সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন: বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও উৎসাহিত করছে

- প্রকাশের সময় : ০৭:০৮:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ জুন ২০২৩
- / ৫২ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : গত ১৪ জুন সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জ উপজেলার পার্টহাটি এলাকায় কতিপয় সন্ত্রাসীর নৃশংস হামলার শিকার হন এবং একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তাকে রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সাংবাদিক ও পথচারীরা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে রাতেই জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। ভিকটিম নাদিমের অবস্থার অবনতি হলে ১৫ জুন সকালে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ওই দিন বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাদিম মৃত্যুবরণ করেন।
ওই ঘটনায় ভিকটিমের স্ত্রী বাদী হয়ে মাহমুদুল আলম বাবুকে প্রধান অভিযুক্ত করে বকশীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকা-ের ঘটনা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হয় এবং সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলার একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ জুন র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৪ এর একটি আভিযানিক দল স্থানীয় র্যাবের সহযোগিতায় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সাংবাদিক নাদিম হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মৃত সাহেদুল হকের ছেলে মাহমুদুল আলম বাবু (৫০), তার সহযোগী মফিজল হকের ছেলে মো. মনিরুজ্জামান মনির (মনিরুল), জালাল উদ্দিনের ছেলে জাকিরুল ইসলাম (৩১), জমি শেখের ছেলে মো. রেজাউল করিমকে (২৬) বকশীগঞ্জ, জামালপুর থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা সাংবাদিক নাদিম হত্যাকা-ের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর পরিকল্পনাতেই এই হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়। সাংবাদিক নাদিম সাম্প্রতিক সময়ে বাবুর অপকর্ম নিয়ে অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাবু ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক নাদিমকে বিভিন্নভাবে হুমকিসহ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে।
ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলেই একশ্রেণির অসৎ দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবান ও তাদের যোগসাজশকারী ব্যক্তি কর্তৃক সাংবাদিকের ওপর হামলা-নির্যাতন, এমনকি হত্যার ঘটনা এখন যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের ওপর সংঘটিত বিভিন্ন হামলা, মামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় দায়িত্বশীলদের খানিকটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
জামালপুরের বকশীগঞ্জের সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে নানা কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন ও নাদিমের সতীর্থরা। হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তারা বলেছেন, সাগর-রুনিসহ বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ায় সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।
তবে চলমান মামলাগুলোর প্রক্রিয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মামলাগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিচারিক জালের মধ্যে আটকে পরেছে। কোনো হত্যাকাণ্ডের যদি ১০-১১ বছর বিচার না হয়, তা হলে এমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিক্ষোভ সমাবেশের কোনো মূল্য নেই। গত ৪০ বছর ধরে সাংবাদিক হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন করেও অগ্রসর হতে পারেননি সাংবাদিক নেতারা। বিষয়টি এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, এ দেশে সবার বিচার হলেও সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারে রাজনৈতিক পরিচয়, প্রভাব-প্রতিপত্তি নানা বিষয়ই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
এই হত্যাকা- প্রমাণ করে, জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধররা নিজেদের দুর্নীতি-অন্যায় লুকিয়ে রাখতে কতটা বেপরোয়া। পাশাপাশি, সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, তারা কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেই বিচারহীনতা ভোগ করবেন বিভিন্ন সময়ে এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
মুক্ত সাংবাদিকতার এই সংকট নিরসনে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তবে এ মুহূর্তে তার দৃষ্টান্ত হিসেবে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক সরাসরি জড়িতদের পাশাপাশি যাদের নির্দেশে, যোগসাজশে ও যাদের স্বার্থ সুরক্ষায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানীকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কোনো আমলেই সাংবাদিক হত্যার বিচার আমরা পাইনি, পাচ্ছি না। সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ১১ বছর শেষ হয়ে গেলেও এর বিচার আমরা পাইনি। খুলনার হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহা, যশোরের শামসুর রহমান কেবল ও বগুড়ার গৌতম দাস প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। বছরের পর বছর এসব হত্যাকা-ের বিচার পাচ্ছেন না তাদের স্বজনেরা। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সক্ষমতা আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তা হলে কেন এই বিচারগুলো আমরা পাচ্ছি না সে প্রশ্ন রয়েই যায়?
ফলে সাংবাদিক নির্যাতন করলে এমনকি হত্যা করলে যেকোনো শাস্তি হয় না, এমন ধারণা একপ্রকার প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেছে। সাগর-রুনি হত্যাকা- থেকে শুরু করে সর্বশেষ জামালপুরে গোলাম রব্বানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এমন ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হওয়া অমূলক নয় যে, গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর রোধে যেকোনো কিছুই করা যায়। যার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরও অপব্যবহার।
কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কেননা সাংবাদিকেরাও আইনের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সৎ সাংবাদিকতার টুঁটি চেপে ধরা, মামলা-হামলা-গ্রেফতার-নির্যাতন অসৎ মানুষদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশাল প্রভাব এবং ক্ষমতাশালী অসৎ মানুষদের ক্রোধ ও আক্রমণের মুখে সবচেয়ে বেশি অসহায় মফস্বল সাংবাদিকেরা। মামলা হলে তা সামলানো কিংবা হামলা হলে বিচার চাওয়া বা মোকাবিলা করা সাধারণ সাংবাদিকদের পক্ষে অসম্ভব। যদি প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে না দাঁড়ায়। বিভক্ত সাংবাদিক সমিতিগুলোও তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের দায় আমাদের সবার।
সাংবাদিকতা মহৎ পেশা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ২৩ সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৫৬১ জন। আরেকটি হিসাবে বলা হচ্ছে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ সাংবাদিক হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন।
নোয়াখালীর সাংবাদিক বুরহান মুজাক্কিরকে হত্যার ঘটনা নিহতদের তালিকায় যোগ হওয়া আরেকটি নতুন সংখ্যা ছিল। এত সাংবাদিক নিহত হলেন, অথচ বিচার শেষ হয়েছে মাত্র আটটির। এই আটটির বিচারিক রায়ের পাঁচটিই ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস। তা হলে ন্যায্য সেভাবে হলো কই?
বিচার না পাওয়া ব্যক্তিদের দলে রয়েছে সাংবাদিক সাগর-রুনির সন্তান মেঘ। রক্ত হিম করা এই যুগল হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার তারিখ ৯ বছরে ৭৭ বারের মতো পিছিয়েছে। গোলাম রব্বানীসহ সব সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলেই কেবল বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। একই সঙ্গে অবিলম্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনসহ নিবর্তনমূলক যত আইন আছে তা বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ২০১৮ সালে জাতিসংঘের ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউয়ের (ইউপিআর) অধীনে বাংলাদেশের তৃতীয় পর্যালোচনার সময় সরকার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সম্পর্কিত যে আটটি সুপারিশ সমর্থন করেছিল, সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।
কেননা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২৩-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছর থেকে এক ধাপ নেমে ১৬৩ তে এসেছে। গত দুই বছরে বাংলাদেশ ১১ ধাপ ও ১৪ বছরে ৪২ ধাপ নিচে নেমেছে। যে বিষয়গুলোর ওপর এই সূচক নির্ধারিত হয়, তার অন্যতম একটি হলো সাংবাদিকের নিরাপত্তা। আর ঠিক সেখানেই বাংলাদেশের স্কোর হতাশাজনকভাবে কম। সূচকের পাশাপাশি প্রায় নিয়মিতভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রমাণ করে মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে কী ধরনের বিব্রতকর অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় আমরা বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সরকার যে স্বাধীন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করে তা প্রমাণের আহ্বান জানাচ্ছি।- সূত্র : সময়ের আলো
নাসরিন /হককথা