ফর্মুলা দুধ গছানোর সর্বনাশা ‘ফর্মুলা’

- প্রকাশের সময় : ১০:৫৯:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
- / ৬৫ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : ‘বাচ্চারে বুকের দুধ খাওয়াই। তারপরও ছেলেটা বাড়ে না। তাই অন্য ভাবিগোর লাহান পোলারে কৌটার দুধ খাওয়ান শুরু করছি।’ ছেলেকে বুকের দুধ খাইয়ে পুষ্ট করতে না পেরে তুষ্ট হতে পারছেন না ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গৃহিণী সাফিয়া। এ নিয়ে তাঁর হাপিত্যেশ। তবে নাদুসনুদুস মানেই যে সুস্থ শিশু নয়– এটা বোঝার চেষ্টা করেন না সাফিয়ার মতো অনেক মা।সচেতনতার ঘাটতি, শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে উৎকণ্ঠা, গ্রাম পর্যায়ে আভিজাত্য প্রমাণের চেষ্টাসহ নানা কারণে কৌটার দুধে ঝুঁকছেন মায়েরা। কৌটার দুধের বিক্রেতারা এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে ক্রেতাদের উপহার আর চিকিৎসক ও নার্সকে নানা প্রণোদনা দিয়ে আকৃষ্ট করছেন। শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুঁড়া দুধ কোম্পানি ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর এ তৎপরতা মাতৃদুগ্ধ বিকল্প আইন, ২০১৩-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার অন্তত ৫০ জন মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ মা বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ান। ২৫ শতাংশ মা শুধু কৌটার দুধ খাওয়ান। আর শিশুদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ান ১৫ শতাংশ মা। এসব মায়ের মধ্যে কেউ কেউ শিশুর বয়স ছয় মাস হওয়ার আগেই সুজি বা অন্য তরল খাবার দিতে শুরু করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের একটি জরিপে অংশ নেওয়া ৫২ শতাংশ অভিভাবক ও সন্তানসম্ভবা নারী বলেছেন, ফর্মুলা দুধ কোম্পানিগুলো তাদের বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।
চিকিৎসকরা জানান, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে অধিক প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ মায়ের শালদুধ। এতে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। মায়ের দুধে প্রায় ২০০টি উপাদান আছে, যা অন্য দুধে নেই । ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ পান করালে পানি খাওয়ানোরও প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া শিশুকে বুকের দুধ পান করালে মায়ের স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল-ইউনিসেফের তথ্য বলছে, মায়ের দুধ যথাযথ পরিমাণে পান না করায় বিশ্বে প্রতিবছর অন্তত ছয় লাখ শিশু মারা যায়। আর প্রায় এক লাখ মা মারা যান অপর্যাপ্ত স্তন্যদানের কারণে সৃষ্ট অসুস্থতায়। এতে বছরে ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো আর্থিক ক্ষতি হয়।
কেন কৌটার দুধে আগ্রহ
শিশু ঠিকমতো বুকের দুধ পাচ্ছে না, ওজন বাড়ছে না, একটু অভিজাত ভাব আনা, কর্মজীবী নারী হওয়াসহ কয়েকটি কারণে মায়েরাও সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। সেই সঙ্গে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা কৌশলও মায়েদের দ্বিধায় ফেলে। শিশুদের বুকের দুধ পান নিশ্চিত করতে মায়ের দুধের পরিপূরক বিকল্প শিশুখাদ্য বিক্রয় ও বিপণন আইন আছে। তবে সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করার প্রচারণা তত জোরালো নয়।
সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা
‘আমার বাবু কিছু খায় না। এখন ভাবছি কৌটার দুধ দেব। কিন্তু কোন দুধ খাওয়াব?’ বেবি ফুড বাংলা নামে এক ফেসবুক পেজে কৌটার দুধ নিয়ে এক বিজ্ঞাপনে মুন্নী আক্তার নামের একজন মা এই প্রশ্ন করেছেন। শুধু অনলাইনে নয়, বিভিন্ন হাসপাতালের শিশু বিভাগ ঘুরে মায়েদের মধ্যে এই উদ্বেগ দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস সভাপতি ও সিনিয়র শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘বাচ্চা কিছু খায় না’, ‘বাচ্চা শুকনো’– এগুলো একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা । শিশু যদি প্রাণবন্ত থাকে, খেলাধুলা করে– দেখে পাতলা মনে হলেও ধরে নিতে হবে তার যথেষ্ট শক্তি আছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। কৈশোর বয়সে এসব শিশুর রোগ কম হবে। তিনি বলেন, সচেতনতার অভাব এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মায়েদের বোঝাতে পারে না বলেই এ ধরনের ভাবনা কাজ করে । তাই যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে যে, মায়ের বুকের দুধের বিকল্প কিছু নেই।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগীয় প্রধান শিশু বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, কৌটার দুধ খেলে শিশু মোটা হয়। তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শিশুস্বাস্থ্যে। ধীরে ধীরে শিশুদের কিডনির কার্যকারিতা কমাসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়। তিনি বলেন, শিশুদের গরুর দুধও খাওয়ানো ঠিক নয়। কারণ গরুকে মোটাতাজা ও রোগমুক্ত রাখতে বিভিন্ন ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন আবার গরুর দুধ বাড়াতে এক ধরনের ইনজেকশনও দেওয়া হচ্ছে। ফলে মায়ের দুধ ছাড়া শিশুদের জন্য ভালো কোনো বিকল্প নেই।
বাল্যবিয়েতে সর্বনাশ
রাজমিস্ত্রি জসীমের সঙ্গে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় সাভারের কলমপুরের বীথির। বিয়ের পরপর প্রসবের সময় মারা যায় প্রথম সন্তান। পরের বছর কোলজুড়ে আসে মেয়েসন্তান। দু’বছর পর আবার সন্তানসম্ভবা হন বীথি। এবার বাসায় ছেলেসন্তানের জন্ম দিলেও অপুষ্টির কারণে ছয় দিন পরই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। নবজাতক মায়ের দুধ না পাওয়ায় চিকিৎসক ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। ১৫ মাস বয়সী ছেলে জিহাদকে নিয়ে গত ২৫ মে ঢাকার শিশু হাসপাতালে এসেছিলেন বীথি। হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রে বসে এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, ছেলে অপুষ্টি নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। সঙ্গে ছিল নিউমোনিয়া। তখন থেকেই ছেলের পুষ্টি বাড়াতে ফর্মুলা দুধ বেছে নেন। গত সপ্তাহে ছেলের জ্বর হয়। খিঁচুনি ওঠে। তাই ঢাকায় ছুটে এসেছেন। বীথির স্বামী জসীম বলেন, ‘৭০০-৮০০ টাকা খরচ কইরা কৌটার দুধ কিনি, ৩-৪ দিনের মধ্যেই শেষ হইয়া যায়। এই ১৫ মাসে পুলার লাইগা ৫-৬ লাখ টাকা খরচ কইরা ফেলছি। তাও পোলার শরীর ভালা অইতাছে না।’
খিঁচুনি আক্রান্ত ১২ মাস বয়সী মালিহাকে নিয়ে একই হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছিলেন তার মা-বাবা। মালিহার মায়ের বয়স এখনও ১৮ পার হয়নি। তিনি জানান, মালিহার জন্মের পর বুকে দুধ আসছিল না। পরে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে মেয়েকে কৌটার দুধ খাওয়ানো শুরু করেন। কৌটার দুধ খাওয়াতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানা রোডের দি চাইল্ড পয়েন্ট-১ ডক্টরস চেম্বারস অ্যান্ড পটুয়াখালী ফার্মেসির ডা. এ আর এম সাখাওয়াত হোসেন। জানতে চাইলে মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘সাধারণত মায়ের বুকের দুধের বিকল্প হিসেবে কোনো খাবারের কথা বলি না। যেসব মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে সমস্যা হয়, তাদের বিভিন্ন নিয়ম দেখিয়ে দিই। সময় দিই। তাও যদি শিশু বুকের দুধ না পায়, তাহলে কৌটার দুধের কথা বলি।’
বাল্যবিয়ের প্রভাব সম্পর্কে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও মেরি স্টোপস বাংলাদেশের লিড অব অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন মনজুন নাহার বলেন, বাল্যবিয়ের কারণে মা নিজেই শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকায় অপুষ্টিসহ নানা ধরনের জটিলতায় ভোগেন। অনেক মায়ের দুধের ঘাটতিও দেখা যায়। ফলে পরিবারের অন্যদের চাপে, অনেক ক্ষেত্রে মা নিজেও বাচ্চাকে কৌটার দুধ খাওয়ানো শুরু করেন।
আভিজাত্যের প্রতীক
সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত বিশ্বনাথ অন্য উপজেলার চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর। প্রযুক্তির সাহচর্যে থাকায় স্থানীয়রা তুলনামূলকভাবে সচেতন। তবু সেখানকার অনেক মা সন্তানকে কৌটার দুধ খাওয়াতে আগ্রহী। গৃহিণী আলেয়া বেগম বলেন, অনলাইন, ইউটিউবেও শিশুখাদ্য হিসেবে কৌটার দুধের বিজ্ঞাপন দেখেন তাঁরা। তাই এখানকার অধিকাংশ মা বুকের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ান। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের গৃহিণী সাহিদা সুলতানা সন্তানকে বুকের দুধের পাশাপাশি কৌটার দুধ খাওয়ান। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাচ্চারা কৌটার দুধ খায়, তাহলে আমার বাচ্চা কেন খাবে না?’
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, জন্মের পরপর নবজাতককে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়াতে হয়। এ সময়ে পানি, মধু ও চিনি কোনোটাই মুখে দেওয়া যাবে না। প্রথম ছয় মাস এভাবে চলবে। শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর শারীরিক প্রবৃদ্ধি ও মানসিক গুণাবলি ভালো থাকবে। মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়ে ওঠা সন্তানদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে। পরবর্তী দুই বছরও শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো যায়। তবে ৬ মাস পরে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার হিসেবে খিচুড়ি, সুজি ও ফল খাওয়াতে হবে।
কর্মজীবী মায়েরা বাধ্য হন
দিনের বেশিরভাগ সময় কাজের কারণে ঘরের বাইরে থাকায় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না কর্মজীবী মায়েরা। এ কারণে তাঁরা ঝুঁকছেন কৌটার দুধের দিকে। নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষিকা পারভীন আক্তার জানান, তাঁকে সকাল ৭টার দিকে বের হতে হয়। দুপুর পর্যন্ত তিনি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না। বাধ্য হয়ে কৌটার দুধ খাওয়ান।
সরকারি নিয়ম অনুসারে, সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হলেও বেশিরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চার মাসের বেশি এই ছুটি দেওয়া হয় না। ফলে মায়েরা শিশুদের কৌটার দুধ খেতে অভ্যস্ত করেন। এমনই এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফারহানা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র চার মাস হওয়ায় বাধ্য হয়েই সন্তানকে শুরু থেকে কৌটায় অভ্যস্ত করাতে হচ্ছে। আরও কয়েকজন চাকরিজীবী মায়ের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, সন্তানের জন্য বোতলে বুকের দুধ সংরক্ষণ করেন, যা তিন ঘণ্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যায়। তবে ফ্রিজে রাখলে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে।
যেভাবে প্রভাবিত করে কোম্পানিগুলো
পুষ্টিসেবা কার্যক্রমের আওতায় ডাক্তার-নার্সদের নানা পুরস্কার, উপহার এবং কোনো কোনো চিকিৎসক-নার্স মাসিক, আবার কেউ বছরে আর্থিক সুবিধা পান বিভিন্ন গুঁড়া দুধ কোম্পানি ও বিপণন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। কোম্পানিগুলো প্রকাশ্যেই আয়োজন করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার। তাদের দিবসকেন্দ্রিক বিভিন্ন আয়োজনেও বুঝে বা না বুঝে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক-নার্সরা অংশ নেন। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েই ব্যবস্থাপত্রে শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ার নির্দেশনা দেন চিকিৎসকদের কেউ কেউ।ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে বহু মধ্যবিত্ত পরিবার এখন সুপারশপ থেকে বাজার করে। এসব সুপারশপ ঘুরে দেখা যায়, গুঁড়া দুধের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের সঙ্গে বিভিন্ন উপহার দিচ্ছে। কৌটা কিনলে গ্লাস, বাটি। টাকাও ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথভাবে পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের নারীরা অন্য দেশের তুলনায় ফর্মুলা দুধের প্রথাগত বিপণনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত নন। তাঁরা মূলত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও অনেক বিপণন কর্মীর মাধ্যমে প্রভাবিত হন। মায়েরা বুকের দুধকে অপর্যাপ্ত মনে করেন বলেই শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ান।
জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে একজন পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে প্রায় ৬০ শতাংশ মাকে ফর্মুলা দুধ সুপারিশ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, ৯৮ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারী স্তন্যপান করানোর প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করলেও শুধু ৬৫ শতাংশ সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেই তা করে থাকেন। ওই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ইউনিসেফ বাংলাদেশের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ ভিরা মেন্ডনকা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সিংহভাগ নারী বুকের দুধ খাওয়াতে চান, তবু প্রায়ই তাঁরা প্রয়োজনীয় সহায়তা পান না। ফলে ফর্মুলা দুধের বাজারজাতকরণ তাঁদের মনে ভয় ও সন্দেহের বীজ বপন করে। এটি শুধু তখনই কাটিয়ে উঠতে পারে, যখন মায়েদের বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তথ্য দেওয়া হয় যে, ফর্মুলা দুধ ক্ষতিকর।’প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ছয় মাসের কম বয়সী মাত্র ৪৪ শতাংশ শিশুকে শুধু বুকের দুধ পান করানো হয়। গত দুই দশকে বিশ্বজুড়ে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার খুব কম বেড়েছে। আর ফর্মুলা দুধের বিক্রি একই সময়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
ধুন্ধুমার কেনাবেচা
গত ২১ এপ্রিল থেকে ২১ মে পর্যন্ত মাত্র এক মাসে রাজধানীর সুপারশপ প্রিন্স বাজারের শ্যামলী শাখাতেই শিশুখাদ্য হিসেবে ৯৩ হাজার ফর্মুলা দুধের কৌটা বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ল্যাকটোজেন ৩ বিআইবি বিক্রি হয় ১৩ হাজার, নান অপটিপরো ২ বিক্রি হয় ৯ হাজার কৌটা, ল্যাকটোজেন ২ বিআইবি বিক্রি হয় ৭ হাজার কৌটা, সেরেলাক ফ্রুটস মাল্টিগ্রেইনস বিক্রি হয় ৫ হাজার কৌটা।
প্রিন্স বাজার লিমিটেডের হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মামুন সমকালকে বলেন, শ্যামলীর এই শাখাসহ রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর শাখায়ও শিশুখাদ্য হিসেবে কৌটার দুধ ভালো বিক্রি হয়। তিনি জানান, প্রিন্স বাজারের প্রতিটি শাখায় সব পর্যায়ের ক্রেতার সমাগম ঘটে। প্রতিদিন ১৫ শতাধিক ক্রেতা কেনাকাটা করেন। কৌটার দুধের ক্রেতাদের মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত– সবই আছেন।
রাজধানীর মগবাজারের আশপাশে প্রায় ছয়টি হাসপাতাল রয়েছে। বড়-ছোট মিলিয়ে ফার্মেসি রয়েছে প্রায় ১০০টি। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও রয়েছে অনেক। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাস এ এলাকায়। মগবাজার মূল সড়কের পাশেই ফাইন ফার্মা লিমিটেড। ওষুধসহ শিশুর ব্যবহৃত সব পণ্যই এখানে বিক্রি হয়। এই প্রতিষ্ঠানের সেলস এক্সিকিউটিভ সজীব জানান, এ এলাকায় ফর্মুলা দুধের চাহিদা বেশি। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫০ হাজার টাকার কৌটার দুধের অর্ডার দিতে হয়। গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির ৬২ হাজার কৌটার দুধ বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের প্রধান বাজার মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট। এখানে রয়েছে অন্তত ২৫টি ফার্মেসি। আছে ৫০টির মতো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। দোকানিরা জানান, প্রতিটি দোকানে সপ্তাহে শতাধিক ফর্মুলা দুধের কৌটা বিক্রি হয়। কোনো কোনো দোকানে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নেসলে কর্নারও তৈরি করে দিয়েছে। এ মার্কেটের সানমুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্ণধার চান মিয়া বলেন, ‘বাচ্চাগো কৌটার দুধ না খাওয়াইলে সম্মানে বাধে, মোটাতাজা মানেই তারা মনে করে শিশু সবল আছে।’ তিনি জানান, তাঁর দোকানে সপ্তাহে নেসলে কোম্পানির কৌটার দুধ বিক্রি হয় শতাধিক। অন্য কোম্পানির কৌটার দুধ বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০টি। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনেই খান মেডিকেল হল। ফার্মেসির মালিক আহসান আহমেদ বলেন, ‘ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবস্থাপত্র দেখেই আমরা কৌটার দুধ দিই।’
মাতৃদুগ্ধ আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই
‘মাতৃদুগ্ধ আইন’-এর ধারা ৪-এর (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মায়ের দুধের বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা এসব ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিপণন, বিক্রয় বা বিতরণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন মুদ্রণ, প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশ করবেন না বা অনুরূপ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন না।’ একই ধারার (২) উপধারা অনুযায়ী, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে– ক) জনগণের, বিশেষত স্বাস্থ্য, পুষ্টি বা শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি, ছাত্রছাত্রী বা তাদের পরিবারের কোনো সদস্যের কাছে এমন কোনো লিফলেট, হ্যান্ডবিল বা অনুরূপ কোনো দলিল বিতরণ করা যাবে না; যাতে মায়ের দুধের বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা এসব ব্যবহারের সরঞ্জামের বিজ্ঞাপন রয়েছে।
খ) মায়ের দুধের বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা এসব ব্যবহারের সরঞ্জামের বিক্রয় উৎসাহিত বা প্রলুব্ধ করার লক্ষ্যে– (অ) কোনো ব্যক্তিকে উপহারসামগ্রী, ডিসকাউন্ট কুপন, মূল্যহ্রাস বা বিনামূল্যে কোনো সামগ্রী দেওয়া বা দেওয়ার প্রস্তাব করা, (আ) এসবের প্রস্তুতকারকের আয়োজিত বা তাদের সহায়তায় আয়োজিত সেমিনার-কনফারেন্স, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, বৈজ্ঞানিক সভা, শিক্ষা সফর বা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানসহ উচ্চ শিক্ষায় বা গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা স্বাস্থ্যকর্মীকে আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা দেওয়া, (ই) কোনো স্বাস্থ্যকর্মী বা তার পরিবারের কোনো সদস্যকে আর্থিক প্রলোভন বা উপহার দেওয়া, (ঈ) কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা ওষুধ বিক্রয়কেন্দ্র ব্যবহার করা, (গ) শিশুদের জন্য কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠানের আয়োজন বা অন্য কোনো সহায়তা দেওয়া।
করণীয়
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ এবং অংশীদাররা সরকার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং শিশুখাদ্য তৈরি খাতের প্রতি আক্রমণাত্মক উপায়ে ফর্মুলা দুধ বিপণন বন্ধ করতে এবং এ সংশ্লিষ্ট কোড বা নীতিমালা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন ও মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে ফর্মুলা দুধ উৎপাদন খাতের দাবি নিষিদ্ধ করাসহ আন্তর্জাতিক বিধিমালার সঙ্গে সংগতি রেখে ফর্মুলা দুধ উৎপাদন খাতের প্রচারণা ঠেকাতে আইন পাস, পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগ করা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যাপ্ত সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং শিশুকে ভালোভাবে মায়ের দুধ খাওয়াতে সহায়তা করতে নীতিমালা ও প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা।
বৈশ্বিকভাবে বিধিমালা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদের অধ্যাদেশ সম্পূর্ণ মেনে চলার বিষয়ে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো। নবজাতক ও ছোট শিশুদের জন্য খাবার বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৃত্তি, পুরস্কার, অনুদান, মিটিং বা ইভেন্টের মতো স্পন্সরশিপ গ্রহণে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া।
কারা কী বলছেন
বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন বলেন, বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনো চিকিৎসক কোম্পানির দেওয়া উপহার নিতে পারবেন না। যেতে পারবেন না তাদের কোনো আয়োজনে। তবে অধিকাংশ শিশুস্বাস্থ্য চিকিৎসক এটা মানছেন না। রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতালে গুঁড়া দুধের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রথমত স্বাস্থ্য পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের নৈতিকতাকে জাগ্রত করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আইন মানতে হবে। হাসপাতালে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। প্রশাসনিকভাবে কঠোর অবস্থান নিলেই শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়বে। সূত্র : সমকাল
সুমি/হককথা