মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম-ঠিকানাই পাল্টে দিয়েছে প্রতারক সাংবাদিক নাজমুল!

- প্রকাশের সময় : ১২:৩০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০২০
- / ৯২ বার পঠিত
উৎপল দাস: পাল্টে গেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর। হয়েছে “মুত্তিযুদ্দ বিষয়ক মনত্রালয়”। আর ঠিকানা ৩৫৮ ফ্রী স্কুল স্টেট রোড। ফোন নম্বর ০১৭১৩..৩.০৫। এসব কিছুই ঘটেছে জালিয়াতি করে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত সাংবাদিক নাজমুল হোসেনের কপিরাইট আবেদনের সরকারি ফরমে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কপিরাইট অফিস ও নাজমুল হোসেনের যৌথ অনিয়মের নজিরবিহীন নমুনা। কপিরাইট অফিসের হলফনামা সম্বলিত সরকারি ফরমে আবেদনকারী নাজমুল হোসেন পাল্টে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর। ৩৫৮ ফ্রী স্কুল স্ট্রিট রোড মূলত: নাজমুল হোসেনের নিজের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড-এর ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফোন নম্বর বলে চালিয়ে দেয়া নম্বরটিও নাজমুল হোসেনের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর। এই আবেদনপত্রের উপরে ভিত্তি করেই কপিরাইট অফিস নাজমুল হোসেন ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘জার্নি’র নামে কপিরাইট দিয়ে দেয়। অথচ আবেদনপত্রের কোথাও জার্নি শব্দটি নেই। এমনকি আবেদনপত্র এবং তার ভিত্তিতে দেওয়া, কপিরাইট সনদ এর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক অসঙ্গতি।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘বঙ্গবন্ধুর বুক কর্ণার’ প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পে দেশের ৬৫,৭০০ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত ‘বঙ্গবন্ধুর বুক কর্ণার’র জন্য বই কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ১ ডিসেম্বর ২০১৯ এ প্রকাশিত তালিকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটি নির্বাচিত হয়। এর প্রায় এক মাস পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে নাজমুল হোসেন বইটির কপিরাইট নিজের নামে নেয়ার জন্য কপিরাইট অফিসে আবেদন করেন।
‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটির মুদ্রিত তিনটি সংস্করণে নাজমুল হোসেনের দুটি পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথমটিতে তিনি সম্পাদনা পর্ষদ-এর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে প্রধান গবেষক। বাংলাদেশ কপিরাইট আইন ২০০০ এর ধারা ২(২৪)(ক) অনুযায়ী প্রণেতা হিসেবে সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য বা প্রধান গবেষক কপিরাইট পাওয়ার অধিকারী নয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আবেদনকারীর ধরণ- “ব্যক্তি” ক্যাটাগরিতে বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিক নাজমুল হোসেন আবেদন করেছেন। কপিরাইট আবেদনকারীর স্বার্থের ধরন- “নিয়োগকর্তা”। আবার কর্মের প্রণেতা হিসেবেও তিনি নিজেকে দাবি করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে কে, কাকে, কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিয়েছিল?
নাজমুল হোসেনের স্বাক্ষরিত কপিরাইট অফিসের সরকারী আবেদন ফরমে রচয়িতা বা প্রণেতার নাম লেখা রয়েছে মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন শেখ এবং অন্যান্য। অথচ এই আবেদনের প্রেক্ষিতে দেওয়া সনদেই নাজমুল হোসেনকে ১০০ শতাংশ রচয়িতা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে নাজমুল হোসেন নিজেই ১০০ শতাংশ রচয়িতার অধিকার দাবি করেননি।
এছাড়াও ভুল বা অসত্য তথ্য দিলে, সুস্পষ্ট শাস্তির বিধান ধাকা হলফনামা সম্বলিত এই আবেদনপত্রে আবেদনকারী নাজমুল হোসেনের দেওয়া আরো কিছু তথ্যের অসততা ভোরের পাতার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। প্রথম সংস্করণে পরে পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে কিনা? এই “না” ঘর পূরণের মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মোড়ক উন্মোচন করা সংস্করণের তথ্যটি গোপন করা হয়েছে। বইটি প্রণয়নের আর কোন পক্ষ নেই দাবি করে নাজমুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বইটির সম্পাদক অমিতাভ দেউরীর তথ্যও গোপন করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বইটির সম্পাদক অমিতাভ দেউরী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটি রচনা ও সম্পাদনা করেছি। আমি সাংবাদিক নাজমুল হোসেনকে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমার কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তার এই সম্পৃক্ততার কারণে, ৭জুন ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণে সম্পাদনা পর্ষদ এর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নাজমুল হোসেন এর নাম ছাপা হয়। এবং স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দেয়া তার প্রতিষ্ঠান ‘জার্নি’ বইটি পরিবেশকের দায়িত্ব পায়। পরবর্তীতে আমাকে না জানিয়েই তিনি স্পনসর জোগাড় করে বইটি দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি করেন। যেখানে নিজেকে প্রধান গবেষক দাবি করে নাম ছাপান। যদিও পান্ডুলিপি প্রণয়নে নাজমুল হোসেন গবেষকের দায়িত্ব পালন করেননি।”
অনুসন্ধানে, এক ‘জার্নি’ আড়ালে অনেকগুলো পরিচয় উঠে এসেছে। কখনো জার্নি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান, কখনো স্বেচ্ছাসেবী অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কখনো জার্নি পাবলিশার্স আবার জয়েন্ট স্টকে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে রেজিস্টার্ড জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড। ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটির সবকটি সংস্করণে জার্নি’র চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হকের নাম ছাপা হয়েছে। অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জার্নি’-র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, তিনি জার্নি মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত নন, রচয়িতা হিসেবে নাজমুল হোসেনের নিজের নামে কপিরাইট নেয়া, জার্নি মাল্টিমিডিয়া নামে স্বতন্ত্র লিমিটেড কোম্পানীর অস্তিত্ব ও প্রকাশক বদলের ঘটনা তিনি জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাংবাদিক নাজমুল হোসেনকে স্ত্রী শারমিন সুলতানা।
৩০/১২/২০১৯ তারিখে আবেদন করা নাজমুল হোসেন স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রের সঙ্গে এই নিয়োগ সংক্রান্ত কোন নথিপত্র জমা নেই। পান্ডুলিপি রচয়িতার কোনও প্রমাণপত্রও নেই। সম্পাদনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্যদেরকে লেখা গবেষণা করুন-এই মর্মে ৬টি অনুরোধপত্র রয়েছে। তবে এগুলো তারা গ্রহণ করেছেন কিনা, তারও কোনো উল্লেখ নেই।
কপিরাইট আবেদনপত্রের অসংগতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরীকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি প্রতারক সাংবাদিক নাজমুলকে ফোন করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটির প্রস্তুতিপর্বে সাংবাদিক নাজমুল হাসান এর ভূমিকা সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ও বইটির সার্বিক তত্ত¡াবধানকারী অপরূপ চৌধুরী বলেন, “বইটির রচয়িতা ও সম্পাদক অমিতাভ দেউরী পান্ডুলিপিটি প্রস্তুত করার পরে, সমন্বয়কারী নাজমুল হোসেন ও তার স্ত্রী শারমিন সুলতানা সম্পাদনা পর্ষদে উল্লেখিত প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে কাছ থেকে দেখেছেন এবং ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এমন কীর্তিমান মানুষদের পান্ডুলিপিটি দেখান তাদের মতামত সংগ্রহ করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা জেনে দেশের বিশিষ্ট সুনাগরিকরা সানন্দে তাদের মূল্যবান মতামত দেন। সে অনুযায়ী কিছু পরিমাার্জন হয়। এরপর সম্পাদক অমিতাভ দেউরীর পান্ডুলিপিটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। তিনি পান্ডুলিপি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তার মূল্যবান মতামত ও সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করার পরে বইটি ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।” (দৈনিক ভোরের পাতা)