প্রলোভনে নিপীড়নের শিকার নারীরা
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৪:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৩
- / ৯৭ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : ২২ বছরের মিষ্টি চেহারার মেয়েটি কয়েক দিন ধরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিত্সা নিচ্ছেন। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমিক তাকে দিনের পর দিন ধষর্ণ করেন।
স্বামীই ওসিসিতে নিয়ে আসেন আরেক নারীকে চিকিত্সার জন্য। এই নারীকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। এমন অভিযোগসহ অপ্রাপ্ত বয়সে ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ ও শিশু ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে গত চার বছরে ২ হাজার ৫৭৫ জন এই সেন্টারে ভর্তি হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, এই সেন্টারের আউটডোরেও প্রতিদিন যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার একাধিক নারী চিকিত্সা নিতে আসেন। চার বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে অনেক গুণ।
তাদের মতে, মামলা বেশির ভাগই সমঝোতা হয়। আর নারী অধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের মতে, রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মহল সব সময় নারীর যৌন নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত হয় বলে বিচার পায় না। সাক্ষীর অভাবে অনেক মামলা সমঝোতায় শেষ হয়। এ বিষয়ে আইন প্রণেতাদের নজরদারির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তারা। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল জানায়, সরকার আইনকে সময়োপযোগী করাসহ নারীর সুবিচারের ব্যবস্থায় সচেষ্ট। এ অবস্থায় আজ ২৫ নভেম্বর ‘নারীর জন্য বিনিয়োগ সহিংসতা প্রতিরোধ প্রতিপাদ্য’ করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস এবং আজ থেকেই শুরু হচ্ছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ।
কিছু তথ্য
এক ভুক্তভোগীর আত্মীয় জানান, কোচিং করতে গিয়ে এক ছেলের সঙ্গে তাদের ১৫ বছরের মেয়ের প্রেম হয়। ছেলেটি মেয়েকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে ধষর্ণ করে। তারা মামলা করেন। পুলিশ মেয়েকে উদ্ধার করলে তারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক টেস্ট করতে আসেন। ঢামেকের ওসিসি নথি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে মোট ৭১৮ জন সেবা নেয়, যার মধ্যে ৬৬৩ জন যৌন ও ৫৩ জন শারীরিক এবং দুই জন পোড়া রোগী ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৪৮০ জন সেবাগ্রহীতার মধ্যে ৪১৬ জন যৌন, ৩৪ জন শারীরিক ও এক জন পোড়া রোগী ছিল। কোভিডের সময় এই সংখ্যা আরো বেশি ছিল। ২০২০ সালে চিকিত্সায় মোট ৯২১ জন রোগীর মধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার রোগী ছিল ৮৫৩ জন। এ সময় শারীরিক নির্যাতনে ৬৬ জন এবং দুই জন পোড়া রোগী সেবা গ্রহণ করে। ২০২১ সালে মোট ৬৭৬ জনের মধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার ৬৪৩ জন, এ সময় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ৩২ জন এবং এক জন পোড়া রোগী পাওয়া যায়। এই চার বছরে আউটডোরে সেবা নেয় ১ হাজার ৯১৭ জন।
সংশ্লিষ্টরা যা বলেন
ঢামেকের ওসিসি কো-অর্ডিনেটর ডা. আফরোজা বেগম ইত্তেফাককে বলেন, তিনি ২০১০ সাল থেকে এখানে কর্মরত আছেন। ২০১৭-১৮ সাল থেকে শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে যৌন নির্যাতনের ঘটনা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অল্প দিনের প্রেমের সম্পর্কে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পরে বাবা-মা মামলা করেন। তিনি বলেন, পরকীয়া, বিয়ের প্রলোভন, চাকরির প্রলোভনে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। আর পরকীয়া, যৌতুক, বহুবিবাহ—এমন কারণে শারীরিক নির্যতনের ভুক্তভোগীরা আসেন।
তিনি বলেন, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারে এসব ঘটনা বেড়ে যায়। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৮-এ একটি ধষর্ণের মামলার শুনানি চলছে (সোমবার)। কামরাঙ্গীরচরের এক স্কুলছাত্রীকে পাঁচ যুবক ধর্ষণ করেন। ২০১৯ সাল থেকে মামলা চলছে বলে জানান সরকারি বিশেষ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমান সময়ে নারী ও শিশু উভয়ের প্রতি যৌন নির্যাতনের মামলা বেড়েছে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে প্রতিদিনই পাঁচ-সাতটি ধর্ষণের মামলা থাকে। এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তির জন্য সাক্ষী বড় অন্তরায় বলে তিনি উল্লেখ করেন। আর প্রভাবশালী মহলের চাপে মামলার বিচার পায় না ভুক্তভোগী বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ফাউন্ডেশন ফর ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফ্লাডের চেয়াপারসন অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
তিনি বলেন, ‘এই মামলাগুলোর বিচার পেতে হলে আমাদের আরো বেশি জুডিশিয়ারি একটিভ হতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আসামি প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক দলের হলে যে-ই হোক না, তার পক্ষে রায় বা জামিন হয়। এক্ষেত্রে আমি যতই পড়াশোনা করে মামলা পরিচালনা করি কিংবা যতই অভিজ্ঞ হই, তার কোনো সুফল থাকে না। এ বিষয় আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদ সদস্যদের নজরদারি প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে নারী সংসদ সদস্যরা নারী নির্যাতন নিয়ে সংসদে কোনো কথা বলেন না। ফলে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনাও হয় না।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মালটিস্টোরাল প্রকল্প পরিচালক ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের আইনীি ও মানসিক সহযোগিতার জন্য সরকার ১৪টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ৪৭টি জেলা হাসপাতাল, ২০টি উপজেলা হাসপাতালে মোট ৬৭টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ওসিসি করেছে। এখানে চিকিত্সা, কাউনসেলিং ও আইনি সেবা দেওয়া হয়। আদালতে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব আমরা পালন করি। আদালতের সিদ্ধান্তে আমরা কিছু বলতে পারি না।’ তিনি বলেন, সরকারে নারীকে সহযোগিতার জন্য সম্প্রতি সাক্ষ্য আইনে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক
হককথা/নাছরিন