‘যতদিন বেছে আছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব’ ॥ সর্বত্রই নিন্দা প্রতিবাদ : হামলায় রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমান
- প্রকাশের সময় : ০৩:০১:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুলাই ২০১৮
- / ৬০৭ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: কুষ্টিয়ায় একটি মানহানির মামলায় জামিন নিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান। হামলায় মাহমুদুরের মাথা ও মুখ জখম হয়েছে। এছাড়া তার বহনকারী গাড়িটিও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তিনি ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে আদালতের বারান্দা থেকে বের হয়ে প্রাইভেট কারে ওঠার পর এ হামলা হয়। এ সময় সেখানে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দীন, আদালতের পরিদর্শক মনির উজজামানসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র টিউলিপ সিদ্দিকীকে নিয়ে কটূক্তি করে বক্তব্যে দেওয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষারের করা মানহানির মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করে আদালত। এদিকে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উপর প্রকাশ্য দিবালোকে আদালত প্রাঙ্গনে হামলার ঘটনায় দেশ ও প্রবাসের বিভিন্ন মহল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক ঘটনার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেছেন।
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, রোববার (২২ জুলাই) বেলা ১২টার দিকে কুষ্টিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের বিচারক এম এম মোর্শেদ ১০ হাজার টাকা জামানতে স্থায়ীভাবে এই জামিন মঞ্জুর করেন। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলাটি করেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষার। ওই মামলায় ওয়ারেন্ট জারি করেছিল আদালত। রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল আদালতে জামিন নিতে যান মাহমুদুর রহমান। আদালতে দাঁড়িয়ে জামিন চাইলে বিচারক জামিন মঞ্জুর করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাহমুদুর রহমান জামিন নিতে যাচ্ছেন- এমন খবরে আগে থেকে আদালত চত্বরে ছাত্রলীগ সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষা ও সাধারণ সম্পাদক সাদ আহমেদের নেতৃত্বে অর্ধশত ছাত্রলীগ কর্মী লাঠি-সোটা হাতে আদালত চত্বরে অবস্থান নেন।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জামিন হলেও হামলার ভয়ে আদালতের এজলাসে অবস্থান নেন মাহমুদুর রহমান। এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সেখানে অবস্থান নেন। পরে পুলিশ মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বললে তিনি বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারে উঠে রওনা হন। গাড়িতে ওঠার পরপরই আচমকা তাঁর ওপর প্রথমে স্যান্ডেল ছুড়ে মারেন ছাত্রলীগের এক কর্মী। এরপর চারদিক থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। এ সময় গাড়ির কাচ ভেঙে কয়েকটি ইট তাঁর মাথায় ও মুখে লাগে। এতে তাঁর গাল, কপাল ও মাথার পেছনে কেটে যায়। হামলার মধ্য থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে গাড়ি থেকে বের করে আইনজীবীরা একটি চেম্বারে নিয়ে যান। এ সময় বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে ওই আইনজীবীর চেম্বারে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের বেশ কয়েকজনের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করলে তাঁদের ওপর চড়াও হন হামলাকারীরা।
পরে রক্তাক্ত অবস্থায় আদালতের বারান্দায় বসে মাহমুদুর হামলার প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, এখানে প্রয়োজনে জীবন দেবো। দেশের জন্য, ইসলামের জন্য জীবন দেবো। আদালতের ভেতর হামলার জন্য পুলিশকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে পুলিশ আমাকে গুন্ডাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর হামলা হয়েছে। এর জন্য একদিন তাদেরও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’ এ সময় সদর থানার ওসি নাসির উদ্দিন তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তাঁকে বলেন, ‘হামলার সময় কোথায় ছিলেন। আপনারা তো আমাকে মার খাওয়ালেন। হাসপাতালেও নিয়ে যাচ্ছেন না। আমার সারা মুখ থেকে রক্ত ঝরছে, আমি যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছি না।’
এর আগে দুপুর ১টার দিকে তিনি সঙ্গীদের সাথে আদালত থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে আদালত ভবনের প্রতিটি প্রবেশ দ্বারে ছাত্রীলীগের নেতা-কর্মীরা আটকে দেয়। এসময় তিনি পুনরায় আদালতের এজলাসে আশ্রয় নেন। দীর্ঘ সময় একই পরিবেশ বিরাজ করায় তিনি আদালতকে বিষয়টি জানান। পরে লিখিতভাবে পুলিশ প্রেটেকশনের জন্য তিনি আবেদন করেন। এসময় আদালতে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী কুষ্টিয়া ব্যারের সিনিয়র আইনজীবি প্রিন্সিপাল আমিরুল ইসলাম, বিএফইউজে (একাংশ) মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমীসহ অনেকে তার সাথে আছেন। পরে তিনি আদালত এলাকা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তার ওপর হামলা চালানো হয়।
তার আগে অবরুদ্ধ মাহমুদুর রহমান বলেন এই অভিজ্ঞতায় মোটেও অবাক হইনি। কারণ দিল্লির প্রতিনিধিত্বকারী বর্তমান দখলদার সরকারের আমলে দেশে এরকমই হওয়ার কথা। বাংলাদেশের জনগণের কোনো অধিকার নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই, এখানে এক ধরনের জঙ্গলের আইন চলছে। যার সর্বোচ্চ প্রমাণ আমরা কুষ্টিয়ায় পেলাম। এরকম দৃশ্য আজ পর্যন্ত কুষ্টিয়ায় কেউ দেখেনি। কারণ, আমার এখানের আইনজীবী যারা আছেন, তারা প্রত্যেকেই বললেন, এটি তাদের নতুন অজ্ঞিতা। এখানে ছাত্রলীগের ক্যাডারার মহড়া দিচ্ছে এবং তাদের দাবি কি তাও তারা বলছে না। একটাই বুঝতে পারছি, তারা আমাকে এখান থেকে বের হতে দিবে না। আমি এখানে এসেছি একটি মানহানি মামলার হাজিরা দিতে। আপনারা জানেন, মানহানি মামলায় জামিন দিতে হয় এটাই তার আইন। এই আইন ভেঙ্গে আমার জামিন আটকানোর কোনো সুযোগ নেই। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে জামিন দিয়েছেন। কিন্তু জামিন দেওয়ার পর থেকে আমাকে এখান থেকে বের হতে দিচ্ছে না। এর পেছনে পুরো ইন্দন হচ্ছে এখানকার যে ওসি ভদ্রলোক এবং এসপির। ওসি, এসপি তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
এমনকি আমাদের সামনে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ওসিকে ডাকলেন, তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের ডাকে সাড়া না দিয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছেন তিনি আসতে পারবেন না। বাংলাদেশের আইনের শাসন কোথায় গিয়েছে এবং পুলিশের ঔদ্ধত্ত কোন পর্যায় গিয়েছে। যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আহ্বানকে উপেক্ষা করে একজন ওসি বলেছিলেন আসতে পারবে না। আমি বন্দি আছি তাতে কিছু যায় আসে না। আপনারা যানেন আমি ৫ বছর বন্দি অবস্থায় আছি। আমার নামে বিভিন্ন জেলায় ১২৫টি মামলা আছে। আমি ৩৮ দিন রিমান্ডে ছিলাম, সেখানে আমাকে পুলিশ মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমার হায়াত আছে বিধায় আপনাদের মাঝে আবার আসতে পেরেছি। যতদিন বেছে আছি তত দিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লড়াই করে যাব। এখান থেকে যাতে বের হতে পারি তার জন্য আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আর জীবিত অবস্থায় না বের হতে পারলে মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন। আর সত্যের পক্ষের লড়াইয়ের পুরস্কার আমরা যেন আল¬াহর দরবারে গিয়ে পাই।’
সদর থানার ওসি নাসির উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই অচমকা তার ওপর হামলা হয়েছে। তবে পুলিশ না থাকলে আরো বড় ধরনের বিপদ হতে পারত।
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ আহমেদ বলেন, আমাদের দলের একজন নেতার দায়ের করা মামলায় তিনি জামিন নিতে এসেছিলেন। আমরা সেখানে বিকেল পর্যন্ত ছিলাম। আমাদের চলে আসার পর কারা হামলা করেছে তা বলতে পারব না।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষার বলেন,‘ভাই আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই, মারপিটের বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই ভাই।’
ইউনাইটেড হাসপাতালে মাহমুদুর রহমান: কুষ্টিয়ায় আদালত ভবনে ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমান ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। তিনি কুষ্টিয়া থেকে সড়কপথে অ্যাম্বুলেন্সযোগে যশোর পৌঁছান। সেখান থেকে বিমানযোগে ঢাকায় ফেরেন। বিমানবন্দরবন্দর থেকে মাহমুদুর রহমানকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে।