নিবন্ধন ছাড়াই ‘বিকল্প পন্থায়’ নির্বাচনে যাবে জামায়াত
- প্রকাশের সময় : ০৭:২৫:৩০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৩
- / ৪৫ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : সবশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর পরপরই দেশের স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন নির্বাচনেও অংশগ্রহণ ছিল দলটির। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচারকাজ শুরু হলে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত।
এরপর সংক্ষুব্ধদের দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সবশেষ গত ১৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ মর্মে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বেঞ্চ।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর জাতীয় কিংবা স্থানীয় কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। এরই মধ্যে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকেও দূরত্বে ছিল দলটি। তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন আবারও সরকার পতনের এক দফা ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্দোলন করছে জামায়াত।
তবে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে দীর্ঘ প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভোটের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা জামায়াত গত ১০ জুন ঢাকায় প্রকাশ্য সমাবেশ করে নতুনভাবে আলোচনায় আসে। বিশেষত, নিবন্ধন জটিলতায় থাকা জামায়াতকে হঠাৎই ঢাকায় সমাবেশ করার জন্য সরকারের অনুমতি দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় নানা তর্ক-বিতর্ক ও গুঞ্জন। এর প্রায় সাড়ে চার মাস পর গত ২৮ অক্টোবর অনেকটা আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়াই ঢাকায় জমায়েত করে দলটি।
নির্বাচন ও ভোট নিয়ে কী ভাবছে জামায়াত? দলটির নেতারা কি ভোটে অংশ নিতে আগ্রহী? যদি তেমনটি হয়ে থাকে তাহলে নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক ছাড়া কোন প্রক্রিয়ায় ভোটে আসবে জামায়াত? নিবন্ধন ও প্রতীকবিহীন একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পদ্ধতি কী হতে পারে
কিন্তু নিবন্ধন বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গত ১৯ নভেম্বর আবেদন খারিজের পর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ভোট নিয়ে কী ভাবছে জামায়াত? দলটির নেতারা কি ভোটে অংশ নিতে আগ্রহী? যদি তেমনটি হয়ে থাকে তাহলে নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক ছাড়া কোন প্রক্রিয়ায় ভোটে আসবে জামায়াত? কী নামেইবা জনগণের সামনে দাঁড়াবে? নিবন্ধন ও প্রতীকবিহীন একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পদ্ধতি কী হতে পারে, এ প্রশ্নটিও এখন উঁকি দিচ্ছে জনমনে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর জামায়াত নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কি না, করলে কীভাবে করবেন, এসব প্রশ্ন নিয়ে দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার মুখোমুখি হলে তারা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বা অন্য কোনো প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিতে পারবেন জামায়াত নেতারা। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও সেটি দেখা যেতে পারে। তবে কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়।
আইনজীবীদের ভাষ্য, নিবন্ধনের জন্য জামায়াত চাইলে এখনো আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো ত্রুটি থাকলে সেগুলো নিরসন করেও নিবন্ধনের জন্য নতুন করে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে তাদের। তবে এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত কোন পথে ও কী কৌশলে এগোবে, এ বিষয়ে শিগগির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে দলটির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর লাগাতার সর্বাত্মক হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে মিল রেখে জামায়াতও ধারাবাহিকভাবে এসব কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। জোটসঙ্গীসহ সরকারবিরোধী অন্য অনেক দলকেও এখন রাজপথের আন্দোলনে পাশে পাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান তারা। এক্ষেত্রে ভোটাধিকারের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি হাইলাইটস করা হচ্ছে।
বিএনপি মনে করে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি সেটি দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও গ্রহণ করেছে। এখন ধৈর্য, সততা ও ঐক্যই হচ্ছে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। এছাড়া রাজনীতি ও ভোটের হিসাব- এ দুটি বিষয় পাশাপাশি রেখে সামনে এগোতে চাচ্ছেন তারা। আর ভোটের হিসাবে ইসলামী দলগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর সেটিও অজানা নয় বিএনপির। দলটি এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করছে, জনভিত্তি আছে এমন ইসলামী দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
তবে সাম্প্রতিককালে রাজনীতির মাঠে জামায়াতকে নিয়ে রয়েছে চমকপ্রদ তথ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভেতরে ভেতরে দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও প্রস্তুতি রয়েছে নিবন্ধনহীন দলটির। নেতাদের দাবি, জামায়াতের প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। নিবন্ধন বাতিল হলেও তারা সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে চান। সেদিক থেকে বিকল্প পন্থাও খুঁজে নেওয়া হচ্ছে। জামায়াত নেতারা বলছেন, নিবন্ধন ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত দলীয় সমর্থনের প্রার্থী স্বতন্ত্র বা অন্য কোনো প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দলটি এখনো অনড়। এ-ও বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত দলটি কী করে তা-ই এখন দেখার পালা।
জামায়াত নেতাদের অনেকে বলছেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিবেশ তৈরি হলে নিবন্ধন না থাকলেও বিকল্প পন্থায় (স্বতন্ত্র বা অন্য কোনো প্রতীকে) নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। তারা মনে করেন, জামায়াত নির্বাচনমুখী দল। ফলে নির্বাচনী প্রস্তুতি তাদের নিয়মিত কাজেরই অংশ। শুধু সরকার পতন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেই আন্দোলন করছেন না তারা, বরং দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাই তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
জানা গেছে, তৃণমূলে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন জামায়াত নেতারা। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় যাচ্ছেন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। আগামী দিনের আন্দোলন ও চ্যালেঞ্জগুলো নেতাকর্মীদের সামনে তুলে ধরছেন।
জামায়াতপন্থি একাধিক আইনজীবী নেতা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে তা শুধু আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নয়। কারণ, তারা মনে করেন এ সরকারের অধীনে বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আগামী নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে হলে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে না। সেজন্য তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি নয়। তারা মনে করছেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি যে কোনো দলই নিতে পারে, এটি কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। জামায়াত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে আন্দোলন করছে। এ আন্দোলন সফল করার পর নির্বাচনের প্রসঙ্গটি সামনে আসবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারি। জোরেশোরে নির্বাচনী প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জামায়াত নেতারা বলছেন, জামায়াত নির্বাচনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। সব সময়ই মাঠপর্যায়ে প্রার্থী যাচাই-বাছাই চলে। এরই মধ্যে শতাধিক আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু এই সরকারের অধীনে জামায়াত নির্বাচনে যাবে না।
নিবন্ধন অবৈধ মর্মে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা লিভ টু আপিল খারিজ করে গত ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ রায় দেন। ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানান, আদালতে আপিলকারীর পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ লিভ টু আপিল খারিজ করে দেন। এ আদেশের ফলে জামায়াত দলীয়ভাবে কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকলে কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তবে সংগঠন হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে দলটি।
নিবন্ধন নিয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকায় আইনগতভাবে (দলীয় প্রতীকে) এখন নির্বাচন করতে পারবে না জামায়াত। কিন্তু দলের যে কোনো নেতা যে কোনো কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তাতে কোনো সমস্যা নেই। দল যখন নিবন্ধন পাবে তখন আবার দলীয় প্রতীকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে
রায়ের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছে তার দল। রায় পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ কী হতে পারে সে সম্পর্কে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরে জানানো হবে। এক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন খারিজের পর দলটি আপিল বিভাগের লিখিত রায়ের অপেক্ষায় বলে জানা গেছে।
গত ১৯ নভেম্বরের রায়ের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, জামায়াত তাহলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে? এছাড়া দলীয়ভাবে কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারেইবা তাদের বক্তব্য কী?
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ জাগো নিউজকে বলেন, নিবন্ধন নিয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকায় আইনগতভাবে (দলীয় প্রতীকে) এখন নির্বাচন করতে পারবে না জামায়াত। কিন্তু দলের যে কোনো নেতা যে কোনো কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তাতে কোনো সমস্যা নেই। দল যখন নিবন্ধন পাবে তখন আবার দলীয় প্রতীকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া হবে।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত অংশ নেবে কি না- সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু না বললেও তিনি বলেন, নিবন্ধন ছাড়া দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না সেটা এখনো নিশ্চিত করেননি। বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ ছাড়া সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জামায়াত। কিন্তু নির্দলীয় তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবো না।
এর আগে দলটির নেতারা জানিয়েছিলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের। সে অনুযায়ী, স্বতন্ত্র বা অন্য কোনো প্রতীকে জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচনটি হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে।
এদিকে তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ করেছে। চলছে প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। তারাও মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে। এছাড়া তৃণমূল বিএনপিসহ আরও কিছু দল একক বা জোটগতভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিএনপি ও জামায়াতসহ সরকারবিরোধী বেশ কিছু দল ও জোট এখনো সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড়। তারা একসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিও দিয়ে যাচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আনুষ্ঠানিক অবস্থান প্রকাশ না করলেও নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের হয়তো ‘বিকল্প চিন্তা’ আছে। যে কারণে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে আন্দোলন করছে।
জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম জাগো নিউজকে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন থাকুক আর না-ই থাকুক, তাদের নেতাকর্মীরা দেশের নাগরিক হিসেবে স্বতন্ত্র বা অন্য কোনো প্রতীক নিয়ে আগামীতে নির্বাচনে যেতে পারেন। এজন্য ভিন্ন ধরনের বিকল্প হাতে রেখেছে দলটি।
তিনি বলেন, জামায়াতের বিকল্প ভাবনার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা নির্বাচন বর্জনের উভয় দিক থাকতে পারে। তবে দলটির সব সিদ্ধান্তই নির্ভর করবে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। আপাতত বিকল্প হিসেবে জামায়াত নেতাকর্মীরা অন্য কোনো দলের প্রতীক বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নিতে পারেন।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ করেছে। চলছে প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। তারাও মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে। এছাড়া তৃণমূল বিএনপিসহ আরও কিছু দল একক বা জোটগতভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে
ড. আব্দুল লতিফ মাসুম মনে করেন, যদি দেশে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হয় এবং জোটমিত্র বিএনপি জোটগত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জামায়াতও নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়টি অন্যভাবে বিবেচনা করতে পারে। এক্ষেত্রে হয়তো সবচেয়ে ভালো ও সুবিধাজনক বিকল্পটিই বেছে নেবে জামায়াত।
বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্টের কো-কনভেনর সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না। অন্যদিকে নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়টি তাদের একান্ত দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে তারাও বিএনপি বা জোটের সঙ্গে আছে। দলের নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াত চাইলে বিকল্প পন্থায় নির্বাচনে যেতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বা অন্য কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। এর আগেও আমরা জোট-মহাজোটের অনেক নেতাকে এ ধরনের পন্থায় ভোটে যেতে দেখেছি।
সুব্রত চৌধুরী মনে করেন, বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াতকে মাঠে রাখার একটা চেষ্টা থাকতে পারে আওয়ামী লীগের। হয়তো এ কারণেই গত ২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়াও বাধাহীনভাবে সমাবেশ করতে পেরেছে দলটি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সাবেক নেতা ও জামায়াতপন্থি আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে তা আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নয়। কারণ, বর্তমান সরকারের অধীনে বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে সেটিরই পুনরাবৃত্তি হবে। সে কারণে আমরা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবো না।
তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত আমাদের দলের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পরিষ্কার। তবে দেশে যদি নির্বাচনের পরিবেশ সরকার তৈরি করতে পারে বা তত্ত্বাবধায়কের আদলে কোনো সরকার আসে এবং বিএনপিসহ সমমান দলগুলো সেই নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে জামায়াতও অংশ নেবে।
‘নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রস্তুতি দরকার আমার বিশ্বাস এবং জানা মতে তা সর্বাত্মকভাবে নিয়ে রেখেছে দল। পরিবেশ তৈরি হলে জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে’- বলেন অ্যাডভোকেট সাইফুর।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের নেতা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ওই বছরই হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে জামায়াত।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, দলটির নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০এইচ ধারা অনুযায়ী দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হলো।
গত ১০ জুন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জামায়াত যে সমাবেশ করে সেখান থেকে দলটির নেতারা বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন। যার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল দলের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়া। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ, আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানানো হয় সেই সমাবেশ থেকে।
২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল জামায়াত। এর পর ১০ বছরের বেশি সময় দলটি কোনো কর্মসূচি দিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। গত ১০ জুনের সমাবেশ থেকে সরকার এবং সব দলকে নিয়ে আলোচনা এবং সরকার ও বিরোধীদের ঐক্যের আহ্বান জানায় জামায়াত। দলটি ঐক্যের ভিত্তিতে একটি ‘সঠিক বাংলাদেশ’ গড়ার কথাও বলে।
জিয়া-পরবর্তী এরশাদ সরকারের শাসনামলেও এদেশে নির্বিঘ্নে রাজনীতি করেছে জামায়াত। পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ও দলীয় মন্ত্রী-এমপি পেয়েছে তারা। আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ শুরু হলে চাপ বাড়তে থাকে জামায়াতের ওপর
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতে ইসলামী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় রাজনীতিতে ফেরার পর এতটা দুর্দশায় আর পড়েনি।
১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জামায়াত। যেখানে দলটি ১০টি আসনে জয় পায়। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে ২২২ জন দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে ১৮টি আসনে জয় পায় জামায়াত। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসন পায় দলটি। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসন পায় জামায়াত। সেবার সংরক্ষিত নারী আসন থেকেও চারটি আসনে জয়ী হয় তারা। সবশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুটি আসনে জয় পায় জামায়াত। ওই নির্বাচনে দলটি জোটগতভাবে ৩৯টি ও চারটিতে এককভাবে নির্বাচন করে। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনীতি ফেরে। জিয়া-পরবর্তী এরশাদ সরকারের শাসনামলেও এদেশে নির্বিঘ্নে রাজনীতি করেছে জামায়াত। পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ও দলীয় মন্ত্রী-এমপি পেয়েছে তারা। আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ শুরু হলে চাপ বাড়তে থাকে জামায়াতের ওপর। তখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ নেতার মৃত্যুদণ্ড বা আমৃত্যু কারাদণ্ড কার্যকর হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ২০২৩-২৫ মেয়াদে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। এরই মধ্যে ৮৬টি সাংগঠনিক জেলা শাখা ও এর অধীনে উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের সব কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্য তৎপরতা দেখা না গেলেও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে অনেকটা গোপনে দলটি সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে বলেও জানা যায়।
সূত্র : জাগোনিউজ
হককথা/নাছরিন