের সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন। তাতে তদন্তে গতি আসতে পারে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র সন্তান মিহির সরওয়ার মেঘ। তখন তার বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। এখন এ-লেভেলে পড়ছে। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে এবং বিপিএলে দুর্দান্ত ঢাকার জার্সি ডিজাইন করে সুনাম কুড়িয়েছে।

‘বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ’
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও ছেলে ও পুত্রবধূকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। প্রতিটি দিন তাঁর মনের কোণে ভেসে ওঠে প্রিয় দুটি মুখ। তিনি বলেন, খুনি কি রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী? তা না হলে এতদিনেও কেন তদন্ত শেষ হচ্ছে না? আমার নাতি মেঘ কি তার মা-বাবা হত্যার বিচার পাবে না? তদন্ত নিয়ে এত নাটক কেন? কাকে বাঁচাতে চায় তারা? নিশ্চয়ই এর সঙ্গে কোনো রাঘববোয়াল জড়িত।

মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, সরকারের কোনো ইচ্ছা নেই তদন্ত শেষ করার। এক যুগেও তদন্তে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। এমন নয় যে কোনো ক্লু ছিল না। ডিএনএ পরীক্ষা, ফোনের কলরেকর্ড দিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব ছিল। হয়তো সরকার-সংশ্লিষ্ট বা প্রভাবশালী কেউ এ ঘটনায় জড়িত, তাকে আড়াল করতেই তদন্তের এই হাল। অথবা তদন্ত সংস্থার দক্ষতা-সক্ষমতার অভাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তর করুক। বছরের পর বছর এভাবে চলতে পারে না। সব মিলিয়ে মনে হয়, এটা বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ ছিল।

সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই জানা যায়নি: র‍্যাব
র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতে ও জড়িতদের শনাক্ত করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে র‍্যাব। তবে এখনও তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই জানা যায়নি। আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষাসহ অন্যান্য উপায়েও কিছু মেলেনি। তাই প্রথাগত নিয়মে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি কোনো সূত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়, তবে সে অনুযায়ী এগোবে তদন্ত। র‍্যাব তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আলামত, তথ্য-প্রমাণ অনেক কিছুই মেলেনি। তখন সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহার কম থাকায় কোনো ফুটেজও পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড় ও সাগরের হাত-পা বাঁধা কাপড় ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। হত্যায় সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তির ডিএনএ নমুনাও বিদেশি ল্যাবে পাঠানো হয়। এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন তদন্ত সংস্থার হাতে এসেছে। তবে তা দিয়ে আসামি শনাক্তের জন্য কার্যকর ক্লু মেলেনি।

তদন্তের গতিপথ
সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় মামলা হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায়। চার দিনের মাথায় তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৬২ দিন পর সংস্থাটি তদন্তে ব্যর্থতা স্বীকার করলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র‍্যাবে স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনর্ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে তোলা হয় দু’জনের লাশ। তখন ভিসেরা আলামতসহ আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই র‍্যাব বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুণ, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। এ ছাড়া ওই মামলায় বিভিন্ন সময়ে রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর দু’দিন পর তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তবে আজও সেই অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। সূত্র : সমকাল।