সংলাপই দেখাতে পারে সমঝোতার পথ
- প্রকাশের সময় : ০৮:৩৩:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০২৩
- / ৮১ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশ এক অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে। যুদ্ধের মধ্যেও সংলাপ হয়। তাই রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের বিকল্প নেই। একমাত্র সংলাপই সমঝোতার পথ দেখাতে পারে। এ জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে দিতে হবে ছাড়।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ভোটার সচেতনতা ও নাগরিক সক্রিয়তা কার্যক্রম : রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার লক্ষ্যে জাতীয় সংলাপ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিশিষ্টজন এসব কথা বলেন। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের আয়োজনে এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সহযোগিতায় এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে অংশ নিয়ে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. রওনক জাহান বলেন, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের স্থায়ী সমাধান করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। শুধু আইনি কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিলেই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল।
তিনি বলেন, ভোটের সময়ের তিন মাসের জন্য যে রাজনৈতিক দলকে বিশ্বাস করা যায় না, তাদের হাতে পাঁচ বছরের জন্য মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিতে মানুষ কীভাবে বিশ্বাস রাখবে। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের পথে শুধু ক্ষমতাসীন দল নয়, তাদের ব্যবহার করে সারাদেশে গড়ে ওঠা প্রভাবশালী গোষ্ঠী বড় বাধা। নিজেদের স্বার্থেই তারা এ অবস্থার পরিবর্তন ঠেকাতে সোচ্চার রয়েছে।
ড. রওনক জাহান বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে বড় দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায় না। তবে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তাদের বিরোধ নেই। এমপি হয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি কেনার সুযোগ ও নির্বাচনী এলাকার বিশেষ বরাদ্দ– এসব ইস্যুতে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। বিরোধ শুধু ক্ষমতা যাওয়া ও থাকা নিয়ে।
রাজনৈতিক বিরোধের স্থায়ী সমাধানে নির্বাচনে হেরে যাওয়া দলের জানমাল ও সহায়-সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাগত বক্তব্যে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংলাপের বিকল্প হলো সংলাপ। নাগরিকদের মতো আমরাও মনে করি আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি না। তবে আমাদের প্রস্তাবগুলো সম্ভাব্য আলোচনার এজেন্ডা হতে পারে।
সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, নব্বইয়ে প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল, আমরা ভবিষ্যতের সমস্যা আলাপ-আলোচনা করেই সমাধান করব। আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা, সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছেন।
আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক বলেন, বিভিন্ন পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি তোলা হলেও কোন প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, তা কেউ বলতে পারছে না। এর দায় শুধু সরকারি দল ও ক্ষমতাসীন জোটের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। তিনি বলেন, বিএনপি সহিংসতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে আগের থেকে বেশি সংগঠিত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। এটা ইতিবাচক। তাদের আন্দোলনকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু ২০১৩ ও ১৪ সালের জ্বালাও-পোড়াও ভুলে যাইনি।
এক-এগারোর সরকারের আমলে ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে একটি ঐকমত্য দরকার। তবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি করতে হলে দায় নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা হওয়া দরকার। সেটা হবে মাইলফলক। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। বিদেশিদের দালালি বন্ধ করতে হবে। সংলাপ হলে পারস্পরিক আস্থা রাখতে হবে, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা বজায় রাখতে হবে।
বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। যারা সংলাপে বসতে রাজি নন, তারা মূলত সংকট এড়িয়ে যেতে চান। রাজনৈতিক সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। তিনি বলেন, এজন্য কতগুলো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার দরকার। বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মধ্য দিয়ে। এ পদ্ধতির সংস্কার না করে সরকার একতরফাভাবে তা বাতিল করেছে। অথচ সংসদীয় কমিটির সভায় মহাজোটের সব নেতা এ পদ্ধতি বহাল রাখার কথা বলে গেছেন। সরকার নিজের স্বার্থে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করছে। এ প্রবণতাও বন্ধ হওয়া দরকার।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। মান্নার মতে, এখন আর সংলাপের পরিবেশ নেই। তা ছাড়া সংলাপের লক্ষণও নেই। দেশের রিজার্ভ কমে ১৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলছেন, রিজার্ভ কোনো সমস্যা নয়। তাই সংলাপ করে লাভ কী? মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। সরকারি দল আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ নষ্ট করছে। ১৫ বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। তারপরও সংলাপ যদি হতে হয়, তাহলে সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে আমরা ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দেশ আজ দ্বিদলীয় বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গেছে। তাই গণতন্ত্র আর নির্বাচনী ব্যবস্থা শক্তিশালী ও কার্যকর করতে এ ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার দরকার।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সহায়ক নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা থাকলেও কমিশন তা প্রয়োগ করছে না। গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনের পর কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছিল, তা মানা হয়নি। কমিশন চাইলে দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছা থাকা দরকার।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার হচ্ছে। সংবিধান থাকলেও সাংবিধানিকতা নেই, প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। সংবিধানের সংশোধনীগুলো জনগণের কল্যাণে নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, পরিবর্তন দরকার, পরিবর্তন হতেই হবে।
অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পাঁচটি ভিন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং সংঘাতের আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে। সংঘাত এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই। শত্রুর সঙ্গেও সংলাপ হতে পারে। তিনি বলেন, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। তাই যে কোনো উপায়ে একটি নির্বাচন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ চাইলেও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না। কারণ এখানে আরও অনেক স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ রয়েছে। রিজার্ভ কমছে, রেমিট্যান্স কমছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বলেন, মেরুদণ্ডহীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তিনি সারাদেশের ছাত্রসংসদগুলোতে নির্বাচন চালুর দাবি জানান।
আট বিভাগীয় সংলাপে উঠে আসা রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলোচনায় তুলে ধরেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে নাগরিক সমাজের ২৮ প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন।সূত্র : সমকাল