পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামি পৌনে ৪ লাখ
- প্রকাশের সময় : ০১:১৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ জুন ২০২৩
- / ৪০ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : সারা দেশে গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামির সংখ্যা প্রায় পৌনে চার লাখ। পুলিশের খাতায় তারা পলাতক। এর মধ্যে জিআর (জেনারেল রেজিস্টার) মামলায় পলাতক দুই লাখ ২১ হাজার ৯৮৪ জন। আর সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলায় পলাতক এক লাখ ৪৮ হাজার ৯৭২। গত এক বছরে ওয়ারেন্ট তামিল করা হয়েছে ছয় লাখ ৩৯ হাজার ৭১৬টি। এর মধ্যে জিআর মামলার পরোয়ানা তিন লাখ ৩৮ হাজার ৩৫৮ এবং সিআর মামলার পরোয়ানা তিন লাখ এক হাজার ৩৫৮টি। এই পরিসংখ্যান গত মে পর্যন্ত বলে যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আটটি অপরাধ বিভাগের মধ্যে মিরপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি (১১ হাজার ২৫০টি) পরোয়ানা পেন্ডিং আছে। আর উত্তরা বিভাগে (এক হাজার ৫৮৩টি) সবচেয়ে কম পরোয়ানা রয়েছে। এই পরিসংখ্যান গত এপ্রিল পর্যন্ত বলে জানিয়েছে ডিএমপি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার না হওয়া বা এ সংক্রান্ত পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল না করার কারণে আদালতে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের দাবি, মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে ওয়ারেন্ট তামিল এবং বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত সমুদয় কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কিছু পুলিশ সদস্যকে বিশেষ দায়িত্ব দিতে হবে। এ দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের দিয়ে অন্য কাজ করানো যাবে না। তাহলেই ওয়ারেন্ট তামিলের সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি কমবে বিচারাধীন মামলার চাপ।
আরোও পড়ুন । বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে ইইউ ভাইস-প্রেসিডেন্টকে ৬ ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যের চিঠি
গত এপ্রিল পর্যন্ত ডিএমপির ৫০টি থানায় ৩৮ হাজার ৭১৭ গ্রেফতারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) ঝুলে ছিল। এর মধ্যে জিআর মামলার ওয়ারেন্ট ২১ হাজার ৫৯৫টি। ডিএমপিতে যেসব ওয়ারেন্ট পেন্ডিং বা ঝুলে আছে সেগুলোর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা নয় হাজার ২২৭টি। অন্যান্য ওয়ারেন্টভুক্ত আসামির সংখ্যা ২৮ হাজার ৯৯০। এপ্রিল মাসের প্রথম দিনে ঝুলে থাকা ওয়ারেন্টের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৫১৬টি। ওই মাসে আদালত থেকে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় তিন হাজার ৭৮৪টি ওয়ারেন্ট আসে। এগুলোর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট এক হাজার দুটি। গত এপ্রিলে ঢাকায় তিন হাজার ৫৮৩টি ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তি করা হয়। এর আগের মাসে ওয়ারেন্ট নিষ্পত্তি করা হয় চার হাজার ৯১০টি।
গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলে থাকার পেছনে পুলিশের আন্তরিকতার অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরোয়ানা জারির পর কালক্ষেপণের মাধ্যমে আসামিকে জামিনে সহযোগিতা করছে পুলিশ। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ওয়ারেন্ট তামিলের বিষয়ে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। ওয়ারেন্ট তামিলের ক্ষেত্রে কোনো পুলিশ সদস্যের কালক্ষেপণের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, বিপুলসংখ্যক ওয়ারেন্ট তামিল না হওয়ার কারণেই বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ওয়ারেন্ট তামিল না হলেও বিচার কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট পাওয়ার পর পুলিশকে সংশ্লিষ্ট আসামির বাড়িতে যেতে হবে। আসামি পাওয়া না গেলেও সে বিষয়ে আদালতে একটি প্রতিবেদন দিতে হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর আদালত পরবর্তী ধাপে এগোতে পারে। এসব ধাপের মধ্যে রয়েছে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া, হুলিয়া জারি করা, ক্রোক ইত্যাদি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ প্রতিবেদন না পাওয়ার কারণে আদালত পরবর্তী ধাপেই যেতে পারছে না। এতে বিলম্বিত হচ্ছে বিচার কাজ।
মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ওয়ারেন্ট তামিলের জন্য আলাদা কোনো পুলিশ সদস্য নেই। যারা ওয়ারেন্ট তামিল করে তাদের আরও অনেক কাজ করতে হয়। অন্য সব কাজ করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা ওয়ারেন্ট তামিলের বিষয়টিতে অবহেলার চোখে দেখে। আসামি প্রভাবশালী হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে ওয়ারেন্ট তামিলের উদ্যোগও নেওয়া হয় না। ওয়ারেন্ট তামিল সংক্রান্ত মনিটরিংও ঠিকমতো হচ্ছে না। থানায় এ সংক্রান্ত কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও নেই। এ বিষয়ে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের পাশাপাশি আদালতকেও আরও ভূমিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, এখন তো নিয়মিত পুলিশ এবং বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে মিটিং হয়। মিটিংগুলোতে এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) আব্দুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, ওয়রেন্টপ্রাপ্ত আসামিরা ঘন ঘন ঠিকানা বদলায়। এ কারণে তাদের সহজেই ধরা যাচ্ছে না বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। তবে এটি একমাত্র যুক্তি হতে পারে না। কারণ পুলিশের কাছে এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তি আছে। প্রযুক্তি সঠিক ব্যবহারসহ আসামি ধরতে পুলিশকে আরও তৎপর হতে হবে। তিনি বলেন, মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যাও। সে অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ওয়ারেন্ট তামিল না হওয়াও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে পলাতক আসামি হলেই বিচার থেমে থাকে না। পুলিশ যদি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে যে, আসামি পালিয়ে আছে। তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তাহলে আদালত গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার কাজ এগিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু পরোয়ানাভুক্ত সব পলাতক আসামির ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে যথাসময়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে না। অন্যদিকে মাসের পর মাস গ্রেফতারি পরোয়ানা আদালতে পড়ে থাকার কারণে আদালত সংশ্লিষ্ট আসামির বিষয়ে অন্ধকারে থাকছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ডিএমপির অপরাধ বিভাগগুলোর মধ্যে রমনায় এক হাজার ৭৩৩, লালবাগে ৮১৩, ওয়ারীতে এক হাজার ৩০৪টি, মতিঝিলে ৯৪৫, তেজগাঁওয়ে এক হাজার ৬১৫, মিরপুরে দুই হাজার ৬২৬, গুলশানে এক হাজার ২১৭ এবং উত্তরায় ৪২৫টি সাজাপ্রাপ্ত পরোয়ানা রয়েছে। অন্য সব ওয়ারেন্টের মধ্যে রমনায় দুই হাজার ৮১৭, লালবাগে দুই হাজার ২৪৪, ওয়ারীতে চার হাজার ৫৪৭, মতিঝিলে দুই হাজার ৬৯৪, তেজগাঁওয়ে সাত হাজার ২০৪, মিরপুরে আট হাজার ৬২৪, গুলশানে দুই হাজার ৩৪৪ এবং উত্তরায় এক হাজার ১৫৮টি রয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের আইজি (মিডিয়া) মনজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পেন্ডিং ওয়ারেন্ট কমানোর জন্য আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। প্রতিমাসেই এ সংক্রান্ত বিশেষ অভিযান চলে। সাম্প্রতিক সময়ে যে পরিমাণ ওয়ারেন্ট আদালত থেকে ইস্যু করা হচ্ছে সেগুলোর সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি তামিল করা হচ্ছে। আগে থেকেই অনেক বেশি ওয়ারেন্ট পেন্ডিং থাকায় সংখ্যাটি বড় মনে হচ্ছে। পেন্ডিং ওয়ারেন্ট আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ওয়ারেন্ট পেন্ডিং থাকার কারণে মামলার বিচার কাজ ঝুলে থাকার অভিযোগটি সত্য নয়। আসামি পলাতক থাকলে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চলতে পারে। যেসব ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, তাদের বিষয়ে নিয়মিতভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে। সূত্র : যুগান্তর
বেলী/হককথা