নিউইয়র্ক ০৭:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বুদ্ধিজীবীর দলীয় আনুগত্যের বিপদ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৩৪:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ১০২ বার পঠিত

প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে প্রশ্নটি উঠে আসে। সেটি হলো বুদ্ধিজীবীদের দলনিরপেক্ষতা। আমি মনে করি, একজন বুদ্ধিজীবী অবশ্যই রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ হবেন। বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের সমস্যার দিকে নির্দেশ করা এবং সেখানে আলো ফেলা। এই আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাবে দেশ।বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, যেটি এখন পালন করা হয়, তা সারাবিশ্বে বিরল ঘটনা। কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাছাই করে হত্যা করা হয়নি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা বিষয়ে ২০১৩ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার রায়ে বলা হয়েছিল- ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি; গোটা জাতির জন্য যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে।’আদালতের পর্যবেক্ষণ দিয়ে আমরা হয়তো একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ভয়াবহতা অনুমান করতে পারব। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা বা অবস্থান কীভাবে নির্ণয় করা যাবে, তা বুঝতে হলে এখনকার সময় ও চিত্রের দিকে চোখ রাখতে হবে।
এখন আলোচনা শোনা যায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বেশি বাধা আসে কোত্থেকে? এর উত্তরের দিকে তাকালে দেখতে পাই রাষ্ট্র ও মৌলবাদী গোষ্ঠী- এ দুই পক্ষ থেকেই বাধা আসে। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মৌলবাদী গোষ্ঠীর চেয়ে রাষ্ট্রের দায় বেশি বলেই প্রতীয়মান।স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে অর্থনীতির বিচার-ব্যাখ্যার নিরিখে অর্থনৈতিক খাতে দেশের অগ্রগতি হয়েছে, বলা যায়। এই সময়ে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। শ্রেণিগত বৈষম্যও বেড়েছে অনেক। অন্যদিকে মননশীলতা, মানবিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংকুচিত হচ্ছে। এই বিপরীতমুখী ধারার দিকে নজর দিলে দেশের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। ইংরেজ শাসনের পরে পাকিস্তান আমলে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তাতে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেণিগত বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন। এখন দেশের বুদ্ধিজীবীরা আরাম-আয়েশে আছেন। তাই তাঁরা সামাজিক আন্দোলনের ঝুঁকি কাঁধে নিতে চান না। আবার স্বার্থহানির আশঙ্কাও রয়েছে।মানুষের অসহায়তা এ যুগের একটি বড় ঘটনা। নানা কারণে লোকজন অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যেও চেষ্টা চলে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গন থেকে। কেউ কেউ প্রতিবাদে শামিল হন। যদিও সে সংখ্যা ধীরে ধীরে বিরল হয়ে উঠছে।
বিগত শতকে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রোঁমা রঁলা, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, জুলিও কুরি, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখের সঙ্গে বাঙালি রবীন্দ্রনাথ। তাঁরা যেমন কলম হাতে ফ্যাসিস্ট যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তেমনি অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা করেছেন দুই ফ্রন্টে। অর্থাৎ লেখায় ও কাজে।
জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা, মুক্তিসংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে বুদ্ধিজীবীর আদর্শভিত্তিক সততা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায় এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে সার্ত্রে বা পরবর্তী সময়ের নোয়াম চমস্কি প্রমুখের ভূমিকায়। অন্যদিকে স্বদেশি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ সার্ত্রের জন্য বিরল ঘটনা। আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং সেখানে ফরাসি সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এক সাহসী বুদ্ধিজীবীর নিরপেক্ষ ভূমিকার উদাহরণ। এ জন্য স্বদেশে নিন্দিত হয়েছেন সার্ত্রে। স্তাবকদের প্ররোচনার মুখেও সার্ত্রেকে গ্রেপ্তার করতে রাজি হননি তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গল। তিনি নাকি তাঁর পার্শ্বচরদের বলেছিলেন- ভল্টেয়ারদের গ্রেপ্তার করা যায় না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কোথাও বন্দিত এবং কোথাও নিন্দিত সার্ত্রে দ্বিধা করেননি যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নিঃসঙ্গ রাষ্ট্র কিউবা ভ্রমণে। কিউবান বিপ্লবের সমর্থক সার্ত্রে দেশটির প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর আমন্ত্রণে বান্ধবী সিমন দ্য বোভেয়ারকে সঙ্গে নিয়ে কিউবা সফরে গিয়েছিলেন। দেখা হয়; কথা হয় বিপ্লবী চে গুয়েভারার সঙ্গেও। কিউবান বিপ্লবের শুদ্ধতা ধরে রাখার জন্য তাঁরা দু’জনই আহ্বান জানান বিপ্লবী নায়কদের প্রতি। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকালীন ভিয়েতনাম যুদ্ধ সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক মহলে। সায়গলের মার্কিন তাঁবেদার সরকারের পতনের পর জাপানি সংবাদপত্র ‘আসাহি শিম্বুন’ সম্পাদকীয় স্তম্ভে মন্তব্য করে- ‘সব দিক বিচারে ভিয়েতনাম যুদ্ধ একটি মুক্তিসংগ্রাম। এ যুগে কোনো পরাশক্তি জাতীয়তাবাদী উত্থান অনির্দিষ্টকাল চেপে রাখতে পারে না।’
এ মন্তব্য নৈতিক বিচারে সঠিক মেনে নিয়েও চমস্কি বুঝতে পারেন, মুক্তির ভবিষ্যৎ খুবই কঠিন। ঠিকই এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায় ওয়াশিংটন সমর্থিত সামরিক শাসক দশকের পর দশক তাদের আধিপত্যবাদী বর্বর শাসন বজায় রেখেছে। ইন্দোনেশিয়া, চিলি বা ব্রাজিলের মতো একাধিক দেশ তার প্রমাণ।
এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের উচিত তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদী ভূমিকা পালন; অনেকটা সাহসী যোদ্ধার মতো। বিশ্বপরিসরে বিভিন্ন দেশের সৎ বুদ্ধিজীবীদের দাঁড়ানো উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে; আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের প্রতিবাদী জনমত সংহত করার নৈতিক দায়িত্ব পালনে। কারণ একালে একমাত্র বিপুলসংখ্যক সংঘবদ্ধ বিস্ম্ফোরক জনমতই পারে পরাশক্তিকে এক সময় তার অন্যায় অবস্থান থেকে পিছু হটতে বাধ্য করতে।
শুরুতে যে পরিবর্তনের কথা, বদলে যাওয়ার কথা বলেছিলাম, তা যদি আদর্শহীন যাত্রা হয়ে ওঠে, তবে তাতে আদর্শ ফল হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম হওয়ারই কথা; বিশেষ করে সমাজবদলের ক্ষেত্রে, যেটা একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি। শক্তির ভারসাম্যহীন বিশ্বে একক পরাশক্তি নিজ স্বার্থ অনুযায়ী সবকিছু গড়ে তোলে। সেখানে ছোট-বড় সবার বিকাশ এক মাত্রায় ঘটে না। এখানেই যত সমস্যা। তাই দেখা যায় এবং যাচ্ছেও যে, মেধাবী তরুণ বা বুদ্ধিদীপ্ত যুবক অথবা অনুরূপ বয়সী বুদ্ধিজীবীর বৃহৎ অংশকে পরাশক্তির পক্ষে সুর মেলাতে বা নীরব সমর্থন জানাতে। এটি সাধারণ প্রবণতা উন্নয়নশীল বা অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশের এলিট শ্রেণির মধ্যে। সেখানে বুদ্ধিজীবীর সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ ক্রমেই পিছু হটছে। হয়তো তাই অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বলিষ্ঠ হওয়া দূরে থাক, ক্রমেই দুর্বল ও বিরল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের অনাকাঙ্ক্ষিত উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায় এড়িয়ে ক্ষুদ্র দলীয় বা স্বার্থবাদী মতামতের ফলে তাঁদের গুরুত্বও অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসছে। দলীয় আনুগত্যের এই প্রবণতা বিপজ্জনক। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করবেন- এটিই প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের মতো দেশ, যার জন্মের সময়ে শ্রেষ্ঠ সন্তান অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের জীবন দিতে হয়েছে, এমন একটি দেশে বুদ্ধিজীবীদের দায় আরও বেশি। সূত্র : সমকাল

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

বুদ্ধিজীবীর দলীয় আনুগত্যের বিপদ

প্রকাশের সময় : ০১:৩৪:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২

প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে প্রশ্নটি উঠে আসে। সেটি হলো বুদ্ধিজীবীদের দলনিরপেক্ষতা। আমি মনে করি, একজন বুদ্ধিজীবী অবশ্যই রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ হবেন। বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের সমস্যার দিকে নির্দেশ করা এবং সেখানে আলো ফেলা। এই আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাবে দেশ।বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, যেটি এখন পালন করা হয়, তা সারাবিশ্বে বিরল ঘটনা। কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাছাই করে হত্যা করা হয়নি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা বিষয়ে ২০১৩ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার রায়ে বলা হয়েছিল- ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি; গোটা জাতির জন্য যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে।’আদালতের পর্যবেক্ষণ দিয়ে আমরা হয়তো একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ভয়াবহতা অনুমান করতে পারব। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা বা অবস্থান কীভাবে নির্ণয় করা যাবে, তা বুঝতে হলে এখনকার সময় ও চিত্রের দিকে চোখ রাখতে হবে।
এখন আলোচনা শোনা যায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বেশি বাধা আসে কোত্থেকে? এর উত্তরের দিকে তাকালে দেখতে পাই রাষ্ট্র ও মৌলবাদী গোষ্ঠী- এ দুই পক্ষ থেকেই বাধা আসে। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মৌলবাদী গোষ্ঠীর চেয়ে রাষ্ট্রের দায় বেশি বলেই প্রতীয়মান।স্বাধীনতার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে অর্থনীতির বিচার-ব্যাখ্যার নিরিখে অর্থনৈতিক খাতে দেশের অগ্রগতি হয়েছে, বলা যায়। এই সময়ে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। শ্রেণিগত বৈষম্যও বেড়েছে অনেক। অন্যদিকে মননশীলতা, মানবিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংকুচিত হচ্ছে। এই বিপরীতমুখী ধারার দিকে নজর দিলে দেশের বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। ইংরেজ শাসনের পরে পাকিস্তান আমলে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তাতে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেণিগত বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন। এখন দেশের বুদ্ধিজীবীরা আরাম-আয়েশে আছেন। তাই তাঁরা সামাজিক আন্দোলনের ঝুঁকি কাঁধে নিতে চান না। আবার স্বার্থহানির আশঙ্কাও রয়েছে।মানুষের অসহায়তা এ যুগের একটি বড় ঘটনা। নানা কারণে লোকজন অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্যেও চেষ্টা চলে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গন থেকে। কেউ কেউ প্রতিবাদে শামিল হন। যদিও সে সংখ্যা ধীরে ধীরে বিরল হয়ে উঠছে।
বিগত শতকে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রোঁমা রঁলা, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, জুলিও কুরি, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখের সঙ্গে বাঙালি রবীন্দ্রনাথ। তাঁরা যেমন কলম হাতে ফ্যাসিস্ট যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তেমনি অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা করেছেন দুই ফ্রন্টে। অর্থাৎ লেখায় ও কাজে।
জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা, মুক্তিসংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে বুদ্ধিজীবীর আদর্শভিত্তিক সততা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায় এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে সার্ত্রে বা পরবর্তী সময়ের নোয়াম চমস্কি প্রমুখের ভূমিকায়। অন্যদিকে স্বদেশি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ সার্ত্রের জন্য বিরল ঘটনা। আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং সেখানে ফরাসি সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এক সাহসী বুদ্ধিজীবীর নিরপেক্ষ ভূমিকার উদাহরণ। এ জন্য স্বদেশে নিন্দিত হয়েছেন সার্ত্রে। স্তাবকদের প্ররোচনার মুখেও সার্ত্রেকে গ্রেপ্তার করতে রাজি হননি তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গল। তিনি নাকি তাঁর পার্শ্বচরদের বলেছিলেন- ভল্টেয়ারদের গ্রেপ্তার করা যায় না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কোথাও বন্দিত এবং কোথাও নিন্দিত সার্ত্রে দ্বিধা করেননি যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নিঃসঙ্গ রাষ্ট্র কিউবা ভ্রমণে। কিউবান বিপ্লবের সমর্থক সার্ত্রে দেশটির প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর আমন্ত্রণে বান্ধবী সিমন দ্য বোভেয়ারকে সঙ্গে নিয়ে কিউবা সফরে গিয়েছিলেন। দেখা হয়; কথা হয় বিপ্লবী চে গুয়েভারার সঙ্গেও। কিউবান বিপ্লবের শুদ্ধতা ধরে রাখার জন্য তাঁরা দু’জনই আহ্বান জানান বিপ্লবী নায়কদের প্রতি। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘকালীন ভিয়েতনাম যুদ্ধ সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক মহলে। সায়গলের মার্কিন তাঁবেদার সরকারের পতনের পর জাপানি সংবাদপত্র ‘আসাহি শিম্বুন’ সম্পাদকীয় স্তম্ভে মন্তব্য করে- ‘সব দিক বিচারে ভিয়েতনাম যুদ্ধ একটি মুক্তিসংগ্রাম। এ যুগে কোনো পরাশক্তি জাতীয়তাবাদী উত্থান অনির্দিষ্টকাল চেপে রাখতে পারে না।’
এ মন্তব্য নৈতিক বিচারে সঠিক মেনে নিয়েও চমস্কি বুঝতে পারেন, মুক্তির ভবিষ্যৎ খুবই কঠিন। ঠিকই এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায় ওয়াশিংটন সমর্থিত সামরিক শাসক দশকের পর দশক তাদের আধিপত্যবাদী বর্বর শাসন বজায় রেখেছে। ইন্দোনেশিয়া, চিলি বা ব্রাজিলের মতো একাধিক দেশ তার প্রমাণ।
এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের উচিত তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদী ভূমিকা পালন; অনেকটা সাহসী যোদ্ধার মতো। বিশ্বপরিসরে বিভিন্ন দেশের সৎ বুদ্ধিজীবীদের দাঁড়ানো উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে; আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের প্রতিবাদী জনমত সংহত করার নৈতিক দায়িত্ব পালনে। কারণ একালে একমাত্র বিপুলসংখ্যক সংঘবদ্ধ বিস্ম্ফোরক জনমতই পারে পরাশক্তিকে এক সময় তার অন্যায় অবস্থান থেকে পিছু হটতে বাধ্য করতে।
শুরুতে যে পরিবর্তনের কথা, বদলে যাওয়ার কথা বলেছিলাম, তা যদি আদর্শহীন যাত্রা হয়ে ওঠে, তবে তাতে আদর্শ ফল হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম হওয়ারই কথা; বিশেষ করে সমাজবদলের ক্ষেত্রে, যেটা একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি। শক্তির ভারসাম্যহীন বিশ্বে একক পরাশক্তি নিজ স্বার্থ অনুযায়ী সবকিছু গড়ে তোলে। সেখানে ছোট-বড় সবার বিকাশ এক মাত্রায় ঘটে না। এখানেই যত সমস্যা। তাই দেখা যায় এবং যাচ্ছেও যে, মেধাবী তরুণ বা বুদ্ধিদীপ্ত যুবক অথবা অনুরূপ বয়সী বুদ্ধিজীবীর বৃহৎ অংশকে পরাশক্তির পক্ষে সুর মেলাতে বা নীরব সমর্থন জানাতে। এটি সাধারণ প্রবণতা উন্নয়নশীল বা অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশের এলিট শ্রেণির মধ্যে। সেখানে বুদ্ধিজীবীর সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ ক্রমেই পিছু হটছে। হয়তো তাই অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বলিষ্ঠ হওয়া দূরে থাক, ক্রমেই দুর্বল ও বিরল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের অনাকাঙ্ক্ষিত উদাহরণ তৈরি হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায় এড়িয়ে ক্ষুদ্র দলীয় বা স্বার্থবাদী মতামতের ফলে তাঁদের গুরুত্বও অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসছে। দলীয় আনুগত্যের এই প্রবণতা বিপজ্জনক। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করবেন- এটিই প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের মতো দেশ, যার জন্মের সময়ে শ্রেষ্ঠ সন্তান অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের জীবন দিতে হয়েছে, এমন একটি দেশে বুদ্ধিজীবীদের দায় আরও বেশি। সূত্র : সমকাল