নিউইয়র্ক ০৫:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

দেশ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রধান হোতা : সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেফতার

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১২:৪৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
  • / ৬ বার পঠিত

ঢাকা ডেস্ক: দেশ ও গণতন্ত্র ধ্বংসকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবশেষে গ্রেফতার হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিচারক নামধারী এই খলনায়ককে গ্রেফতার করতে প্রায় এক বছর বিলম্ব হয়েছে। এজন্য গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় এসে গ্রেফতার করা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন ও ক্ষোভ রয়েছে। তবু জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া এই বিপথগামী বিচারক গ্রেফতার হওয়ায় দেশজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস বইছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়াসহ খায়রুল হককে দ্রæত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে যাত্রাবাড়ীতে যুবদল কর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাতে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্ল্যাহ শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতিকে এই প্রথম কারাগারে যেতে হলো।
পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে মনে করেন, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এই গ্রেফতার জাতির ইতিহাসে বড় সাফল্যের ঘটনা হিসাবে জায়গা করে নেবে। একইসঙ্গে এ গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেল-অন্যায় করে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কেউ কোনোদিন রেহাই পাবে না। ‘
‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা’ সলিল চৌধুরীর লেখা বিখ্যাত এই দেশাত্মবোধক গানের কথাটি আজ অতি বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। শোষকের পক্ষে এবং জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে কোনো বিচারপতিও শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। যদিও দেশের বিচার অঙ্গনের জন্য ঘটনাটি সুখকর ও সম্মানজনক নয়। তবু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জনগণের শেষ ভরসাস্থল উচ্চ আদালতও প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে দলবাজিতে যুক্ত হয়, যা ছিল জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।
স্বয়ং প্রধান বিচারপতিসহ বেশির ভাগ বিচারপতি একটি স্বৈরাচারী রেজিমকে টিকিয়ে রাখতে যা যা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়, তার সবই করেছেন। এমনকি তারা প্রকাশ্যে বক্তৃতায় এও পর্যন্ত বলেন-‘বিচারপতিরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ।’ ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট শোক দিবসের আলোচনা সভায় আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এমন বক্তব্য দিয়ে বিচার অঙ্গনকে চরমভাবে বিতর্কিত করেন।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের নামে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় পৃথক দুটি মামলা রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরও দুটি মামলা আছে। এর বাইরে আর কোনো অভিযোগ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে ২৭ আগস্ট তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় মামলা করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া। মামলায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের হাত ধরে বিচারাঙ্গন কলুষিত হয়। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সব অপকর্মের বীজ বপন করে যান। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করাসহ খালেদা জিয়াসহ জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা এবং জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করে দেন। এর ফলে শেখ হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিনা ভোটে টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এজন্য আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনকে দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে খায়রুল হককে ‘জনক’ বলা যেতে পারে। এর বিনিময়ে তিনি আওয়ামী লীগ আমলে আইন ও রীতি লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে নানা সুবিধাও নিয়েছেন।
দুজনকে ডিঙিয়ে দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে এবিএম খায়রুল হক শপথ নেন ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় পরের বছর ২০১১ সালের ১৭ মে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নেওয়ার কয়েকদিন আগে ১০ মে তিনি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। এর ফলে হাসিনার ভোট ডাকাতির পথ সুগম হয়। এছাড়া রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদলতের আওতাধীন করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দেন বিতর্কিত এই প্রধান বিচারপতি। অপরদিকে একাধিক বিতর্কিত বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা, রাজউকের প্লট গ্রহণে গুরুতর অনিয়মসহ তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের এন্তার অভিযোগ রয়েছে।
যেভাবে নেওয়া হয় আদালতে: বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে এবিএম খায়রুল হককে ডিবির সাদা মাইক্রোতে করে মিন্টো রোড থেকে আদালতে আনা হয়। এ সময় গাড়ির সামনে ও পেছনে পুলিশের গাড়িতে কড়া নিরাপত্তা দিতে দেখা যায়। মাথায় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে খায়রুল হককে আদালত প্রাঙ্গণে আনার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ‘খায়রুলের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’ ¯েøাগান দিতে দেখা যায়। এরপর গাড়ি হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় আদালতে তোলা হয়।
আদালতে শুনানি: শুনানি শুরুর প্রাক্কালে এবিএম খায়রুল হককে কাঠগড়ায় তোলার পর হ্যান্ডকাফ ও মাথার হেলমেট খুলে দেওয়া হয়। রাত ৮টা ১৬ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপর শুনানি শুরু হয়। এসময় তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক মো. খালেদ হাসান। তখন তিনি (খায়রুল হক) চারদিকে তাকাতে থাকেন। শুনানিতে কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ঢাকা বার ইউনিটের আহŸায়ক খোরশেদ আলম বলেন, হাসিনার ক্রীতদাস ছিলেন। হাসিনার নির্দেশে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন। সেই অবিচারের ফলে তিনি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। হাসিনার সব মামলায় তাকে যুক্ত করা হোক সেই প্রত্যাশা করছি।
এরপর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক দিদার বলেন, তিনি কলঙ্কিত প্রধান বিচারপতি। তার কারণে দীর্ঘ ১৭ বছর হাজার হাজার মানুষ নির্যাতন, গুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন। তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়। তার কারণেই শেখ হাসিনা স্বৈরাচার হয়েছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি হত্যা মামলার আসামি। তিনি এই হত্যাকান্ডের উসকানিদাতা। এই মামলায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম বলেন, এমন একজন লোক কিভাবে প্রধান বিচারপতি হয় সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি প্রধান বিচারপতির জায়গাটা কলঙ্কিত করেছেন। তিনি ছোট থেকেই অনেক পাপী ছিলেন।
মোবাইলের আলোয় শুনানি : শুনানি চলাকালে রাত ৮টা ৩২ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে শুনানি চলতে থাকে।
এসময় বিচারক আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের কথায় অনেক কিছুই উঠে এসেছে। আপনারা বলছেন, আগে আপনারা বিচারকদের সম্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু কিছু কারণে আপনারা শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সরে এসেছেন। মানুষের শ্রদ্ধা তার কর্মের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। কর্মের মধ্য দিয়েই ঘৃণা বা ভালোবাসা তৈরি হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শেখার আছে। আপনি যদি শ্রদ্ধা করেন সেটাও আমার কর্মের কারণে, আবার ঘৃণা করলেও সেটাও কর্মের জন্য। পরে শুনানি শেষে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। তবে শুনানিতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ : শুনানি শেষে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তার ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন এলাকায় আব্দুল কাইয়ুম আহাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত, টিয়ারশেল ও সাউন্ড বোমসহ নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয়। এ সময় আব্দুল কাইয়ুম আহাদের মুখে ও বুকে গুলি লাগলে যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলা পুলিশ বক্সের সামনে তিনি লুটিয়ে পড়েন। পরে যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি আবুল হোসেন আব্দুল কাইয়ুম আহাদের দুই পায়ে ব্রাশফায়ার করেন। ভিকটিম আহাদকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় ৬ জুলাই নিহতের বাবা মো. আলাউদ্দিন বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬৭ জনকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত এক থেকে দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এ মামলায় এবিএম খায়রুল হক ৪ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি। দৈনিক যুগান্তর)

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

দেশ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রধান হোতা : সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেফতার

প্রকাশের সময় : ১২:৪৫:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

ঢাকা ডেস্ক: দেশ ও গণতন্ত্র ধ্বংসকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবশেষে গ্রেফতার হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিচারক নামধারী এই খলনায়ককে গ্রেফতার করতে প্রায় এক বছর বিলম্ব হয়েছে। এজন্য গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় এসে গ্রেফতার করা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন ও ক্ষোভ রয়েছে। তবু জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া এই বিপথগামী বিচারক গ্রেফতার হওয়ায় দেশজুড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস বইছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়াসহ খায়রুল হককে দ্রæত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে যাত্রাবাড়ীতে যুবদল কর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ হত্যা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাতে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্ল্যাহ শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতিকে এই প্রথম কারাগারে যেতে হলো।
পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে মনে করেন, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এই গ্রেফতার জাতির ইতিহাসে বড় সাফল্যের ঘটনা হিসাবে জায়গা করে নেবে। একইসঙ্গে এ গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেল-অন্যায় করে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কেউ কোনোদিন রেহাই পাবে না। ‘
‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা’ সলিল চৌধুরীর লেখা বিখ্যাত এই দেশাত্মবোধক গানের কথাটি আজ অতি বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। শোষকের পক্ষে এবং জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে কোনো বিচারপতিও শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। যদিও দেশের বিচার অঙ্গনের জন্য ঘটনাটি সুখকর ও সম্মানজনক নয়। তবু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জনগণের শেষ ভরসাস্থল উচ্চ আদালতও প্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে দলবাজিতে যুক্ত হয়, যা ছিল জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।
স্বয়ং প্রধান বিচারপতিসহ বেশির ভাগ বিচারপতি একটি স্বৈরাচারী রেজিমকে টিকিয়ে রাখতে যা যা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়, তার সবই করেছেন। এমনকি তারা প্রকাশ্যে বক্তৃতায় এও পর্যন্ত বলেন-‘বিচারপতিরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ।’ ২০২৩ সালের ১৫ আগস্ট শোক দিবসের আলোচনা সভায় আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এমন বক্তব্য দিয়ে বিচার অঙ্গনকে চরমভাবে বিতর্কিত করেন।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের নামে এখন পর্যন্ত চারটি মামলা আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় পৃথক দুটি মামলা রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরও দুটি মামলা আছে। এর বাইরে আর কোনো অভিযোগ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে ২৭ আগস্ট তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় মামলা করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া। মামলায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের হাত ধরে বিচারাঙ্গন কলুষিত হয়। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সব অপকর্মের বীজ বপন করে যান। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করাসহ খালেদা জিয়াসহ জিয়া পরিবারকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা এবং জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করে দেন। এর ফলে শেখ হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিনা ভোটে টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এজন্য আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনকে দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে খায়রুল হককে ‘জনক’ বলা যেতে পারে। এর বিনিময়ে তিনি আওয়ামী লীগ আমলে আইন ও রীতি লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে নানা সুবিধাও নিয়েছেন।
দুজনকে ডিঙিয়ে দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে এবিএম খায়রুল হক শপথ নেন ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় পরের বছর ২০১১ সালের ১৭ মে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর নেওয়ার কয়েকদিন আগে ১০ মে তিনি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। এর ফলে হাসিনার ভোট ডাকাতির পথ সুগম হয়। এছাড়া রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদলতের আওতাধীন করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দেন বিতর্কিত এই প্রধান বিচারপতি। অপরদিকে একাধিক বিতর্কিত বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা, রাজউকের প্লট গ্রহণে গুরুতর অনিয়মসহ তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের এন্তার অভিযোগ রয়েছে।
যেভাবে নেওয়া হয় আদালতে: বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে এবিএম খায়রুল হককে ডিবির সাদা মাইক্রোতে করে মিন্টো রোড থেকে আদালতে আনা হয়। এ সময় গাড়ির সামনে ও পেছনে পুলিশের গাড়িতে কড়া নিরাপত্তা দিতে দেখা যায়। মাথায় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে খায়রুল হককে আদালত প্রাঙ্গণে আনার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ‘খায়রুলের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’ ¯েøাগান দিতে দেখা যায়। এরপর গাড়ি হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় আদালতে তোলা হয়।
আদালতে শুনানি: শুনানি শুরুর প্রাক্কালে এবিএম খায়রুল হককে কাঠগড়ায় তোলার পর হ্যান্ডকাফ ও মাথার হেলমেট খুলে দেওয়া হয়। রাত ৮টা ১৬ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপর শুনানি শুরু হয়। এসময় তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক মো. খালেদ হাসান। তখন তিনি (খায়রুল হক) চারদিকে তাকাতে থাকেন। শুনানিতে কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ঢাকা বার ইউনিটের আহŸায়ক খোরশেদ আলম বলেন, হাসিনার ক্রীতদাস ছিলেন। হাসিনার নির্দেশে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন। সেই অবিচারের ফলে তিনি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। হাসিনার সব মামলায় তাকে যুক্ত করা হোক সেই প্রত্যাশা করছি।
এরপর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক দিদার বলেন, তিনি কলঙ্কিত প্রধান বিচারপতি। তার কারণে দীর্ঘ ১৭ বছর হাজার হাজার মানুষ নির্যাতন, গুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন। তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়। তার কারণেই শেখ হাসিনা স্বৈরাচার হয়েছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি হত্যা মামলার আসামি। তিনি এই হত্যাকান্ডের উসকানিদাতা। এই মামলায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম বলেন, এমন একজন লোক কিভাবে প্রধান বিচারপতি হয় সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি প্রধান বিচারপতির জায়গাটা কলঙ্কিত করেছেন। তিনি ছোট থেকেই অনেক পাপী ছিলেন।
মোবাইলের আলোয় শুনানি : শুনানি চলাকালে রাত ৮টা ৩২ মিনিটে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে শুনানি চলতে থাকে।
এসময় বিচারক আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের কথায় অনেক কিছুই উঠে এসেছে। আপনারা বলছেন, আগে আপনারা বিচারকদের সম্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু কিছু কারণে আপনারা শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সরে এসেছেন। মানুষের শ্রদ্ধা তার কর্মের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। কর্মের মধ্য দিয়েই ঘৃণা বা ভালোবাসা তৈরি হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শেখার আছে। আপনি যদি শ্রদ্ধা করেন সেটাও আমার কর্মের কারণে, আবার ঘৃণা করলেও সেটাও কর্মের জন্য। পরে শুনানি শেষে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। তবে শুনানিতে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ : শুনানি শেষে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তার ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসা থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতার করা হয়।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন এলাকায় আব্দুল কাইয়ুম আহাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত, টিয়ারশেল ও সাউন্ড বোমসহ নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয়। এ সময় আব্দুল কাইয়ুম আহাদের মুখে ও বুকে গুলি লাগলে যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলা পুলিশ বক্সের সামনে তিনি লুটিয়ে পড়েন। পরে যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি আবুল হোসেন আব্দুল কাইয়ুম আহাদের দুই পায়ে ব্রাশফায়ার করেন। ভিকটিম আহাদকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় ৬ জুলাই নিহতের বাবা মো. আলাউদ্দিন বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬৭ জনকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত এক থেকে দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এ মামলায় এবিএম খায়রুল হক ৪ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি। দৈনিক যুগান্তর)