বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির একটি এলাকার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল, যা গোটা বাংলাদেশের এক-দশমাংশ। এখানে রয়েছে বিভিন্ন উচ্চতার পর্বত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও নয়নাভিরাম কাপ্তাই লেক। এ অঞ্চলে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) গঠিত হয় এবং এক পর্যায়ে সংগঠনটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি পিসিজেএসএসের সামরিক শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করে।
পরবর্তী দেড় দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ইমারজেন্সি অপারেশন পরিচালনার পাশাপাশি শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেএসএস নেতা সন্তু লারমা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন। চার দফায় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ৮৭৪টি অস্ত্র জমা দেন এবং শান্তিবাহিনীর ১ হাজার ৯৪৬ জন সদস্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্যে ৭১৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি দেওয়া হয়।
পার্বত্য চুক্তি ছিল তৎকালীন সরকার এবং জনসংহতি সমিতি উভয় পক্ষের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চুক্তির আলোকে ২৫ সদস্যের আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে, যার চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন) হিসেবে অধিষ্ঠিত জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে এবং বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বর্তমানে ওই মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
চুক্তি অনুযায়ী ৩৩টি বিভাগের মধ্যে ৩০টি ইতোমধ্যে জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণ এবং ১৫টি আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৯টি ধারা বাস্তবায়ন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ১২ হাজার ২২৩টি পরিবারের ৬৪ হাজার ৬১২ জন ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীর পুনর্বাসন সম্পন্ন করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ৮১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০৪টি উচ্চ বিদ্যালয়, ২৫টি কলেজ, ১১টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১টি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। বান্দরবানের থানচি ও রুমা সেতু এবং খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু, সীমান্ত সড়ক নির্মাণসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির পর ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার সড়ক, ৩২টি হাসপাতাল ও ২৭টি শিল্পকারখানা স্থাপিত হয়েছে।
চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ব্রিগেড ও ২৪১টি ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ৬৯টি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
স্বীকার করতে হবে, চুক্তি বাস্তবায়নের পথে এখনও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন-
ভূমি সমস্যা :২০০১ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ জারি করা হয়। কিন্তু এই ভূমি কমিশন উপজাতি নেতাদের বিরোধিতার কারণে একটিও ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তি করতে পারেনি। অবশেষে অনেকটা ছাড় দিয়ে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১৬’ পাস করা হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১৬ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও সেখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে রয়েছে উৎকণ্ঠায়।
উপদলীয় কোন্দল :পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা থাকলেও তাদের কিছু সদস্য অস্ত্র জমা না দিয়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি পিসিজেএসএস থেকে জেএসএস (সংস্কারপন্থি) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) থেকে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের সৃষ্টি হয়ে মোট চারটি আঞ্চলিক দলের আবির্ভাব হয়। বিশেষত জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফ (মূল) পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রকৃতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফ (মূল) যৌথভাবে প্রতিপক্ষ জেএসএস (সংস্কারপন্থি ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) অস্তিত্ব বিনাশে কিংবা তাদের সমঝোতায় আনতে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া রাঙামাটি ও বান্দরবানে মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এমএনপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আরও দুটি সশস্ত্র দলের আবির্ভাব হয়। বর্তমানে দলগুলো এলাকায় প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা :আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীরা সড়ক, সেতু, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে চাঁদা দাবি, মারধর, হুমকি প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে যোগাযোগ বা আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাধা :২০১৯ সালের মাঝামাঝি তিন পার্বত্য জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীরা চাঁদা দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ ছাড়া ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে থেগামুখ থেকে চট্টগ্রাম সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য সরকার জরিপ পরিচালনা করে। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
পর্যটন বিকাশে বাধা :আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী ও স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্পের বিকাশে বাধাদান অব্যাহত রেখেছে। ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কে পর্যটকবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ, ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি এলাকায় মাইক্রোবাসসহ চারজন বাঙালি পর্যটক অপহরণ এবং পর্যটক হয়রানির ঘটনা ঘটে।
উদ্ভূত সমস্যা থেকে উত্তরণে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন-
কার্যকরী ভূমি কমিশন :অতি দ্রুততার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের উদ্যোগ গ্রহণ করে ভূমির মালিকানা নির্ধারণ করা যেতে পারে, যা ভূমি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধ :পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা সশস্ত্র দলের হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে সব সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা যেতে পারে।
আর্থসামাজিক উন্নয়ন :পর্যটন শিল্প, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, আশা করা যায়। তাই পর্যটন শিল্প ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
নিরাপত্তা সক্ষমতা বৃদ্ধি :আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ও জঙ্গি সংগঠন নির্মূলে নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। ইতোমধ্যে একটি এপিবিএন ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর জনবল বাড়ানো যেতে পারে।
সমন্বিত উদ্যোগ :পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি একটি জাতীয় সমস্যা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশি-বিদেশি এনজিওর সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এই জাতীয় সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আসহাব উদদীন এনডিসি, পিএসসি: সাবেক জেনারেল অফিসার কমান্ডিং চট্টগ্রাম ও রাষ্ট্রদূত