ঢাকা ডেস্ক : সাংবিধানিক বিধান থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে দেশে নেই কোনো আইন। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এই আইন তৈরিতে কোনো সরকারই নেয়নি কার্যকর উদ্যোগ। এ ছাড়াও প্রতিবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠনের দাবি উঠলেও, সেই পথে হাঁটেনি কোনো সরকার। ফলে প্রতিটি নির্বাচন কমিশন নিয়েই রয়েছে নানা বিতর্ক।খবর সাম্প্রতিক দেশকাল
এখন পর্যন্ত গঠিত ১২টি নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সর্বশেষ দুটি কমিশন রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠন করেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে সার্চ কমিটি করার পথে এগোচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বঙ্গভবনে শুরু হওয়া সংলাপে অংশ নেওয়া সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ দলই ইসি পুনর্গঠনে আইন করার জোর দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরপেক্ষ ইসি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে রাজপথের অন্যতম বড় দল বিএনপি ‘অর্থহীন’ বলে সংলাপ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সিপিবি, বাসদ, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কিছু দল আমন্ত্রণ পেয়েও সাড়া দেয়নি রাষ্ট্রপতির ডাকে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির আহ্বান প্রত্যাখ্যান এবং সংলাপ বর্জনের এমন চিত্র রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সুশীল সমাজ ও সর্বসাধারণের মধ্যে জন্ম দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সংলাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দেওয়া জরুরিভিত্তিতে ইসি আইন প্রণয়নের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সব দল অংশগ্রহণ না করলে সংলাপের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হবে কি-না তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিয়েও দেখা দিয়েছে আগাম শঙ্কা।
সংলাপে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে যে কটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগ কমিশনই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে। স্বাধীনভাবে নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তারা কোনো কাজ করেনি। আর সংলাপে যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার কোনোটিই বাস্তবায়ন হয় না। তাদের দেওয়া কোনো প্রস্তাবের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো কমিশন গঠন করা হয়। তাই সংলাপে অংশ নেওয়া সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংলাপ বর্জনের এই চর্চাকে গণতন্ত্রের জন্য ‘খারাপ খবর’ হিসেবে অভিহিত করলেও, এতে ইসি গঠন থেমে থাকবে না শেষ পৃষ্ঠার পর
বলে জানিয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতাদের দাবি, সংলাপে না এলেও বিএনপিসহ নিবন্ধিত দলগুলো আগামী নির্বাচনে অবশ্যই অংশ নেবে।
জানা যায়, সংবিধানে একটি আইনের মাধ্যমে ইসি গঠনের নির্দেশনা আছে; কিন্তু আইন না হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। তাই দেশের রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের নিয়োগ দেন। ২০১২ সালে ইসি গঠনে একটি নতুন পদ্ধতি চালু করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তিনি সব কটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে সংলাপে ডেকেছিলেন। পরে একটি সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের প্রস্তাবিত নাম থেকে ইসি গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। তবে প্রথমবারের মতো নতুন এই পদ্ধতিতে গঠিত কাজী রকিব উদ্দীন কমিশন কোনো চমক দেখাতে পারেনি। বরং ২০১৪ সালে একটি ‘এক তরফা’ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। ওই জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ইসির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
জিল্লুর রহমানের পথ অনুসরণ করে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গঠন করেন বর্তমান কে এম নূরুল হুদা কমিশন। এরপর প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়। ওই কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, অনিয়মসহ নয়টি অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তারা এ বিষয়ে আরেকটি চিঠি দেন রাষ্ট্রপতিকে। তবে এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি।
সংলাপের শুরুর দিন ২০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। সংলাপে তারা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলেছে। দলের নেতারা জানান, এ প্রস্তাবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইন প্রণয়নের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাপা বলেছে, সংসদে এ বিষয়ে বিল উত্থাপন করা হলে তারা, সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। সময় স্বল্পতার কারণে যদি সংসদে আইন প্রণয়ন সম্ভব না হয়, তা হলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইন বলবৎ করতে পারেন। পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে তা বিল আকারে পাস করার জন্য জাপা সহযোগিতা করবে। যদি কোনো কারণে অধ্যাদেশ জারি সম্ভব না হয় এবং পূর্বের ন্যায় সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে সার্চ কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য চারজনের নাম প্রস্তাব করেছে জাপা।
২২ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় সংলাপে অংশ নেয় জাসদ। তারাও ইসি পুনর্গঠনে আইনের প্রস্তাব করেছে। ২৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সঙ্গে মতবিনিময় হয়। পরদিন ২৭ ডিসেম্বর তরিকত ফেডারেশনের সঙ্গে বিকাল ৪টায় এবং খেলাফত মজলিসের সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপ হয়। ২৯ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে সন্ধ্যা ৬টায় সংলাপ হয়। সব দলই ইসি গঠনে আইনের প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া গণতন্ত্র পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল সংলাপে ইসি গঠনে আইনের প্রস্তাব দেবে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে রাজপথের অন্যতম বড় দল বিএনপি ‘অর্থহীন’ বলে সংলাপ প্রত্যাখ্যান করেছে। সিপিবি, বাসদ, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কিছু দল আমন্ত্রণ পেয়েও সাড়া দেয়নি রাষ্ট্রপতির ডাকে। ২ জানুয়ারি গণফোরামের একটি প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নিলেও দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন যাননি।
জরুরিভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সংবিধানে প্রয়োজনে আইন করার বিধান আছে এবং আমরা তা করতেও চাই। তবে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন হওয়ায় রাতারাতি করা যাবে না।
আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার বিশদ বিবরণ দিয়ে আনিসুল হক বলেন, সংসদে উত্থাপনের আগে এটির খসড়া প্রণয়ন, মন্ত্রিসভার অনুমোদন এবং তারপর জনমত সংগ্রহের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করতে হবে। আইনের গুরুত্ব বিবেচনা করে আমাদের এই প্রক্রিয়াগুলো মানতে হবে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির চলমান সংলাপে খুব একটা আশা দেখছেন না দেশের সুশীল সমাজ ও সর্বসাধারণ। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপ খুব একটা কাজে দেবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে।’
সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে কারা থাকবেন, সে বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তারাই নিয়োগ পাবেন। বর্তমান কে এম নূরুল হুদা কমিশন আইনের সঠিক প্রয়োগ করে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা ও ভালো নির্বাচন করতে পারতো, যা বাস্তবে হয়নি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিএনপি কিংবা অন্যসব দল সংলাপে না গেলেও সরকারের কোনো সমস্যা নেই। এটি লোক দেখানো সংলাপ ছাড়া আর বেশি কিছু না। সংবিধানের ৪৮(ত) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। তিনি যেভাবে বলবেন সেভাবে। ফলে সংলাপ করে লাভ কী? কমিশন তো হবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে সংলাপ শুরু করেছেন তা নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের তেমন কোনো তাগিদ বা উচ্ছ্বাস নেই। দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন না যে, এই সংলাপে ইসি গঠনে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব কিংবা নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন বিষয়ে ইতিবাচক কোনো আলাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা যথেষ্ট নয়। অতীতে শুধু সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করে কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক ফল আসেনি।
হককথা /এমউএ