নতুন বছরে কঠিন চ্যালেঞ্জ
- প্রকাশের সময় : ০৭:৫২:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ জানুয়ারী ২০২৩
- / ৬৪ বার পঠিত
নানা ঘটন-অঘটনের সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরও একটি বছর। নতুনের সম্ভাবনার হাতছানি নিয়ে হাজির হয়েছে নতুন একটি বছর। আজকের সুর্যোদয়ের মধ্যদিয়ে জনজীবনে উঁকি দিবে নতুন সময়, নতুন দিন। পুরাতনকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হচ্ছে ইংরেজি নতুন বছর ২০২৩ সাল। নানা কারণে বিদায়ী বছরটি ছিল ঘটনাবহুল। করোনা ভাইরাসের মহামারিকাল পেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার বছরটি মানুষের জন্য স্বস্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতি আর অর্থনীতির জন্য ছিল অনেকটা দুঃসময়। করোনার ধকল কাটাতে লড়াইয়ে থাকা অর্থনীতির জন্য নতুন এক ঝক্কি হয়ে হাজির হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ডলারের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম এবং রিজার্ভ ক্ষয়ের কারণে দেশের অর্থনীতি বহুমুখী সংকটে পড়ে। এই প্রভাব কাটাতে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, আমদানি কমানো এবং ব্যাপক লোডশেডিং বড় ধরনের প্রভাব ফেলে জনজীবনে।
করোনাকালে ধুঁকতে থাকা জনজীবন নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। খরচের লাগাম টানতে খাবারের তালিকা ছোট করেছেন অনেকে। প্রয়োজনীয় অনেক খরচ বাদ দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে মধ্যবিত্তকে নামতে হয়েছে নিম্নœ মধ্যবিত্তের স্তরে। আর নিম্নবিত্তের মানুষকে হতে হয়েছে নয়া বাস্তবতার মুখোমুখি।
শুধু কী অর্থনীতি। রাজনীতির আকাশেও ছিল কালো মেঘ। টানা তৃতীয় মেয়াদে থাকা সরকার মেয়াদ পূরণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। বিদায়ী বছরে সরকার যেমন নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়েছে, তেমনি ছিল নানা অর্জনও। বছরের মধ্যভাগে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সরকার নয়া এক ইতিহাস রচনা করে। রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণের জেলাগুলোর সরাসরি যোগাযোগের মাইলফলক রচনা হয় এই সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে। এর মাধ্যমে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতারও জানান দেয় সরকার। বছরের শেষটা হয়েছে অনন্য এক অর্জনের মধ্য দিয়ে। ২৮শে ডিসেম্বর চালু হয়েছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণের যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করা এই মেট্রোরেলের আংশিক উদ্বোধনের মাধ্যমে মেট্রোরেলের এলিট ক্লাবে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়াও অনেক অর্জন আছে সরকারের। তবে এসব বাস্তবতার বাইরেও রাজনীতিতে ছিল অস্বস্তি আর শঙ্কার কালো মেঘ। বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিরোধী দলগুলো বিদায়ী বছরে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের সূচনা করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সারা দেশে বিভাগীয় জনসমাবেশ করার মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি বড় করে জানান দিয়েছে। বিদায়ী বছরের শেষে যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করেছে। শুরু হয়েছে কর্মসূচি। বিএনপি’র চলমান আন্দোলনে দলের শীর্ষ দুই নেতা অনুপস্থিত থাকলেও কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ১০ই ডিসেম্বর হওয়া ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে তিনিসহ দলটির সিনিয়র কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তারে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে।
রাজনীতির ঘুরপাকের মধ্যে বছরজুড়েই সক্রিয় ছিল কূটনৈতিক তৎপরতা। একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন কূটনীতিকরা। তাদের এসব বক্তৃতা-বিবৃতি অনেকটা অস্বস্তির কারণ হয়েছে সরকারের জন্য। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার সতর্ক করা হয়েছে বিদেশি কূটনীতিকদের। কিন্তু তারা অবস্থান বদলাননি। বরং কূটনীতিকরা বারে বারে তাদের অবস্থানের বিষয়টি সামনে আনছেন নানা উপায়ে। সর্বশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের শাহীনবাগে সফর নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তার রেশ গড়িয়েছে ওয়াশিংটন পর্যন্ত।
এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতি আর অর্থনীতির জন্য আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে হাজির হয়েছে নতুন বছর। নির্বাচন না হলেও নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হবে এই বছরের শেষ ভাগে। তাই বছরটি অনেকটা নির্বাচনী বছর হিসেবেই হাজির হয়েছে। নির্বাচনী এই বছরে রাজনীতির ঝঞ্ঝার সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে হবে সরকারকে। একইসঙ্গে বিরোধীদের সামনে নতুন বছরটি এক নয়া বাস্তবতার। দলের কর্র্মীরা বিদায়ী বছরে নানা কর্মসূচিতে নিজেদের উপস্থিতির মাধ্যমে যে আশা জাগিয়েছেন তা ধরে রেখে নির্বাচনী লক্ষ্য পূরণের কঠিন চ্যালেঞ্জ বিরোধী দলগুলোর নেতাদের সামনে। একইসঙ্গে সরকারের নিত্য নতুন কৌশল মোকাবিলাও তাদের জন্য বড় এক পরীক্ষা হয়ে আসবে নতুন বছরে।
সরকারের পদত্যাগ দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন ঘোষণা করে ইতিমধ্যে কর্মসূচি পালন শুরু করেছে বিরোধী দলগুলো। অন্তত ৩৩টি রাজনৈতিক দল এই কর্মসূচিতে একাত্ম হয়েছে। প্রথম কর্মসূচি হিসেবে গণমিছিল করেছে দলগুলো। সারা দেশে ২৪শে ডিসেম্বর এবং ঢাকায় শুক্রবার গণমিছিলের মাধ্যমে বড় জমায়েত করেছে দলগুলো। প্রায় এক যুগ পর ঘোষণা দিয়ে মাঠের কর্মসূচিতে নেমেছে জামায়াত। আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা দলটি এককভাবেই এই কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে চলছে ভাঙা-গড়ার খেলা। ক্ষমতা আর স্বার্থের দ্বন্দ্বে পুড়ছেন নেতারা। দিকভ্রান্ত কর্মী- সমর্থকরা। জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটির অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এটি এখনই কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অন্য শরিকদের মাঝে আছে পাওয়া না পাওয়ার বেদনা। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দলগুলোর তৎপরতা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে মাঠের কর্মসূচিও পালন করছেন তারা।
নতুন বছরের শুরুতেই বিরোধী দলগুলো গণঅবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ১০ই জানুয়ারি বিভাগীয় শহরগুলোতে হবে এই সমাবেশ। বিরোধী নেতারা বলছেন, এভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে মাঠের তৎপরতা বাড়াবেন তারা। সরকারের ওপর চাপ দেয়ার চেষ্টা করবেন। সময় ঘনিয়ে আসলে কঠোর কর্মসূচিও আসতে পারে। এজন্য আগে থেকে নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে একের পর এক নতুন রাজনৈতিক জোট হচ্ছে। নতুন হওয়া জোটগুলো অবশ্য বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছে। কয়েকটি ইসলামী দলের সমন্বয়ে সামনে নতুন একটি জোট গঠনের তৎপরতা রয়েছে। এক সময় রাজনীতির মাঠে হইচই তৈরি করা হেফাজতে ইসলামের অবস্থান এখন অনেকটা চুপচাপ। মামলার চাপ আর কারাগারে থাকা নেতাদের নিয়ে আছে অস্বস্তি। সময়ে সময়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। অরাজনৈতিক হলেও সংগঠনটি রাজনীতির মাঠে রাখতে পারে বড় ভূমিকা। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে হেফাজত কী ভূমিকা নেয় তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিরোধীদের সম্ভাব্য আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচির বিপরীতে জনজীবন স্বাভাবিক রাখা ও বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা সরকারি দলের জন্য নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিরোধীদের চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচির বিপরীতে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক বড় কর্মসূচির আগে পড়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশের গুলিতে বিএনপি’র বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। সামনে বিরোধীদের আন্দোলন কর্মসূচি জোরদার হলে সরকারি দল কী কৌশল নেয়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেমন ভূমিকা নেয় সেটি হয়তো এখনই বলা যাবে না। তবে সরকারি পক্ষ থেকে বিরোধীদের খুব একটা ছাড়া দেয়া হবে না এটি বর্তমান পরিস্থিতিতেই অনেকটা পরিষ্কার। রাজনীতির মাঠে দুই পক্ষ কঠোর অবস্থানে গেলে সংঘাত-সংঘর্ষ বা জনজীবনের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতিও সামনে আসতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারের সামনে আরও এক বড় চ্যালেঞ্জ অর্থননৈতিক চাপ সামাল দেয়া। বিদায়ী বছরে সবচেয়ে বড় সংকটের কারণ ছিল রিজার্ভ এবং ডলার। করোনাকালে দেশ রিজার্ভের নতুন রেকর্ড হলেও গত বছরের শেষে তা অনেকটা তলানিতে ঠেকে। বছর শেষে হিসাবে দেখা যায় ডলারের বিপরীতে অন্তত ২৫ শতাংশ দর হারিয়েছে টাকা। এরসঙ্গে ডলার সংকট ব্যবসা-বাণিজ্যকে শ্লথ করে দেয়। রিজার্ভ আর ডলারের এই সংকট এখনো চলমান। নতুন বছরে এই সংকট সামাল দিয়েই সরকারের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন বছরে অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে যোগ হবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ। এই চাপ সামাল দিতে রপ্তানি বাড়াতে হবে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ জোরদার করতে হবে সরকারকে। একইসঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
বিদায়ী বছরে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ হয়ে এসেছিল বাড়তি দ্রব্যমূল্য। প্রতিটি নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের কারণে জীবন- জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সংকট সামাল দিতে জ্বালানির দাম বাড়ানোয় এর প্রভাবও পড়ে দ্রব্যমূল্যে। আয় না বাড়লেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে অনেক মানুষ নিদারুণ কষ্টে সময় কাটিয়েছেন। প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ায় বিদায়ী বছরে মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে দাঁড়ায়। যদিও মূল্যস্ফীতির এই হিসাবটা যথা সময়ে জানা যায়নি। মূল্যস্ফীতির চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা জনজীবনে এখনও স্বস্তি ফিরেনি। দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েও এর প্রভাব খুব একটা পড়েনি বাজারে। বরং নানা অজুহাতে দাম বাড়ানোর অশুভ প্রতিযোগিতা থেমে নেই এখনও। এমন অবস্থায় নির্বাচনের আগে নতুন বছরে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং দ্রব্যমূল্য মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সরকারের জন্য এক বড় চালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।