নিউইয়র্ক ০১:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

পাচার করা অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও একাধিক বাড়ি কিনে বসবাস করছেন সাউথ বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন : সপবিবারে পলায়ন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:১৫:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩
  • / ৩৯ বার পঠিত

শাহেদ আলী ইরশাদ: ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা মেরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন। পাচার করা অর্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়াও একাধিক বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস করছেন। নানা রকম জালিয়াতির মাধ্যমে আমানতকারীদের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও বিভিন্ন দেশে পাচারের তথ্য উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে।
এস এম আমজাদ হোসেন

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন লকপুর গ্রæপের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি চার ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। ব্যাংকের টাকা তিনি একা মারেননি, এ কাজে ব্যবহার করেছেন স্ত্রী, কন্যা, ভাতিজি ও লকপুর গ্রæপের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও। এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন ব্যাংকটির খুলনা ও কাটাখালী শাখা থেকে নামে-বেনামে প্রায় ২৭২ কোটি টাকা সরিয়েছেন। ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে টাকা তোলার পাশাপাশি কর্মচারীদের নামেও তিনি ঋণ নিয়েছেন। আবার করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা তহবিল থেকেও শ্রমিকদের বেতনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে অতিরিক্ত টাকা তুলেছেন। এস এম আমজাদ হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলনা ও বাগেরহাটের কাটাখালীকেন্দ্রিক হওয়ায় তিনি ঢাকার কোনো শাখায় অনিয়ম না করে বেছে নিয়েছেন খুলনা ও কাটাখালী শাখাকে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানান, এস এম আমজাদ হোসেনের ভাতিজি মাহফুজা খানম রিশাকে চেয়ারম্যান করে গঠিত কোম্পানি আলফা এক্সেসরিজের নামে ৪৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয় ব্যাংকটির ৪৫তম পর্ষদ সভায়।
আলফা এক্সেসরিজের নামে নেওয়া ঋণের পুরো সুবিধাভোগী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন লকপুর গ্রæপ। আলফা এক্সেসরিজকে সব মিলিয়ে ২০০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দিয়েছে এসবিএসি ব্যাংকের কাটাখালী শাখা। ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। ২০১৬ সালের ২ জুন এস এম আমজাদ হোসেন খুলনা বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে ৩০ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। খুলনা বিল্ডার্সের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক আমজাদ। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের নামে। নথিপত্রে খুলনা বিল্ডার্সের ব্যবসার ধরন হিসেবে নির্মাণ ও আমদানি-রপ্তানির কথা বলা হলেও সেখানে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন এসবিএসি ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রæয়ারী লকপুর গ্রæপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে ২২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের জোগান দেওয়া হয় সাউদার্ন ফুড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে, যেটির চেয়ারম্যান আমজাদের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। আর তার ভাই এস এম আবুল হোসেন আছেন প্রতিনিধি হিসেবে। কাটাখালী শাখায় এস এম আমজাদের নামে ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঋণ রয়েছে। সেটিও এখন খেলাপি। এস এম আমজাদ হোসেন ও এসবিএসি ব্যাংকের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন মিলে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে নিজেদের ব্যাংকের বিজয়নগর শাখা থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণের ৮ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন।
এস এম আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে শেয়ার বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিজ ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি আরও তিনটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৭১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন আমজাদ হোসেন। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখা থেকে লকপুর গ্রæপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন পলিমারের নামে ১৫১ কোটি, মুনস্টার পলিমারের নামে ৯০ কোটি ৮১ লাখ ও বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিংয়ের নামে ৯৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণের পুরোটাই খেলাপি। এই অর্থ আদায়ে মামলাও করেছে ব্যাংক। দেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংক থেকে ‘রূপসা ফিশ কোম্পানি’ নামে লকপুর গ্রæপের অন্য এক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৩৭৪ কোটি টাকার ঋণপত্র খুলে পুরোটাই পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন। এসব ঋণের টাকা তিনি পরিশোধ করছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন। আমেরিকা, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। পাচার করা অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে টাকা সরিয়েছেন। এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা সদর ও কাটাখালী শাখা ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি এবং ঋণের আড়ালে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতির মাধ্যমে আমানতকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন আমজাদ হোসেন। বতর্মানে আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ৮২৯ কোটি টাকা জালিয়াতির অনুসন্ধান করছে দুদক। বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর আমজাদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৯৩৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৯টি ব্যাংক হিসাবে কোনো অর্থ নেই। শূন্য ব্যালান্সের হিসাবগুলোর প্রতিটিতেই কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। শত কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও অনেক। বাকি ২৫৬টি অ্যাকাউন্টে থাকা ৫৫ কোটি টাকা জব্দ রয়েছে। আমজাদ হোসেনের ভাতিজি, লকপুর গ্রæপের কর্মচারীসহ বিভিন্ন নামে এসবিএসি ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা বিএফআইইউসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্তে উঠে এসেছে। অনিয়মের সত্যতা পাওয়ার পর তার চেয়ারম্যান পদে থাকা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছিল বিএফআইইউ।

এস এম আমজাদ হোসেন

পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে পর্ষদের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আমজাদ হোসেন। জানা গেছে, আমজাদ হোসেনের পাচার করা অর্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে চিঠি দিয়ে তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সব তথ্য বিএফআইইউর কাছে পাঠিয়েছে। বিএফআইইউ ইতোমধ্যে দুদকের কাছে সেসব তথ্য হস্তান্তর করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমজাদ হোসেনের পাঁচটি বাড়ি, গাড়িসহ একাধিক ব্যাংকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংকে তার বড় অঙ্কের অর্থ জমা রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরেও রয়েছে বড় বিনিয়োগ। এ ছাড়া ভারতের কলকাতায় আমজাদ হোসেনের একটি চিংড়ি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি রয়েছে। এসব ব্যবসার আড়ালে তিনি অর্থ পাচার করেছেন। বিদেশে অর্থ পাচার ও জালিয়াতির কারণে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি আমজাদ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ ও মেয়ে তাজরির আমজাদকে নিয়ে স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারত হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পাচার রোধে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার বন্ধ করতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরও কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অর্থ পাচারকারীদের দেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও যোগসাজশ ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়া সম্ভব নয়। এদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারে ব্যাংক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

পাচার করা অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও একাধিক বাড়ি কিনে বসবাস করছেন সাউথ বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন : সপবিবারে পলায়ন

প্রকাশের সময় : ১১:১৫:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩

শাহেদ আলী ইরশাদ: ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা মেরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন। পাচার করা অর্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়াও একাধিক বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস করছেন। নানা রকম জালিয়াতির মাধ্যমে আমানতকারীদের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও বিভিন্ন দেশে পাচারের তথ্য উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে।
এস এম আমজাদ হোসেন

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন লকপুর গ্রæপের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি চার ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। ব্যাংকের টাকা তিনি একা মারেননি, এ কাজে ব্যবহার করেছেন স্ত্রী, কন্যা, ভাতিজি ও লকপুর গ্রæপের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও। এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন ব্যাংকটির খুলনা ও কাটাখালী শাখা থেকে নামে-বেনামে প্রায় ২৭২ কোটি টাকা সরিয়েছেন। ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে টাকা তোলার পাশাপাশি কর্মচারীদের নামেও তিনি ঋণ নিয়েছেন। আবার করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা তহবিল থেকেও শ্রমিকদের বেতনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে অতিরিক্ত টাকা তুলেছেন। এস এম আমজাদ হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলনা ও বাগেরহাটের কাটাখালীকেন্দ্রিক হওয়ায় তিনি ঢাকার কোনো শাখায় অনিয়ম না করে বেছে নিয়েছেন খুলনা ও কাটাখালী শাখাকে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানান, এস এম আমজাদ হোসেনের ভাতিজি মাহফুজা খানম রিশাকে চেয়ারম্যান করে গঠিত কোম্পানি আলফা এক্সেসরিজের নামে ৪৮ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয় ব্যাংকটির ৪৫তম পর্ষদ সভায়।
আলফা এক্সেসরিজের নামে নেওয়া ঋণের পুরো সুবিধাভোগী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন লকপুর গ্রæপ। আলফা এক্সেসরিজকে সব মিলিয়ে ২০০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দিয়েছে এসবিএসি ব্যাংকের কাটাখালী শাখা। ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি। ২০১৬ সালের ২ জুন এস এম আমজাদ হোসেন খুলনা বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে ৩০ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। খুলনা বিল্ডার্সের ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক আমজাদ। বাকি ৪৯ শতাংশ শেয়ার তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের নামে। নথিপত্রে খুলনা বিল্ডার্সের ব্যবসার ধরন হিসেবে নির্মাণ ও আমদানি-রপ্তানির কথা বলা হলেও সেখানে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন এসবিএসি ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা শাখা থেকে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রæয়ারী লকপুর গ্রæপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে ২২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের জোগান দেওয়া হয় সাউদার্ন ফুড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে, যেটির চেয়ারম্যান আমজাদের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন। আর তার ভাই এস এম আবুল হোসেন আছেন প্রতিনিধি হিসেবে। কাটাখালী শাখায় এস এম আমজাদের নামে ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঋণ রয়েছে। সেটিও এখন খেলাপি। এস এম আমজাদ হোসেন ও এসবিএসি ব্যাংকের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন মিলে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে নিজেদের ব্যাংকের বিজয়নগর শাখা থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণের ৮ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন।
এস এম আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে শেয়ার বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিজ ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি আরও তিনটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৭১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন আমজাদ হোসেন। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখা থেকে লকপুর গ্রæপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন পলিমারের নামে ১৫১ কোটি, মুনস্টার পলিমারের নামে ৯০ কোটি ৮১ লাখ ও বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিংয়ের নামে ৯৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণের পুরোটাই খেলাপি। এই অর্থ আদায়ে মামলাও করেছে ব্যাংক। দেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংক থেকে ‘রূপসা ফিশ কোম্পানি’ নামে লকপুর গ্রæপের অন্য এক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৩৭৪ কোটি টাকার ঋণপত্র খুলে পুরোটাই পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন। এসব ঋণের টাকা তিনি পরিশোধ করছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন। আমেরিকা, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। পাচার করা অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে টাকা সরিয়েছেন। এসবিএসি ব্যাংকের খুলনা সদর ও কাটাখালী শাখা ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি এবং ঋণের আড়ালে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতির মাধ্যমে আমানতকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন আমজাদ হোসেন। বতর্মানে আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ৮২৯ কোটি টাকা জালিয়াতির অনুসন্ধান করছে দুদক। বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর আমজাদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৯৩৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৯টি ব্যাংক হিসাবে কোনো অর্থ নেই। শূন্য ব্যালান্সের হিসাবগুলোর প্রতিটিতেই কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। শত কোটি টাকার ওপর লেনদেন হয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও অনেক। বাকি ২৫৬টি অ্যাকাউন্টে থাকা ৫৫ কোটি টাকা জব্দ রয়েছে। আমজাদ হোসেনের ভাতিজি, লকপুর গ্রæপের কর্মচারীসহ বিভিন্ন নামে এসবিএসি ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা বিএফআইইউসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্তে উঠে এসেছে। অনিয়মের সত্যতা পাওয়ার পর তার চেয়ারম্যান পদে থাকা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছিল বিএফআইইউ।

এস এম আমজাদ হোসেন

পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে পর্ষদের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আমজাদ হোসেন। জানা গেছে, আমজাদ হোসেনের পাচার করা অর্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে চিঠি দিয়ে তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সব তথ্য বিএফআইইউর কাছে পাঠিয়েছে। বিএফআইইউ ইতোমধ্যে দুদকের কাছে সেসব তথ্য হস্তান্তর করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমজাদ হোসেনের পাঁচটি বাড়ি, গাড়িসহ একাধিক ব্যাংকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংকে তার বড় অঙ্কের অর্থ জমা রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরেও রয়েছে বড় বিনিয়োগ। এ ছাড়া ভারতের কলকাতায় আমজাদ হোসেনের একটি চিংড়ি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি রয়েছে। এসব ব্যবসার আড়ালে তিনি অর্থ পাচার করেছেন। বিদেশে অর্থ পাচার ও জালিয়াতির কারণে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি আমজাদ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ ও মেয়ে তাজরির আমজাদকে নিয়ে স্থলসীমান্ত দিয়ে ভারত হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পাচার রোধে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার বন্ধ করতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরও কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অর্থ পাচারকারীদের দেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও যোগসাজশ ছাড়া ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়া সম্ভব নয়। এদের আইনের আওতায় এনে অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারে ব্যাংক।