নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল ২০২২ সাল। বিদায়ী বছরে (২০২২) সাফল্য-ব্যর্থতা, আনন্দ-বেদনা ও আশা-নিরাশার হিসাব-নিকাশ পেছনে ফেলে পূর্ব গগনে উঠছে নতুন বছরের সূর্য। এরই মধ্যে নতুন বছরকে বরণ ও স্বাগত জানাতে আনন্দে উদ্বেলিত সবাই।
তবে তার আগেই কি পেলাম আর কি হারালাম সেই হিসাব-নিকাশ কষছেন অনেকে। এই সময়ে কী ঘটে গেল তার স্মৃতিচারণও চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী বছরজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল রাজশাহীর বেশ কিছু ঘটনা। বিশেষ করে রাজশাহীতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বার বার খবরের শিরোনাম হয়েছে।
জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির অডিও ক্লিপ ভাইরাল
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজশাহী জেলা সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানার সঙ্গে এক নারী কর্মীর মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। ওই অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরালও হয়। ভাইরাল হওয়া ওই অডিও ফোনালাপে ওই নারী কর্মীকে আপত্তিকর প্রস্তাবের পাশাপাশি ভয়ভীতিও দেখানো হয়।
ফাঁস হওয়া চার মিনিট ২৯ সেকেন্ডের ওই অডিওতে শোনা যায়, এক নারী ছাত্রলীগ নেত্রীকে তার কাছে মেয়ে পাঠানোর কথা বলছেন রানা। ওই অডিওতে রানাকে বলতে শোনা যায়, তুমি আমার সাথে নাটক করিচ্ছো তাই না? মেয়েটি তাকে বলেন, কিসের নাটক ভাইয়া? রানা বলেন, তোমার কথা-কাজে মিল পাচ্ছি না। চিটারি করতে পারবা না। বহুত বড় চিটারি-বাটপারি কইরি আমি প্রেসিডেন্ট হইছি। সব চিটারের দলের সর্দার আমি। তুমি না হয়, আসতে চায়া আসলে না, কাকে যে পাঠাতে চাইলে সে কই? একজনের সাথে কইরি তুমি যদি বড় নেত্রী হও, সেটা মানুষ মাইনি লিতে পারে না, তুমি বুঝ না?
পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ঘটনাটি তদন্ত করা হয়। পরে অভিযুক্ত জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রানাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি জেলা কমিটিও বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় সংসদ।
তবে সে সময়ে অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা সাকিবুল ইসলাম রানা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের ভেতরের কেউ ষড়যন্ত্র করছে।
জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদকের ফেনসিডিল সেবনের ভিডিও ফাঁস
জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে এক কলেজছাত্রকে মারধরের অভিযোগ উঠে। ২৫ জুলাই এক কলেজছাত্রকে চুরির অপবাদ দিয়ে রাতভর আটকে নির্যাতন করার অভিযোগ উঠে জাকিরের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ফেনসিডিল পানের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে জাকির হোসেনের দাবি, তার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগই ষড়যন্ত্রমূলক।
যদিও ভিডিও ভাইরালের পর ছাত্রলীগ নেতা জাকির হোসেন অমি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, ফেনসিডিল নয়, তিনি স্পীড পান করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ধোপে টেকেনি। নৈতিক স্খলনজনিত কারণে ছাত্রলীগ নেতা জাকির হোসেন অমিকে অব্যাহতি দেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ।
পুলিশ পেটানোর অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় পুলিশকে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠে এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ওই ছাত্রলীগ নেতাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গত বছরের ৭ জুন দুপুরে তাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠোনো হয়। অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম নাঈম হাসান। তিনি পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর সরকারি কলেজের স্নাতকের ছাত্র এবং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি।
নাঈম হাসানের হাতে হামলার শিকার পুলিশ সদস্যের নাম আতিকুর রহমান। তিনি রাজশাহী জেলা পুলিশে কর্মরত। ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য তাকে পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হেরোইন সেবনকালে ছাত্রলীগের ৩ নেতাকর্মী আটক
হেরোইন সেবনকালে রাজশাহীর তানোর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। উপজেলার মাসিন্দা এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
গ্রেফতাররা হলেন- তানোর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন ওরফে শাওন, তানোর পৌর এলাকার কালিগঞ্জ মাসিন্দা গ্রামের আলতাফ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ কর্মী সুমন ও জেলার মোহনপুর উপজেলার মহব্বতপুর ভাতপাড়া গ্রামের মোজাহারুল ইসলামের ছেলে ছাত্রলীগ কর্মী হাফিজুর রহমান।
বিদেশী অস্ত্র হাতে ছবি ভাইরাল ছাত্রলীগ নেতার
মে মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিদেশী অস্ত্র হাতে ছবি ভাইরাল হয় এক ছাত্রলীগ নেতার। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা আবু বক্কার সিদ্দিকী ওরফে রাতুলকে (৩০) রাজশাহী থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারকৃত রাতুল পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও সদ্য বিলুপ্ত হওয়া পাবনা জেলা ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক। স্থানীয়ভাবে এলাকার মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টি এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছাত্রলীগ নেতা রাতুল ফেসবুকে বিদেশি অস্ত্র হাতে ছবি দিয়েছিলেন। এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি নিজের কাছে পিস্তল রাখতেন। ফেসবুকে ছবি দেয়ার মূল উদ্দেশ্য যাতে সকলে তার কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের কথাটি জানেন এবং তিনি নিজেকে বড় ধরণের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
রাতুলের বাড়ি পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাট ইউনিয়নের গাবগাছি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মোস্তফা কামালের ছেলে।
ছাত্রলীগ নেতা রাতুলকে গ্রেফতারের পর র্যাব-৫ রাজশাহী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে বলা হয়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর বোয়ালিয়া থানাধীন গ্র্যান্ড তোফা হল বিল্ডিং থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বোয়ালিয়া থানাধীন সাগরপাড়া মহল্লার একটি পুরনো পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
কলেজ অধ্যক্ষকে পেটানোর অভিযোগ এমপি ফারুকের বিরুদ্ধে
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে এক কলেজ অধ্যক্ষকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করার অভিযোগ উঠে। আহত সেলিম রেজা জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ। এমপি ফারুক চৌধুরীর লাথি, কিল-ঘুষি ও হকিস্টিকের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালশিরা জমে যায়। ৭ জুলাই রাতে নগরীর নিউমার্কেট সংলগ্ন এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর মালিকানাধীন থিম ওমর প্লাজার চেম্বারে এ ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এ ঘটনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের করা তদন্ত কমিটিও ওই ঘটনার সত্যতা পায়। তবে এমপি ফারুক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
অধ্যক্ষ সেলিম রেজা এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এমপির হাতে নির্দয় পিটুনির শিকার হলেও অধ্যক্ষ সেলিম রেজা লজ্জা ও ভয়ে কোথাও অভিযোগ করেননি।
তবে ঘটনা সম্পর্কে ওই সময় এমপি ফারুক গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, কলেজ অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধরের অভিযোগ সঠিক নয়। ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে আমার চেম্বারে তারা অনেকেই এসেছিলেন। নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত হলে আমি গিয়ে তাদেরকে নিবৃত্ত করি।
শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করানোর অভিযোগ
৪ আগস্ট রাজশাহী নগরীর হাড়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা ফেরদৌসি তার এক নারী সহকারী শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করান। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। পরে জেলা শিক্ষা অফিস এ ঘটনার তদন্ত করে। এতে ঘটনার সত্যতা মেলে।
দুই কৃষকের আত্মহত্যা
মার্চে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুই কৃষক আত্মহত্যা করেন। রাজশাহীর বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে বোরো ধানের ক্ষেতে সেচের পানি না পেয়ে দুই কৃষক আতহত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২১ মার্চ গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মারান্ডি বিষপান করেন। পরে হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গোদাগাড়ী থানায় পৃথক দু’টি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করা হয়। পরে পুলিশ বিএমডির বরখাস্ত হওয়া অপারেটরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।