নিউইয়র্ক ০২:৩৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

স্বপ্ন ছুঁয়েছে বাংলাদেশ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:৪৫:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ৮৫ বার পঠিত

ঢাকা ডেস্ক: অবশেষে স্বপ্ন ছুঁয়েছে দেশ। সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বহুকাংখিত গর্বের পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো দৃশ্যমান হলো। সংযুক্ত হলো পদ্মার এপার-ওপার, জুড়ে গেল মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা। দেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল পদ্মার পাড়ে, তা পূর্ণ অবয়ব পেল বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর)। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ মিটার প্রশস্ত দ্বিতল এই বহুমুখী সেতুর কাঠামো কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। উল্লেখ্য, পদ্ম সেতু চালু করার জন্য এর আগে সর্বশেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২১ সালের জুন। কিন্তু করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সেই সময় ১০ মাস বাড়ল।
তবে এ ব্যাপারে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি, যাতে এই সময় এগিয়ে আনা যায়। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালের মধ্যেই সেতুটি চালু করতে চাই।’ অন্যদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হবে।
পূর্ণ অবয়বে সেতু: সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে দুপুর ১২টা ২ মিনিটে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১তম ও শেষ স্প্যানটি। ৪০তম স্প্যান বসানোর ছয় দিনের মাথায় বসানো হলো এই স্প্যান। এতে সেতুটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হলো। এরপর সড়ক ও রেলের সø্যাব বসানো সম্পন্ন হলে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। গেল দুই মাসে সেতুতে আটটি স্প্যান বসিয়ে রেকর্ড গড়েছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা। এ মাসেও দুটি স্প্যান স্থাপন করার মাধ্যমে বিজয়ের মাসে স্প্যান বসানোর কাজটি সম্পন্ন হলো। সমসাময়িক বিশ্বে কোনো নদীতে নির্মিত সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। কংক্রিট কাঠামোর খুঁটি ও ইস্পাতের স্প্যানের এই সেতু এতই শক্তিশালী যে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। চালু হলে এটিই হবে দেশের দীর্ঘতম সেতু। এর আগে দেশের দীর্ঘতম সেতু ছিল যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে শত বাধা অতিক্রম করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। তিনি বলেন, একজন মানবিক ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরাও পারি।
সর্বশেষ স্প্যান স্থাপন উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে বিশেষ উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। ইতিহাসের অংশ হওয়ার জন্য অনেকেই যান পদ্মায়। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করছে বেশি। কারণ এই সেতু চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষসহ গোটা দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় যুগান্তকারী অধ্যায় রচিত হবে। জাতীয় অর্থনীতির চাকায় গতি বাড়বে। সর্বশেষ স্প্যান বসানো উপলক্ষ্যে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে টানানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের জাতীয় পতাকা। পাশাপাশি ব্যানারে বাংলা, ইংরেজি ও চীনা ভাষায় লেখা ছিল, ‘বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রমশক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে। সেতুর ৪১টি ইস্পাতের তৈরি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখবে।’ এদিকে গতকাল পদ্মা সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড।
যেভাবে বসল শেষ স্প্যান: গত বুধবার (৯ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ‘তিয়ান-ই’ নামের ভাসমান ক্রেনটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের স্প্যানটিকে বহন করে রওনা দেয়। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে পৌঁছায় স্প্যান বহনকারী ক্রেনটি। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে পজিশনিং করে মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ২-এফ নম্বর স্প্যানটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় এবং কাজ শেষ হয় ১২টার দিকে। নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিআইডবিøউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক, বিআইডবিøউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন প্রকল্প কর্মকর্তরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী সূত্র জানায়, স্প্যানটি বসানোর জন্য ধাপগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় প্রকৌশলীদের বেগ পেতে হয়নি। কোনো রকম বাধা ছাড়াই স্প্যানটি বসাতে পেরে খুশি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। কারণ আমাজান নদীর পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা ও প্রমত্তা নদী পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা পিলারে বসানো হয় স্প্যানগুলো।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুর কাদের জানিয়েছেন, এর আগে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি স্প্যান বসানো হয়েছে আর মাওয়া প্রান্তে বসানো হয়েছে ১৯টি। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে। আর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হলো মাওয়া প্রান্তে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী জানান, সেতুতে ১৫ টন ওজনের ৯৮ হাজার ৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতাসম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে, যা উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক। পুরো সেতুতে পাঁচ ধরনের ৯৬টি বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে, যার মধ্যে ৩৫টি স্প্যানের সঙ্গে দুটি করে বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। আর সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টে চারটি করে বেয়ারিং ব্যবহূত হচ্ছে। সেতুতে মোট সাতটি জয়েন্ট থাকছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের এই মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু। ২০১৪ সালের ১৭ জুন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে নির্মাণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। পরের বছর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেতু নির্মাণ শুরুর প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বসে প্রথম স্প্যান। এসব স্প্যান চীনে তৈরি করে জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এরপর একে একে বসতে থাকে সেতুর মূল কাঠামো এই স্প্যানগুলো। দৃশ্যমান হতে থাকে সেতু। প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
ভোগান্তির অবসান হচ্ছে: ঘন কুয়াশা, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা নাব্য-সংকটÑএর কোনো একটি হলেই ফেরি, লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান বন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রায়াই ফেরি দিয়ে পদ্মা পারাপারের অপেক্ষায় ঘাটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফেরির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘাটে রোগীর মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। পদ্মা সেতু চালুর পর এমন চরম ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার জনগণ।
সেতুতে যা যা থাকছে: ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতুর সঙ্গে ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার সংযোগ সেতুসহ পদ্মা সেতু হচ্ছে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। সংযোগ সেতুর মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুতে সিসি ক্যামেরা থাকছে। সেতু দিয়ে প্রতিদিন ১২ হাজার যান পারাপার হবে। ২০৩০ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার গাড়ি চলাচলের টার্গেট রয়েছে। শুরুর দিকে প্রতিদিন টোল আদায় হবে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। আর অতিরিক্ত মাল পরিবহন ঠেকাতে সেতুর দুই প্রান্তে দুই পাড়েই ওয়ে ব্রিজ বসানো হচ্ছে। সেতুর দুই পাড়ে সংযোগ সড়কের মধ্যে জাজিরা প্রান্তে সাড়ে ১০ কিলোমিটার এবং মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার।
কাজ শেষ হলো ‘তিয়ান-ই’র: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেন হিসেবে খ্যাত ‘তিয়ান-ই’র কাজ শেষ হলো পদ্মা সেতুতে। কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে কাঙ্ক্ষিত পিলারের কাছে স্প্যান বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং পিলারে স্প্যান ওঠানোর কাজ করত ৩ হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার এই ক্রেন। সেতুর উপসহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর জানান, তিয়ান-ই একটি কম্পিউটার অপারেটেড ভাসমান ক্রেন। প্রায় ২০ বছর আগে নির্মিত ‘তিয়ান-ই’র ভাড়াসহ ব্যবস্থাপনা খরচ ছিল প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকা। চীন থেকে প্রায় দেড় মাস সময় নিয়ে জলপথে এটিকে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। এখন যে কোনো দিন এটিকে চীনে ফেরত পাঠানো হবে।
‘আমরা পারি’: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে বাংলাদেশ যে নিজেই কিছু করে দেখাতে পারে, পদ্মা সেতু তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়েছে, আমরা পারি। বাংলাদেশের পক্ষে এখন সব অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। গতকাল দুপুরে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন।
নদীর নামেই হবে ‘পদ্মা সেতু’: কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নেতার নামে নয়, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর নামকরণ করা হবে পদ্মা নদীর নামেই। এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগেই জানিয়েছিলেন, পদ্মা সেতুর নাম নদীর নাম অনুসারে ‘পদ্মা সেতু’ থাকছে। (দৈনিক ইত্তেফাক)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

স্বপ্ন ছুঁয়েছে বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ১২:৪৫:২৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

ঢাকা ডেস্ক: অবশেষে স্বপ্ন ছুঁয়েছে দেশ। সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বহুকাংখিত গর্বের পদ্মা সেতুর পুরো কাঠামো দৃশ্যমান হলো। সংযুক্ত হলো পদ্মার এপার-ওপার, জুড়ে গেল মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা। দেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল পদ্মার পাড়ে, তা পূর্ণ অবয়ব পেল বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর)। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ মিটার প্রশস্ত দ্বিতল এই বহুমুখী সেতুর কাঠামো কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। উল্লেখ্য, পদ্ম সেতু চালু করার জন্য এর আগে সর্বশেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২১ সালের জুন। কিন্তু করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সেই সময় ১০ মাস বাড়ল।
তবে এ ব্যাপারে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি, যাতে এই সময় এগিয়ে আনা যায়। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালের মধ্যেই সেতুটি চালু করতে চাই।’ অন্যদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হবে।
পূর্ণ অবয়বে সেতু: সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে দুপুর ১২টা ২ মিনিটে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১তম ও শেষ স্প্যানটি। ৪০তম স্প্যান বসানোর ছয় দিনের মাথায় বসানো হলো এই স্প্যান। এতে সেতুটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হলো। এরপর সড়ক ও রেলের সø্যাব বসানো সম্পন্ন হলে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। গেল দুই মাসে সেতুতে আটটি স্প্যান বসিয়ে রেকর্ড গড়েছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা। এ মাসেও দুটি স্প্যান স্থাপন করার মাধ্যমে বিজয়ের মাসে স্প্যান বসানোর কাজটি সম্পন্ন হলো। সমসাময়িক বিশ্বে কোনো নদীতে নির্মিত সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। কংক্রিট কাঠামোর খুঁটি ও ইস্পাতের স্প্যানের এই সেতু এতই শক্তিশালী যে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। চালু হলে এটিই হবে দেশের দীর্ঘতম সেতু। এর আগে দেশের দীর্ঘতম সেতু ছিল যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে শত বাধা অতিক্রম করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। তিনি বলেন, একজন মানবিক ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরাও পারি।
সর্বশেষ স্প্যান স্থাপন উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে দর্শনার্থীদের মধ্যে বিশেষ উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। ইতিহাসের অংশ হওয়ার জন্য অনেকেই যান পদ্মায়। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করছে বেশি। কারণ এই সেতু চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষসহ গোটা দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় যুগান্তকারী অধ্যায় রচিত হবে। জাতীয় অর্থনীতির চাকায় গতি বাড়বে। সর্বশেষ স্প্যান বসানো উপলক্ষ্যে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে টানানো হয় বাংলাদেশ ও চীনের জাতীয় পতাকা। পাশাপাশি ব্যানারে বাংলা, ইংরেজি ও চীনা ভাষায় লেখা ছিল, ‘বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রমশক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথে। সেতুর ৪১টি ইস্পাতের তৈরি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখবে।’ এদিকে গতকাল পদ্মা সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড।
যেভাবে বসল শেষ স্প্যান: গত বুধবার (৯ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ‘তিয়ান-ই’ নামের ভাসমান ক্রেনটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের স্প্যানটিকে বহন করে রওনা দেয়। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে পৌঁছায় স্প্যান বহনকারী ক্রেনটি। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে পজিশনিং করে মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ২-এফ নম্বর স্প্যানটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় এবং কাজ শেষ হয় ১২টার দিকে। নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিআইডবিøউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক, বিআইডবিøউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন প্রকল্প কর্মকর্তরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী সূত্র জানায়, স্প্যানটি বসানোর জন্য ধাপগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় প্রকৌশলীদের বেগ পেতে হয়নি। কোনো রকম বাধা ছাড়াই স্প্যানটি বসাতে পেরে খুশি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। কারণ আমাজান নদীর পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা ও প্রমত্তা নদী পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা পিলারে বসানো হয় স্প্যানগুলো।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুর কাদের জানিয়েছেন, এর আগে ৪১টি স্প্যানের মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি স্প্যান বসানো হয়েছে আর মাওয়া প্রান্তে বসানো হয়েছে ১৯টি। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে। আর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হলো মাওয়া প্রান্তে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী জানান, সেতুতে ১৫ টন ওজনের ৯৮ হাজার ৭২৫ কিলো নিউটন ক্ষমতাসম্পন্ন ফিকশন প্যান্ডিলাম বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে, যা উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক। পুরো সেতুতে পাঁচ ধরনের ৯৬টি বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে, যার মধ্যে ৩৫টি স্প্যানের সঙ্গে দুটি করে বেয়ারিং ব্যবহার করা হচ্ছে। আর সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টে চারটি করে বেয়ারিং ব্যবহূত হচ্ছে। সেতুতে মোট সাতটি জয়েন্ট থাকছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের এই মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু। ২০১৪ সালের ১৭ জুন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে নির্মাণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। পরের বছর ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেতু নির্মাণ শুরুর প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বসে প্রথম স্প্যান। এসব স্প্যান চীনে তৈরি করে জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এরপর একে একে বসতে থাকে সেতুর মূল কাঠামো এই স্প্যানগুলো। দৃশ্যমান হতে থাকে সেতু। প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
ভোগান্তির অবসান হচ্ছে: ঘন কুয়াশা, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা নাব্য-সংকটÑএর কোনো একটি হলেই ফেরি, লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান বন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রায়াই ফেরি দিয়ে পদ্মা পারাপারের অপেক্ষায় ঘাটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফেরির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘাটে রোগীর মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। পদ্মা সেতু চালুর পর এমন চরম ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার জনগণ।
সেতুতে যা যা থাকছে: ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতুর সঙ্গে ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার সংযোগ সেতুসহ পদ্মা সেতু হচ্ছে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। সংযোগ সেতুর মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুতে সিসি ক্যামেরা থাকছে। সেতু দিয়ে প্রতিদিন ১২ হাজার যান পারাপার হবে। ২০৩০ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার গাড়ি চলাচলের টার্গেট রয়েছে। শুরুর দিকে প্রতিদিন টোল আদায় হবে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। আর অতিরিক্ত মাল পরিবহন ঠেকাতে সেতুর দুই প্রান্তে দুই পাড়েই ওয়ে ব্রিজ বসানো হচ্ছে। সেতুর দুই পাড়ে সংযোগ সড়কের মধ্যে জাজিরা প্রান্তে সাড়ে ১০ কিলোমিটার এবং মাওয়া প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার।
কাজ শেষ হলো ‘তিয়ান-ই’র: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেন হিসেবে খ্যাত ‘তিয়ান-ই’র কাজ শেষ হলো পদ্মা সেতুতে। কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে কাঙ্ক্ষিত পিলারের কাছে স্প্যান বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং পিলারে স্প্যান ওঠানোর কাজ করত ৩ হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার এই ক্রেন। সেতুর উপসহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর জানান, তিয়ান-ই একটি কম্পিউটার অপারেটেড ভাসমান ক্রেন। প্রায় ২০ বছর আগে নির্মিত ‘তিয়ান-ই’র ভাড়াসহ ব্যবস্থাপনা খরচ ছিল প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকা। চীন থেকে প্রায় দেড় মাস সময় নিয়ে জলপথে এটিকে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। এখন যে কোনো দিন এটিকে চীনে ফেরত পাঠানো হবে।
‘আমরা পারি’: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে বাংলাদেশ যে নিজেই কিছু করে দেখাতে পারে, পদ্মা সেতু তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়েছে, আমরা পারি। বাংলাদেশের পক্ষে এখন সব অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। গতকাল দুপুরে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন।
নদীর নামেই হবে ‘পদ্মা সেতু’: কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নেতার নামে নয়, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর নামকরণ করা হবে পদ্মা নদীর নামেই। এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগেই জানিয়েছিলেন, পদ্মা সেতুর নাম নদীর নাম অনুসারে ‘পদ্মা সেতু’ থাকছে। (দৈনিক ইত্তেফাক)