সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : বিদায় সংসদের কবি
- প্রকাশের সময় : ০৪:৫৯:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
- / ১২৬৬ বার পঠিত
ঢাকা: চলে গেলেন রাজনীতির কবি, পার্লামেন্টের কবি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রোববার (৫ ফেব্রুয়ারী) ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজীবন রাজনীতির মাঠে আলো ছড়ানো এ তারকা রাজনীতিকের বিদায়ে শোকে স্তব্ধ রাজনীতির অঙ্গন। মাটি আর মানুষের কাছে থেকে রাজনীতি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব। হাওরের কঠিন-কোমল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা একজন সুরঞ্জিত বর্ণিল রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় উঠেছিলেন রাজনীতির বরপুত্র। নিজস্ব ভাষা, ভঙ্গি আর স্বভাবসুলভ উচ্চারণে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। সংসদে, রাজনৈতিক সভা- সমাবেশে তিনি কথা বলতেন নিজের ভাষায়। কঠিন সত্যের স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি যেমন পেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের ভালোবাসা তেমনি প্রতিপক্ষের বিরাগভাজনও হতে হয়েছে বহুবার। সজ্জন, সদালাপী ব্যক্তি সুরঞ্জিত ছিলেন সব দলমতের মানুষের কাছে সমান প্রিয়। আর ভাটি বাংলার মানুষের কাছে ছিলেন প্রিয় ‘সেন দা’।
শেষ জীবনে এসে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লেও তিনি সত্য উচ্চারণ থেকে পিছপা হননি। যা বাস্তব তা বলেছেন অকপটে। দলের বিপক্ষে যায় এমন কথা উচ্চারণেও কুণ্ঠা করেননি কখনও। ভাটি অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ে আজীবন উচ্চকিত এ রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে হাওরাঞ্চলে। দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ শোকাতুরপ্রিয় এ নেতার মৃত্যুতে। ৭০-এর প্রাদেশিক পরিষদে সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এরপর স্বাধীন দেশের প্রায় সব সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ জীবনে মন্ত্রিত্বের চেয়ারে বসেছিলেন একবারই। তবে হঠাৎই আবির্ভূত বিতর্কে সেই চেয়ার স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। একজন ঝানু রাজনীতিকের মতোই তিনি সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। দায় নিয়ে নিজে থেকে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার নজির স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা সুরঞ্জিত সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু রাজনীতির এ মানুষটি শরীরে দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়েও অংশ নিয়েছেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে।
সার্চ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের হয়ে অংশ নিয়েছিলেন হাসপাতাল থেকে। হাসপাতাল থেকে বঙ্গভবনের ওই বৈঠকে অংশ নেয়ার পর আবার ফিরে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে অংশ নিয়েছিলেন সংসদ অধিবেশনেও। ৩ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার হঠাৎ অসুস্থতাবোধ করায় তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে। শনিবার অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতে নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নেয়ার। কিন্তু সেই চেষ্টার আগেই সবাইকে কাঁদিয়ে রোববার ভোরে চলে যান না ফেরার দেশে। তার মৃত্যু সংবাদে শোকের ছায়া নেমে আসে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
রোববার বিকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় রাজনৈতিক সহকর্মী, দলীয় নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর আগে ঝিগাতলার নিজ বাসা এবং ঢাকেশ্বরী মন্দিরে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মরদেহ রাখা হয়েছিল ল্যাবএইডের হিমঘরে। এদিকে তার মৃত্যুতে রোববার জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিতে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এদিকে এক শোক বার্তায় প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি দেশের প্রথম সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গুররুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশের সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিশাল অবদান জনগণ তাকে স্মরণে রাখবে। এদিকে এক শোক বার্তায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের কথা স্মরণ করে বলেন, তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার মৃত্যুতে দেশ এক নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদকে হারালো আর আওয়ামী লীগ হারালো দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে। শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী ও সুসংহত করতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অবদানের কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলেন, সুরঞ্জিত দেশের প্রথম সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার এই মৃত্যুতে দেশ একজন অভিজ্ঞ সংসদ সদস্যকে হারালো।
এদিকে সিলেটে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর পর তার মরদেহ ৬ ফেব্রুয়ারী সোমবার নিয়ে যাওয়া হবে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। সেখানেই সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিজের হাতে রোপণ করা একটি চন্দন গাছের কাঠে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে।
ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোববার ভোরে ৪টা ২৯ মিনিটে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। গত বছর মে মাসে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালেও চিকিৎসা নেন।
বর্ণাঢ্য জীবন: বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। এরপর স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদসহ চার দশকের প্রায় সব সংসদেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা সর্বশেষ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৬ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদসহ মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর তিনি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি করার পর আইন পেশায় যুক্ত হন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় দুই ভাগ হলে মওলানা ভাসানীর পক্ষ ত্যাগ করে সুরঞ্জিত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশে যোগ দেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে ন্যাপ থেকে বিজয়ী হন। পরে ন্যাপের ভাঙনের পর গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ ও ১৯৯১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন।
পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জ-২ আসনে (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন তিনি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে ২০১১ সালের ২৮শে নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন সুরঞ্জিত। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলন তিনি পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের অন্যতম সদস্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তিনি আবারো আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডক্টরেট। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার শিক্ষা বিভাগে সমন্বয়কারী পদে কাজ করেন। তাদের একমাত্র সন্তান সৌমেন সেনগুপ্ত ব্যবসায়ী। সৌমেনের স্ত্রী রাখী মৈত্রী সেনগুপ্ত পেশায় চিকিৎসক।
সংসদ চত্বরে শেষ শ্রদ্ধা: জাতীয় সংসদ চত্বরে বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা। একইসঙ্গে শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকাল ৩টার দিকে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় তার মরদেহ আনা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের শ্রদ্ধা জানানোর আগে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সুরঞ্জিতের প্রতি জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান। কফিনে প্রথমে ফুল দেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সুরঞ্জিতের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও প্রয়াত এই সংসদ সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ ধ্রুবেষানন্দ মহারাজ এ সময় বিশেষ প্রার্থনা করেন।
শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবনী পড়ে শোনান সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ। পরে সুরঞ্জিতের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমি এখন অভিভাবকহীন। তবে আমি নিজেকে অভিভাবকহীন ভাবছি না। আমাদের পরিবারের সঙ্গে সব সময় প্রধানমন্ত্রী আছেন। সৌমেন বলেন, আমার বাবা সারা জীবন প্রগতিশীল, অসামপ্রদায়িক রাজনীতি করেছেন। সব সময় মানুষের উপকার করেছেন। কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে তার কাছ থেকে খালি ফিরতেন না। জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন। এছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শ্রদ্ধা: বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। রোববার দুপুরে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ আনা হয়। পরে সেখানে নেতৃবৃন্দ ও সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। অন্যান্যের মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মুকুল বোস, ঐক্য ন্যাপের আহ্বায়ক পংকজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জয়ন্ত সেন দীপুর নেতৃত্বে পূজা উদযাপন পরিষদ, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এটিএম সামসুজ্জামান, সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম, বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও ভারতীয় হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার আদশ সাইকি, পলিটিক্যাল সেক্রেটারি রাজেশ উইকি প্রমুখ শ্রদ্ধা জানান।
এছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে সুরঞ্জিত সেনের মরদেহে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চলে যাওয়া রাজনীতিতে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে জানিয়ে আমির হোসেন আমু বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চলে যাওয়া সিলেট তো বটেই সমগ্র রাজনৈতিক অঙ্গনেও শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আইনের বিষয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হলে সবাই তার কাছে যেতেন। তিনি চলে যাওয়ায় তারমতো আস্থাভাজন লোক পেতে হয়তো আমাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফখরুল ইসলাম বলেন, তার মতো অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান নেতা বিরল। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বহুকালের। আমি তাকে মহৎ প্রাণের মানুষ হিসেবে জানতাম। রাজনৈতিক সংকটে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন। মানুষের মাঝে আস্থা তৈরি করতেন। এরকম একজন পার্লামেন্টারি রাজনীতিকের চলে যাওয়ায় আমি শোকাহত ও মর্মাহত।
সুনামগঞ্জে শোকের ছায়া: সুরঞ্জিত সেনের মৃত্যুতে সুনামগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার মৃত্যুর সংবাদে দিরাইয়ে তার নিজ বাসায় ভিড় জমান দলেন নেতাকর্মী সহ সাধারণ মানুষ। জেলা শহর থেকে ছুটে যান জেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, সুরঞ্জিত সেন শুধু এই জেলার মানুষ ছিলেন না। তিনি দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি সব সময় তা প্রমাণ করে গেছেন। সুরঞ্জিত সেন বিকল্প রাজনীতি সুনামগঞ্জে আর কখনও আসবে না। সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট বলেন, দাদা ছিলেন আমাদের রাজনীতির পদপ্রদর্শক। দাদাকে নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। কিন্তু দাদা কখনও এসব পাত্তা দেননি। সব সময় দল ও নিজের এলাকার মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে তার নির্বাচনী এলাকা দিরাই-শাল্লাসহ হাওরাঞ্চলে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে দিরাই-শাল্লার আপামর জনসাধারণ। ভোর থেকেই পৌর শহরের আনোয়ারপুরস্থ তার নিজ বাসভবনে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন ভিড় জমাতে থাকেন। উপজেলা কার্যালয় থেকে তাৎক্ষণিকভাবেই তিনদিনের শোক কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়। সোমবার হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা থেকে সকাল সাড়ে ৯টায় সিলেট শহীদ মিনারে, ১১টায় সুনামগঞ্জ এবং দুপুর ১টায় শাল্লা উপজেলায় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর মরদেহ নিয়ে আসা হবে তার জন্মস্থান দিরাইয়ে। দিরাই বালুর মাঠে দলীয় নেতাকর্মীসহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর বাসভবনের সামনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট সোহেল আহমদ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে গভীর শোক ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন সাবেক চিফ হুইপ, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি মতিউর রহমান, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আইয়ুব বখত জগলু, দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুর রহমান বুলবুল প্রমুখ। (মানবজমিন)