৪১ ভাষা সংরক্ষণে জরিপ, বিপন্ন তালিকায় ১৪

- প্রকাশের সময় : ১২:১৪:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
- / ৪৪ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : পৃথিবী থেকে অনেক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে। জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতি ১৪ দিনে বিশ্বে একটি ভাষার মৃত্যু ঘটছে। বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ভাষার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ ভাষা বিপন্নের তালিকায় রয়েছে।এ তালিকায় বাংলাদেশেরও ২৯টি ভাষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশে ইউনেস্কোর বিপন্ন তালিকায় থাকা কয়েকটি ভাষার অবস্থা এতই শোচনীয় যে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৬ থেকে ১২ জন প্রবীণ শুধু ওই ভাষাগুলোতে কথা বলে থাকেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালের সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে বাংলাসহ ৪১টি ভাষা টিকে আছে। এর মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্নপ্রায়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ দেশীয় ৪১টি ভাষার ডিজিটাল ভার্সন এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নিজ ভাষায় ছয়টি কি-বোর্ড ও ফন্ট ব্যবহারের জন্য পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে এই কি-বোর্ড ও ভাষার ডিজিটাল ভার্সন উন্মুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে গৃহীত ‘গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ’ প্রকল্পের আওতায় ভাষা সংরক্ষণের এই কার্যক্রম চলছে। ২০২২ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ দেশীয় ভাষা সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষাসহ দেশের সব ভাষা সংরক্ষণে ভাষাবিষয়ক ডিজিটাল রিসোর্স রিপোজিটোরি (তথ্যভান্ডার) তৈরি করা হয়েছে। এই তথ্য ভান্ডারে বাংলাদেশের ৪১টি ভাষার সংক্ষিপ্ত নমুনা সংরক্ষিত থাকবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণের জন্য এখনও পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে রাজশাহী, দিনাজপুর, রাঙামাটি ও বান্দরবান জোনে (অঞ্চল) জরিপের মাধ্যমে ২৬টি ভাষার ১৩০ জন বিভিন্ন ভাষাভাষীর ৭ হাজার ৮০০ মিনিট কথা ডিজিটাল আর্কাইভ করা হয়েছে। বর্তমানে শ্রীমঙ্গল জোনে জরিপ চলছে। সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জোনে জরিপের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রম শেষ হবে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মাহবুব করিম সমকালকে বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বিপন্ন ভাষাগুলোর ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ের পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক ভাষাভাষী মানুষ কি-বোর্ডে নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল জগতে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারবেন। এই কার্যক্রম সম্পন্ন হলে বাংলাসহ দেশের সংস্কৃতিতে সব ভাষাই বহমান থাকবে।
আরোও পড়ুন। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ভাষা কী আধিপত্যের শিকার?
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, মাতৃভাষা ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ভাষা বেঁচে থাকে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ব্যবহার যদি না হয়, তাহলে তা শুধু ডিজিটাইল আর্কাইভে থেকে যাবে। তাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে অবশ্যই তাদের মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে, তৈরি করে দিতে হবে। নয়তো মাতৃভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ সফল হবে না। তিনি আরও বলেন, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইংরেজির আগ্রাসন চলছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, চাকরিপ্রার্থীসহ সংশ্নিষ্টরা ইংরেজি বা বাংলাভাষা কোনোটিই ভালোভাবে জানেন না। তবুও তাঁরা কর্মে আছেন। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ম্যানেজ করেই চলছি। তাঁর মতে, এই ম্যানেজ কালচারই সর্বত্র বাংলাসহ মাতৃভাষাকে গ্রাস করছে। বাংলাদেশ বহু ভাষা, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সুবিদিত। সাংবিধানিক রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির পাশাপাশি এই ভূখে আরও অর্ধশত ভাষা ও ভাষাজাতি রয়েছে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা অধিকাংশই বিপন্নপ্রায়। গবেষকরা বলছেন, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় অপরাপর ভাষাগুলোরও সংরক্ষণ ও বিশ্নেষণ প্রয়োজন।
সর্বশেষ নৃতাত্ত্বিক এবং প্রকল্প সংশ্নিষ্ট জরিপের তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশের ১৪টি ভাষা বিপন্নপ্রায়। সেগুলো হলো- কন্দ, খারিয়া, কোডা, সাওরিয়া, মুন্ডা, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং। এগুলোর মধ্যে রেংমিটচার মতো এমন ভাষাও আছে, যার মাত্র ছয়জন ব্যবহারকারী বেঁচে আছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই ভাষা বিভিন্ন কারণে আবেদন ও উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। বাকি সব ভাষার কোনোটার ব্যবহার সম্প্রদায় পর্যায়ে এবং কোনোটা পারিবারিক পর্যায়ে ব্যবহূত হচ্ছে। এদের মধ্যে ২৬টি ভাষা বিভিন্ন লিপিতে লেখা হয়। সেগুলো হচ্ছে- আবেং, আত্তং, মিগাম, বম, লুসাই, পাংখোয়া, খিয়াং, খুমি, ককবরক, ম্রো, মারমা, রাখাইন, চাক, বিষুষ্ণপ্রিয়া মণিপুরি, মৈতৈ মণিপুরি, হাজং, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, সাদরি, উর্দু, মাহালি, কোল, কোডা, খাসিয়া ও লিংগাম। লিখিত রূপ থাকা ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে চারটি- হাজং, সাদরি, কোডা ও বিষুষ্ণপ্রিয়া মণিপুরি। আটটি ভাষা নিজস্ব লিপি ব্যবহার করে- মৈতৈ মণিপুরি, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, রাখাইন, উর্দু ও ম্রো। ১৪টি ভাষা রোমান লিপি ব্যবহার করে। সেগুলো হলো- বম, কোল, ককবরক, খাসিয়া, গারো, লুসাই, মাহালি, পাংখোয়া, আবেং, আত্তং, মিগাম, কোচ, খিয়াং ও খুমি।
আরোও পড়ুন। বিকৃতির ঝুঁকিতে বাংলা ভাষা
তথ্য অনুযায়ী ২৬টি ভাষার লিখিত রূপ আছে, অর্থাৎ ১৪টি ভাষা এখনও লিখিত রূপহীন মৌখিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। এই ভাষাগুলো যেমন বিপন্নতার ঝুঁকিতে রয়েছে, একই সঙ্গে লিখিতরূপ থাকা চাক, কোডা, কোল ও পাংখোয়ার মতো কিছু ভাষাও হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতার মুখে আছে। এই নিরিখে লিখিত ও অলিখিত সব ভাষাকে সঠিক উপায়ে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা না হলে অন্তর অগাসীয়ত ভাষাগুলো হারিয়ে যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর ইমতিয়াজ বলেন, ভাষার দুটি দিক রয়েছে- স্থানগত ও কালগত। সময়ের বিবর্তনে সারাবিশ্বেই প্রচলিত ভাষাগুলোর কাছে স্বল্পসংখ্যক মানুষের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সবশেষ নৃতাত্ত্বিক জরিপে এসেছে, দেশীয় ১৪টি ভাষা বিপন্নপ্রায়। এসব ভাষায় কমবেশি তিন হাজার মানুষ কথা বলে থাকেন। এর কারণ তাঁদের সন্তানরা প্রয়োজনের তাগিদেই বাংলা ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষাগুলোর অধিকাংশের লিপি লিখিত নয়। এ জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এটি হলে ভাষা সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং গবেষকরা দীর্ঘ মেয়াদে জানার সুযোগ পাবেন।
ডিজিটাইজেশনের সুফল : প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশীয় ৪১টি ভাষা ডিজিটাল তথ্যভান্ডারের আওতায় সংরক্ষণ হলে সংশ্নিষ্ট ভাষা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী গবেষকরা তাঁদের গবেষণার উপাদান ও তথ্য পাবেন। এ থেকে সংশ্নিষ্ট ভাষাভাষী মানুষ তাঁদের ভাষা সংরক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ভাষা পুনরুজ্জীবনের উপায় বের করবেন। বিপন্ন ভাষাগুলো তখন প্রযুক্তিতে ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠার রূপরেখা পাবে। শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সরকার সংশ্নিষ্ট ভাষাগুলোতে পারদর্শী মানবসম্পদের যে ঘাটতি অনুভব করছে- এ সমস্যা সমাধানেও তা ভূমিকা রাখবে। ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে মুদ্রণ মাধ্যমের পাশাপাশি ওয়েবে ব্যবহার প্রচলনের জন্য আপডেটেড অপারেটিং সিস্টেমে কার্যকর ফন্ট ও কি-বোর্ড ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া নৃতাত্ত্বিক ভাষাভাষীরা কি-বোর্ডে নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল জগতে নিজেদের উপস্থিতি এবং এর মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। সূত্র : সমকাল
সুমি/হককথা