ঢাকা: নির্বাচন, সংলাপ, মিছিল-মিটিংয়ের অধিকার, খুন-গুম বন্ধ ও রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা- এসবই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চাওয়া। সমাধানের উদ্যোগে, সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে- এমন দাবি তার। এগুলো খালেদার শুক্রবারের (১৩ মার্চ) সাংবাদিক সম্মেলনটির মূল উপজীব্য, যা একরাশ হতাশা দিয়েছে আগ্রহীদের। কারণ অসংখ্যবার এসব কথা খালেদার মুখ থেকে শুনেছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে শুক্রবারের সম্মেলনের কথা জানানো হয়। এরপর শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলছিলেন, কর্মসূচি বদলাবেন তিনি। কেউ বা বলছিলেন, অসহযোগ দিয়ে বসবেন না তো আপসহীন নেত্রী!
কারো কারো মন্তব্য ছিল- খালেদা নিজের বিরুদ্ধে চলমান মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, কার্যালয় তল্লাশির নির্দেশ নিয়ে নিজের অবস্থান জানাবেন। আবার কেউ কেউ বলছিলেন- খালেদাকে ভদ্রলোকের মতো আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাগুলোর দাঁতভাঙা জবাব নিয়ে আসছেন খালেদা।
পত্রিকাগুলো নানা ভবিষ্যৎবাণী ছাপিয়ে পাঠকের আগ্রহ ও কৌতূহল মেটাতে চেয়েছে। তাতে আগ্রহ কারো কারো আরও বাড়ে খালেদার সম্মেলনটির প্রতি। তবে সাংবাদিক সম্মেলন শেষে সেরকম নতুন কিছু পাননি বলে হতাশ আগ্রহীরা! এদিন বিকেলে গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে নির্ধারিত সময়ের পৌনে এক ঘণ্টা পর এসে শুরু করলেন বক্তব্য।
সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকরা কেবল শ্রোতা: নাম সাংবাদিক সম্মেলন। তবে ছিল না কোনো প্রশ্নোত্তর পর্ব। এটি না রাখায় এর আগেও অনেক সমালোচিত হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এবারও তাই করলেন। বক্তব্য শুরুর আগেই তার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিলেন, এই সম্মেলনে কোনো প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকছে না। বিরক্ত হলেন বেশিরভাগ সাংবাদিক। মানুষের মনে উত্থাপিত হাজারটি প্রশ্নের জবাব সাংবাদিকদের মাধ্যমেই জানবে সবাই, সেই সাংবাদিকরা শুধু শ্রোতা হতে কেন আসবেন?- এমনটাই তাদের মন্তব্য।
অনেকেই বলছিলেন, তাহলে প্রতিদিনের মতো বিবৃতি পাঠিয়ে দিলেই তো হতো, রাস্তায় গেটের বাইরে দেড়ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঢোকার কী প্রয়োজন ছিল! অন্যরা অবশ্য ধৈর্য্যশীল। তারা মেনেই নিলেন। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির এসব আচরণে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
পুরনো স্ক্রিপ্টের কাট-পেস্ট!: খালেদার বক্তব্য শুরু হলো। লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেন তিনি। পুরো ৪৫ মিনিটের বক্তব্য শুনিয়ে রাজনীতি সচেতনদের অনেকেই পুরনো সাংবাদিক সম্মেলনগুলোর ছবি চোখে ভাসালেন। এ যেন খালেদার ৩১ ডিসেম্বর ও ১৯ জানুয়ারীর সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্যের নতুন পাঠ। ৩১ ডিসেম্বরের বক্তব্যের সঙ্গে একটু বেশি মিল পাওয়া যাচ্ছিল।
উপস্থিত সাংবাদিক ও টেলিভিশনের লাইভ টেলিকাস্ট উপভোগ করা মানুষদের অনেকেরই প্রতিক্রিয়া বিস্ময়সূচক। এতোদিন পর খালেদা গণমাধ্যম কর্মীদের ডেকে দেশবাসীর কাছে ঠিক কোন কথা নিয়ে এসেছেন- তা বুঝতে পারছিলেন না কেউ কেউ। একজন সিনিয়র টিভি সাংবাদিক তাই ঠাট্টা করে বলেই ফেললেন, ‘খালেদা জিয়া আসলে এক কথার মানুষ, সব সাংবাদিক সম্মেলনেই তিনি একই কথা বলছেন।’ অপর সাংবাদিক পাশ থেকে পাল্টা মন্তব্য করেন, ‘হয়তো পুরনো কোনো স্ক্রিপ্ট হাতে বসেছেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কাট-পেস্ট করে দেওয়া হয়েছে, তার হাতে পুরনো বক্তব্যগুলোরই এক সারমর্ম।’
নেই কোনো দিক নির্দেশনা: খালেদার বক্তব্যে বিএনপিপন্থিরা পাননি কোনো নতুন দিক-নির্দেশনা, বিপরীতপন্থিরা পাননি কর্মসূচি প্রত্যাহারের সুখবর বা সম্ভাবনা। যা যেমন ছিল, তা তেমনই রইলো- নতুন কিছুই আসেনি। হরতাল-অবরোধ যেমন চলছে, তেমনই চলবে বলে জানালেন খালেদা। ‘যৌক্তিক পরিণতি’র কথা বললেন ১৯ জানুয়ারীর মতো। সেই যৌক্তিক পরিণতির ব্যাখ্যায় সংলাপ ও নির্বাচনের দাবিটিই বুঝে নিতে হচ্ছে সবাইকে।
নাহ! স্ক্রিপ্ট নতুনই ছিল!: এক পর্যায়ে দলের যুগ্ম-মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ ও নাগরিক ঐক্যের আহ্ববায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার নাম উচ্চারণ করলেন খালেদা। সন্দেহ করছিলেন যারা, তারা বুঝলেন, নতুন স্ক্রিপ্টই খালেদার হাতে। কারণ এর আগে খালেদার সাংবাদিক সম্মেলনটি হয়েছে ১৯ জানুয়ারী। মান্না ও সালাউদ্দিনের ঘটনা ঘটেছে তারও অনেক পরে। সালাউদ্দিনের ফেরত দাবি করলেন খালেদা ও মান্নার খোঁজ দেওয়ার বিষয়টিকে সরকারের নাটক বলে আখ্যা দিলেন।
এবারও দফা-শর্ত: এবার শর্ত কমিয়ে এনেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সরকারের প্রতি গত ৩১ ডিসেম্বর দিয়েছিলেন সাত দফা। এবার তিনি তিন-চার দফায় রফা করলেন। যার প্রতিটি কথাই ছিল পুরনো, সেই সাত দফারই সারমর্ম। এরআগেও অসংখ্যবার দাবি, শর্ত বা দফা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যার ফলাফল খালেদা পাননি। সরকার গুরুত্ব দেয়নি তার চাওয়ায়, ‘প্রতিশ্রুতি রাখেননি শেখ হাসিনা’- শুক্রবারও বলেছেন খালেদা।
অপরিবর্তিত চাওয়া: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন হয়ে গেলে বিএনপির মাথায় হাত পড়ে। নির্বাচনের পর ১৫ জানুয়ারী হোটেল ওয়েস্টিনে সাংবাদিক সম্মেলন করেন খালেদা জিয়া। নতুন সরকারকে ‘অবৈধ’ বলেন। এবারও একই আখ্যা। এর পরের ৪ ফেব্রুয়ারী একই হোটেলে অপর সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচন চাইলেন তিনি। সেবারও চাইলেন সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন এবং সেটি যেন দ্রুত সময়েই হয়।
সম্মেলনটির উদ্দেশ্য কী ছিল?: খালেদার একনিষ্ঠ ভক্তরা মোটেই অর্থহীন বলছেন না এই সাংবাদিক সম্মেলন। তারা বলছেন, জোটের নেতা-কর্মীরা নানা প্রতিকূলতায় দিন কাটাচ্ছেন। নিজের পুত্র হারানোর শোক ঢেকে স্বাভাবিকতা রেখে খালেদা বোঝাতে চেয়েছেন, রাজনীতি অনেক কষ্টের বিনিময়েই করে যেতে হয়। আন্দোলনকারীদের সাধুবাদ জানানোর জন্য একটি সম্মেলন দলনেতা হিসেবে তিনি করতেই পারেন। এই ভক্তরা আরও বলছেন, কার্যালয়ে দুই মাসেরও বেশিদিন থেকে তিনি একই রকম রয়েছেন বলে সরকার ও অন্যদের দেখাতে চেয়েছেন। তাকে যেন কেউ দুর্বল না ভাবে। কেউ আবার বলছেন, জঙ্গিবাদের অপবাদ থেকে পরিত্রাণ পেতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে চেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
ইতিবাচক মনোভাবের এক প্রবীণ সাংবাদিক প্রথমে কড়া সমালোচনা করলেন খালেদার। একটু পরেই নরম সুরে বললেন, খালেদা গণমাধ্যমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ ও গণমাধ্যমের সহযোগিতা ধরে রাখতে সম্মেলনটি ডেকেছেন। যদিও প্রশ্নের জবাব দিয়ে বিপাকে পড়তে চাইলেন না, তবু নিজের অসহায়ত্বটুকুই যেন দেশবাসীকে দেখাতে চাইলেন ক্যামেরার চোখে।
কার্যালয়ে কতদিন থাকবেন খালেদা, আত্মসমর্পণ করবেন কি-না, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কী ভাবছেন, এই হরতাল-অবরোধ আর কতদিন চলবে- এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত। তাই যেই তিমিরে, সেই তিমিরেই রইলেন দেশের সর্বসাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৫