মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহতের অঙ্গীকার

- প্রকাশের সময় : ০১:১৫:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
- / ৩৮ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা আর মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহতের অঙ্গীকার নিয়ে বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের সর্বত্রই উদযাপিত হয়েছে মহান বিজয় দিবস। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের দেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় আর শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত জাতি দিবসটি উদযাপন করেছে। মানুষের কণ্ঠে ছিল উন্নত-সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। সকালে শীতের কুয়াশা ও ঠান্ডা উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বাইরে ও আশপাশের মহাসড়ক এলাকা এবং রাজধানী ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জড়ো হন। করোনা মহামারীর মধ্যেও ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ফুল, মাথায় বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড, জাতীয় পতাকা নিয়ে স্মৃতিসৌধে নামে জনতার ঢল। শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সমগ্র জাতি ৩০ লাখ শহীদকে আরও একবার জানিয়ে দেয় ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না।’
দিনের প্রথম প্রহরে সকাল সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এসএম শামিম উজ জামান ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শহীদবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল এ সময় সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। প্রতি বছর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ দিনে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে জাতীয় স্মৃতি সৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্য রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মতো এবারের বিজয় দিবসের কর্মসূচিও সীমিত করা হয়। বিজয় দিবসের দিন এবার জাতীয় প্যারেড স্কয়ারেও সশস্ত্র বাহিনীর সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজ (প্যারেড) বাতিল করা হয়।
দিনটি ছিল জাতীয় ছুটির দিন। ৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্মলাভ করে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হয় বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। একই সময়ে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষেও শহীদবেদিতে ফুল দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রধান বিচারপতি ও তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনও স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধার ফুলে ভরে উঠে শহীদবেদি।
আওয়ামী লীগ: আওয়ামী লীগ ভোরে সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করে। সকাল ৯টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা ¤্রদ্ধা জানান বীর শহীদের প্রতি। এ সময় দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আবদুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শাজাহান খান ও আবদুর রহমান; তথ্যমন্ত্রী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম; সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এসএম কামাল হোসেন ও মির্জা আজম; ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘যে স্বপ্ন দেখে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন জাতির পিতার নেতৃত্বে, সে স্বপ্ন নতুন প্রজন্ম তুলে নিয়েছে। তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
পরে বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলীয় নেতারা সেখানে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। এছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিএনপি: সকাল সাড়ে ৯টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। সেখান থেকে ফিরে শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন তারা। বিকেলে এক ভার্চুয়াল সভা করে দলটি। এর আগে সকালে নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ভোরে দেশব্যাপী বিএনপির কার্যালয়গুলোতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সুবিধাজনক সময়ে দেশব্যাপী বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
অন্যান্য দল/সংগঠন: শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজয় উল্লাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড প্রতিহত করতে সেøাগান, দেশাত্মবোধক গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বেজে চলে বিরামহীন। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এ ঢল অব্যাহত থাকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। একে একে বেদিতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি। এছাড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-’৭১, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাকের পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাংবাদিক ফোরাম, ইয়ুথ জার্নালিস্ট ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন।
‘পতাকার বুক জুড়ে মুক্তির জয়গান/অফুরন্ত সাহস শেখ মুজিবুর রহমান’ সেøাগান নিয়ে বুধবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। আলোচনা, নাচ-গান-আবৃত্তিসহ নানা পরিবেশনা উপস্থাপন করেন শিল্পীরা। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতি বছরের মতো এবারও ১০-১৬ ডিসেম্বর সপ্তাহব্যাপী ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক বিজয় উৎসব আয়োজন করে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার ভার্চুয়ালি হচ্ছে এ আয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ফেইসবুক পাতায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়। শিল্পকলা একাডেমি তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান সাজিয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর শুরু হওয়া আয়োজনের সমাপনী দিনে গতকাল ছিল আলোচনা, গান, নাচসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয় দিবস উদযাপন করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সামনে দাঁড়ানো বাংলাদেশে এবারের বিজয়ের উৎসব বড় পরিসরে উদযাপনের কথা থাকলেও করোনার কারণে সব কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হয়। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রংবেরঙের পতাকায় সাজানো হয়। শহীদদের আত্মার শান্তি, জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে মাসব্যাপী উদযাপন করছে বিজয় দিবস। (দৈনিক দেশ রূপান্তর)