মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নেয়ার পদক্ষেপকে ‘আইওয়াশ’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা
- প্রকাশের সময় : ০২:৩০:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩
- / ১২৭ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ২০ জনের একটি দল যে মিয়ানমারে যাচ্ছে, প্রত্যাবাসনের এ প্রচেষ্টাও শেষ অবধি ‘আইওয়াশ’ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে এর আগে যত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোতে গুণগত কোনো পরিবর্তন না আসার কারণে এবারের পদক্ষেপও পণ্ড হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডা. সি আর আবরার বলেন, ‘আমার ধারণা এটা হয়ত কিছুটা চটকদারি বিষয় হতে পারে অথবা লোক দেখানো।’
মিয়ানমার এখন কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘আগে কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা ছিল না। এখন মামলা আছে, যেখানে মিয়ানমারকে কিছুটা হলেও জবাবদিহি করতে হয়। এসব কিছু মিলিয়ে এটা একটা ‘আইওয়াশও’ হতে পারে, লোক দেখানো হতে পারে।’রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য এটাই প্রথম পদক্ষেপ নয়। এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি।
এরপর সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তৃতীয় একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের ২০ জনের একটি প্রতিনিধিদলকে মিয়ানমারে পাঠানো হচ্ছে বলে জানায় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। আগামী ৫ মে তাদের যাওয়ার কথা রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল কি-না তা খতিয়ে দেখতে মিয়ানমারের মংডুতে তারা যাবে বলে জানা যাচ্ছে।শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের ২০ সদস্যের যে দলটি মিয়ানমারে যাবে, তারা কারা তা এখনো ঠিক হয়নি। তাদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদেরই পাঠাব। আমাদের কাছে যাদেরকে প্রতিনিধি মনে হবে তাদেরই পাঠাব। কারণ রোহিঙ্গাদের তো এমন কোনো অর্গানাইজেশন নেই, প্রতিনিধিত্বশীল কেউ তো নেই।’তিনি যুক্ত করেন, ‘রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে, ভিজিট করবে, এটাই পরিকল্পনা।’
কী বলছে রোহিঙ্গারা?
বালুখালী এলাকায় ১১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ফিরে যেতে প্রস্তুত তারা। কিন্তু তার আগে তাদেরকে নাগরিকত্বের অধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি নাগরিকত্ব না পাই, বার বার যদি আপনাগো দেশে ফিরা আইতে পরে তাইলে কি ঠিক?’ উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ জানান, তিনি, তার বাবা ও দাদা, সবাই মিয়ানমারের নাগরিক। সেখানেই ফিরে যেতে চান তারা। বাংলাদেশে নিজেদের বাঁচানোর তাগিদেই এসেছেন। মিয়ানমারে যদি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে তারা সেখানে যেতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, ‘আমি তো এখনো যাইতে চাই, আমার দেশে আমি এখনো যাইব যদি সুযোগ পাই। আমার যদি সেফটি-সিকিউরিটি থাকে সেখানে, আমি চলে যাব।’
তবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে যে ২০ জনের প্রতিনিধি দল মিয়ানমার যাচ্ছে, তারা ফিরে যেসব তথ্য দিবে তার ওপর ভিত্তি করে মিয়ানমারে ফিরতে নারাজ মোহাম্মদ ইয়াসিন। কারণ ওই প্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যের সত্যতা নিয়ে তিনি সন্দিহান। নয়াপাড়া ক্যাম্পের একজন রোহিঙ্গা মানবাধিকার-কর্মী সাইফুল আরাকানী বলেন, কিছু কিছু রোহিঙ্গা নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে তাদের বাপ-দাদার ভিটায় ফেরত যেতে চায়। কোনো শরণার্থী শিবিরে ফিরতে চায় না তারা।
সাইফুল বলেন, অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের ক্যাম্পে ফেরত যেতে চায়। কারণ তারা এখানে তাদের নিজেদের জীবন নিরাপদ নয় বলে মনে করে। তিনি জানান, এবারের প্রত্যাবাসনে যারা যেতে চায় তারা প্রতিনিধিদলের ঘুরে আসার পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি সিদ্ধান নিবেন। কারণ কিভাবে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে সে বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কোনো তথ্য জানানো হয়নি। তিনি বলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারে এবারের রিপ্যাট্রিশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারা কিভাবে যাবে, কী নিয়ে যাবে, তাদেরকে জান্তা সরকার কী নিয়ে মিয়ানমারে ফিরাবে- তা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি। তার জন্য তারা অপেক্ষায় আছে।’
কতটা সফল হবে এই উদ্যোগ?
বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোয় সব মিলিয়ে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার বাংলাদেশের সরকারের সাথে একটি চুক্তি করেছিল, যার মধ্যস্থতা করেছিল চীন। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০১৯ সালে আগস্টে চীনের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি।
এরপর গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের কক্সবাজারে আসে। এরপর এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ চীনের মধ্যস্থতায় সে দেশের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের একটি যৌথ বৈঠক হয়। এর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তৃতীয় এই উদ্যোগ আসে। আসিফ মুনীর বলেন, এর আগে যেহেতু বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হতে হতেও হয়নি, তাই এই পদক্ষেপও বাস্তবায়ন হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর আগে দু’দেশের সরকারের পক্ষ থেকে রাজি হওয়ার কথা জানা গেলেও রোহিঙ্গাদের সাথে তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। এবারো একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
আরোও পড়ুন। আলোচনায় ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী, সাড়া দিলেন না বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা শুধুই প্রশাসনিক। কাজেই এটা সার্থকতা আনবে বলে আমাদের মনে হয় না।’মিয়ানমার এমন একটা সময়ে প্রত্যাবাসনের এই প্রচেষ্টা শুরু করেছে, যার কিছুদিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে তাদের জবাব দিতে হবে। আসিফ মুনীর বলেন, মিয়ানমারে এর আগে গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও বর্তমানে সেখানে সামরিক সরকার রয়েছে। ফলে তাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করার জায়গা থাকতে পারে। এর অংশ হিসেবে এই সময়ে এসে এমন পদক্ষেপের তোড়জোড় আসতে পারে।
একই মত দিয়েছেন শরণার্থীবিষয়ক আরেক বিশেষজ্ঞ ড. সি আর আবরার। তিনি বলেন, ‘এটা লোক দেখানো যে আমরা (মিয়ানমার) করছি, এগুচ্ছে, একটা অজুহাত হিসেবে যে ওদের (রোহিঙ্গাদের) সাথে আমরা বৈঠক করছি, তারা এসেছে, তারা দেখে গেছে, মূলত সময়ক্ষেপন ছাড়া এখানে আর কোনো কিছু দেখছি না আমি।’তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে মিয়ানমারের সাথে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সেখানে চীনের ভূমিকা ছিল। এরপরে অনেক দিন চলে গেছে। কিন্তু এখনো কোনো রোহিঙ্গা সেখানে যেতে পারেনি এবং সেই পরিস্থিতির কোনো গুণগত পরিবর্তন আসেনি।
তিনি বলেন, ‘আমি খুব একটা মনে করি না যে এ ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অদূর ভবিষ্যতে হবে।’ তবে কিছুটা ভিন্ন মত দিয়েছেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে যে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা মিয়ানমার যাচ্ছে তা কিছুটা আশার সঞ্চার করছে।আশাবাদ হচ্ছে যে রোহিঙ্গারা যদি নিজেরা গিয়ে দেখে আসে এবং তারা যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় নেয়ার জন্য আস্থার জায়গা তৈরি হতে পারে। তবে সব কিছু যদি ইতিবাচক থাকে, শুধু তাহলেই আশা তৈরি হবে।
আবার এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর মিলছে না বলেও মনে করেন হুমায়ুন কবীর।
তিনি বলেন, এই প্রকল্প কি শুধু এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই হচ্ছে? নাকি এর ধারাবাহিকতা থাকা দরকার যার আওতায় ধীরে ধীরে সবাই যেতে পারবে- সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত, যে ২০ জন রোহিঙ্গা যাচ্ছে তাদের উপর ভরসা করে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা যাবে কি-না তা পরিষ্কার নয় এবং এর উত্তরও নেই।
তৃতীয়ত, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরার পর সেখানে তারা টিকতে পারবে কি-না তা একটা প্রশ্ন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতির দরকার হবে। সেক্ষেত্রে তৃতীয়পক্ষের ভূমিকা কী হবে অর্থাৎ জাতিসঙ্ঘ, আসিয়ান বা বাংলাদেশের বন্ধু কোনো রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুষ্পষ্ট বক্তব্য এখনো শোনা যায়নি।তিনি বলেন, ‘তারা বলেননি যে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিতে তারা ভূমিকা রাখবেন।’একই সাথে বাংলাদেশের সতর্ক থাকার সুযোগ আছে বলেও মনে করেন সাবেক এই কূটনীতিক। তিনি বলেন, ‘এটা দেখিয়ে যদি মিয়ানমার সারা পৃথিবীতে বলে বেড়ায় যে এর সমাধান আমরা করে ফেলেছি, তাহলে তো আমাদের কাজ হলো না। আমরা চাই ১১ শ’ না, যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আছে তাদের সবার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা হোক।’সূত্র : বিবিবি
সুমি/হককথা