বেশির ভাগ শ্রমজীবীর মেলে না ন্যূনতম বেতন
- প্রকাশের সময় : ১০:৩২:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৬
- / ৫৮৫ বার পঠিত
ঢাকা: পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ করে যান শ্রমিকেরা। দেশের বেশির ভাগ শ্রমজীবী জীবনযাত্রার ন্যূনতম চাহিদা পূরণে উপযুক্ত মজুরি পান না। সরকারি জরিপ বলছে, একজন গৃহকর্মীর দৈনিক আয় গড়ে ৯০ টাকা। দেশে প্রায় ২০ লাখ গৃহশ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের মধ্যে অনেকে আবার বেতন পান না।
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত বিবিএসের জরিপ বলছে, মিস্ত্রি বা যন্ত্রী হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের গড় বেতন ১২ হাজার টাকা। সেবা ও বিক্রয়কর্মীরা সাড়ে ১১ হাজার এবং কৃষি ও মৎস্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ৮ হাজার ৯০০ টাকা বেতন পান। এ ছাড়া দারোয়ান, নির্মাণশ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও কুলি গড়ে ৮ হাজার ২০০ টাকা বেতন পান। আর অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রিকশাচালক, গৃহকর্মী, নির্মাণশ্রমিক, নাপিত, ফেরিওয়ালা, ফুটপাতের হকারসহ অন্যদের আয় বা মজুরি আরও কম। গৃহকর্মীর দৈনিক গড় আয় সবচেয়ে কম।
প্রবীণ শ্রমিকনেতা এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক-কর্মচারীরা যে মজুরি পান, তা অপর্যাপ্ত। বেশির ভাগই স্বামী ও স্ত্রী মিলে কাজ করে কোনোমতে টিকে থাকছেন। কেউবা ঋণের দায়ে জর্জরিত হচ্ছেন। এই শ্রেণির মানুষ জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে বড় ধরনের আপস করছেন।
শ্রমিকনেতারা বলছেন, মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা মজুরি না দিলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে টিকে থাকাও অসম্ভব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মাসে গড় বেতন বা মজুরি ছিল ১১ হাজার ৪৯৩ টাকা। তবে এই গড় বেতনের মধ্যে তিন হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পাওয়া চাকরিজীবী রয়েছেন।
সরকারি হিসাবে দেশে এখন মোট শ্রমজীবী ও কর্মজীবীর সংখ্যা ৫ কোটি ৮৭ লাখ। প্রতিবছর ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে। গত বছর প্রকাশিত বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছরের ওপরে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এর বাইরে আংশিক কর্মসংস্থানে রয়েছে ২৩ লাখ। সব মিলিয়ে দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪৯ লাখ। বেকাররা যেমন ভালো নেই, তেমনি কর্মজীবী অনেকে যে বেতন পান, তা দিয়ে নিজের ও পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারেন না। এমনকি নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হন অনেকেই। বিবিএসের হিসাবে মাত্র ২৮ শতাংশের নিয়োগপত্র রয়েছে, বাকি প্রায় সবাই মৌখিক চুক্তিতে কাজ করছেন। তবে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ২১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর ফলে তাঁরা কিছুটা স্বস্তিতে আছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব এস এম জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা আশা করছি প্রধানমন্ত্রী পয়লা মে শ্রমিক সমাবেশে মজুরি কমিশন ঘোষণা করবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বনিম্ন মূল বেতন ১০ হাজার টাকা চাই, যা এখন আছে ৪ হাজার ১৫০ টাকা।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত শ্রমিকদের জন্য মজুরি কমিশন গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি আছে।
সরকারি হিসাবে মোট শ্রমশক্তির ১২ দশমিক ৬ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেশির ভাগই কৃষিতে নিয়োজিত। তৈরি পোশাক খাতের একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন এখন ৫ হাজার ৩০০ টাকা। পোশাকশ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা করার দাবিতে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এই খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।
প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, দেশে আনুষ্ঠানিক ৪২টি খাত রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত পাঁচ বছর পর কমিশন গঠন করে। এর বাইরে অন্য খাতগুলো চাহিদা জানালে তা নিম্নতম মজুরি বোর্ডে পাঠানো হয়। বোর্ড শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা সাপেক্ষে মজুরি নির্ধারণ করে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি চা-বাগান শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। চামড়াসহ কয়েকটি খাতে আলাপ-আলোচনা চলছে। এসব খাত থেকে চাহিদা এলে মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি নিম্নতম মজুরি বোর্ডে পাঠানো হবে।
বিভাজিত শ্রমিক সংগঠন:শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনি সুযোগ থাকলেও মালিকপক্ষের নানা তৎপরতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা সংগঠিত হতে পারছেন না। আবার স্বার্থের বিরোধ ও রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় তেমন ভূমিকা রাখতে পারছেন না শ্রমিক নেতারাও।
শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়কারী আনোয়ার হোসাইন বলেন, দেশে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতি নেই। শ্রম আইন ও আইএলও কনভেনশন মানা হয় না। তাঁর মতে, মালিকদের অর্থবিত্ত ও প্রভাব বেশি, তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নিচে তাঁদের অবস্থান। কিন্তু শ্রমিকদের অর্থবিত্ত নেই। তাঁদের মধ্যে অনৈক্যও বেশি।
শ্রমিকনেতা ওয়াজেদুল ইসলাম বললেন, পোশাকশ্রমিকদের সংগঠন আছে কমপক্ষে ৫৬টি। এ ছাড়া সব খাত নিয়ে কাজ করে এমন জোট, ফেডারেশন বা ইউনিয়ন আছে কমপক্ষে ৩১টি। এভাবে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হচ্ছেন শ্রমিকেরা। তাঁর মতে, হয়রানি ও চাকরিচ্যুতির ভয়ে অনেক শ্রমিক এখন ট্রেড ইউনিয়ন না করে চুপ করে থাকেন।
আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী, সংগঠন করা শ্রমিকের অধিকার। বাংলাদেশ ওই কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া আইনে ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃত। তার পরও অধিকাংশ পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন নেই। যদিও পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, প্রায় ১০ শতাংশ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আছে। (প্রথম আলো)