শর্তহীন সংলাপ চেয়ে তিন দলকে যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি

- প্রকাশের সময় : ১১:০০:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৩
- / ৪৭ বার পঠিত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শর্তহীন সংলাপ, সহিংসতা পরিহার এবং শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—বড় এই তিন রাজনৈতিক দলকেই এ বার্তা দিয়েছে ওয়াশিংটন।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইভেলি গতকাল সোমবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানাতে বড় তিন রাজনৈতিক দলের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করেছেন।
পরে পিটার হাস জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর একটি চিঠি হস্তান্তর করেন।
একই চিঠি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেও দেওয়া হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে বার্ষিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য গত শুক্রবার নয়াদিল্লি এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন, পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। ওই বৈঠকে ভারত বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবস্থান জানায় যুক্তরাষ্ট্রকে এবং পরে তা প্রকাশও করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ওই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কী অবস্থান নিয়েছিল তা বাইরে প্রকাশ করেনি।
এ বিষয়ে জানতে প্রথমে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগাযোগও করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের দপ্তর গত রবিবার রাতে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত নীতি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র একান্ত বৈঠক বা অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করে না।’
এর মধ্যেই গতকাল ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানিয়েছে, রাষ্ট্রদূত হাস রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান স্পষ্ট করছেন। পিটার হাস গতকাল বিকেলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে যান।
সেখানে বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু বলেন, পিটার হাস যুক্তরাষ্ট্র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর লেখা একটি চিঠি দিয়ে গেছেন। অন্য দলগুলোকেও তিনি চিঠি দেবেন বলে শুনেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত পর্যায়ক্রমে ওই চিঠি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে পৌঁছে দেবেন। চিঠিগুলোর বার্তা অভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত হাস চারটি বার্তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাচ্ছেন।
এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র একটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার ও সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়। যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানায়। যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র থ্রি সি নীতি (ভিসা নিষেধাজ্ঞা) কার্যকর করতে থাকবে।’
জাতীয় পার্টির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গতকাল বিকেলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঢাকার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ডোনাল্ড লুর একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন পিটার হাস। ওই চিঠিতে অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি প্রস্তুতি নিলেও অংশগ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে তৃণমূলের মতামত ও দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় পার্টি।
চিঠি পেয়েছে বিএনপি
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী গতকাল রাত সোয়া ৮টায় জানান, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি পেয়েছে। চিঠির বিষয়ে এই মুহূর্তে তাদের আর কোনো মন্তব্য নেই।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। দলের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে নেতাকর্মীরা কেউ যাচ্ছেন না।
বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কারাগারে। কমিটির সদস্য শ্যামা ওবায়েদ দলের পক্ষে বিদেশি দূতাবাসে যোগাযোগ করে থাকেন। দলের একটি সূত্র জানায়, তাঁকে ই-মেইলে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে।
আজ প্রতিক্রিয়া জানাবে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ ডোনাল্ড লুর চিঠি পেয়েছে কি না সে বিষয়ে গতরাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বার্তার বিষয়টি তারা অবগত হয়েছে। আজ মঙ্গলবার এ নিয়ে বৈঠক করে তারা প্রতিক্রিয়া জানাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘এখানে আমার কোনো ব্যক্তিগত মন্তব্য নেই। আগামীকাল (আজ) আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এই ইস্যুতে বৈঠক ডাকা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বৈঠকের পর দলের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চিঠির বিপরীতে দলের অবস্থান পরিষ্কার করা হবে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যে যাই বলুক না কেন, সংবিধান ও আইন অনুযায়ীই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংলাপে জোর দিয়েছিল এনডিআই-আইআরআই
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল গত ৮ থেকে ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ সফর করে। এরপর ওই প্রতিনিধিদল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে। তাদের ওই সুপারিশ যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও গত মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তবে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সম্প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার সময় বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করেছিলেন। তিনি বলেন, সংসদীয় রীতিতে সংসদের বিরোধী দলই হলো প্রকৃত বিরোধী দল। এর বাইরের দলগুলোকে বিরোধী দল হিসেবে গণ্য করা হয় না।
সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবে না, বলেছিলেন আজরা জেয়া
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক নিরাপত্তা বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি আজরা জেয়া গত ১৩ জুলাই ঢাকা সফরকালে সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চায়। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবে না।
নতুন করে কেন এই বার্তা
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় চলে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ছাড় না দেওয়ায় সংঘাত ও বড় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া দলগুলোর কেউ কেউ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ক্ষোভ ও অবিশ্বাস থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের কেউ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলোর বিশ্লেষণ হলো—যুক্তরাষ্ট্র এই বার্তার মাধ্যমে স্পষ্ট করতে চেয়েছে, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। বিশেষ কোনো দলকে ক্ষমতায় আনা বা ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন ভাবনা দূর করার জন্যও এই বার্তাটি গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র: কালের কন্ঠ।