নিউইয়র্ক ০৫:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

দেশের সেরা দুই অর্থমন্ত্রীর মৃত্যু হয় অপঘাতে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৩৭:৫৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / ৩০ বার পঠিত

অলিগার্কদের উত্থান। ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থের লুটপাট। দেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার অর্থ পাচার। দায় মুক্তি দিয়ে অন্যায্য সরকারি চুক্তি। অর্থনীতির এ প্রধান প্রবণতা গড়ে উঠে অর্থমন্ত্রী হিসাবে এম সাইফুর রহমান,শাহ এএমএস কিবরিয়া পরবর্তী যুগে। এ দুজনেরই মৃত্যু হয় অপঘাতে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। মৌলভীবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খড়িয়ালা নামক স্থানে তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার গাড়ি রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যায়। ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়া ওই গাড়িতে চালকসহ ছিলেন মোট ছয়জন। এর মধ্যে কেবল এম সাইফুর রহমানেরই মৃত্যু হয়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি এক জনসভায় গ্রেনেড হামলার শিকার হন শাহ এএমএস কিবরিয়া। ওই হামলায় সাবেক এ অর্থমন্ত্রীসহ পাঁচজন নিহত হন।

সিলেট অঞ্চল থেকে উঠে আসা প্রয়াত এ দুই মন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কাজ করা বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, আমলা, গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য হলো অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান ও শাহ এএমএস কিবরিয়া দুজনই ছিলেন বেশ সফল। তাদের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে সবাই সমীহ করে চলতেন। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তাদের অবস্থান ছিল বেশ কঠোর। ব্যাংক খাত সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুজনেরই ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কঠোর ছিলেন ব্যাংক খাতে মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাদের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অলিগার্করা ঢুকতেও পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের মতের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি এ দুই অর্থনীতিবিদ। এ কারণে অলিগার্কদের পাশাপাশি নিজ দলের মধ্যেও অনেকে তাদের শত্রু মনে করতেন। দেশের সেরা দুই অর্থমন্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকার কথাও জানান কেউ কেউ। স্বনামধন্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন। বিএনপি গঠনেও তার ভূমিকা ছিল বেশ উজ্জ্বল। দলটির ক্ষমতাকালীন অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২ বার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন তিনি। নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার নিয়ে এসেছিলেন এম সাইফুর রহমান।

মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণকারী এ রাজনীতিবিদ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশের কর ও শুল্ক ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে ফেলেছিলেন। বাণিজ্য খাতে নির্দিষ্ট শুল্কহারের বদলে মূল্যভিত্তিক শুল্কহারের সূচনা হয় তার হাত ধরে। পণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও আরো অনেক সংস্কার এনেছেন। প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদার নীতিগুলোর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে গেছেন। বাংলাদেশে মুক্তবাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার।

এম সাইফুর রহমান ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রথমে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন সাইফুর রহমান। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এম সাইফুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এমন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার জন্য এম সাইফুর রহমানের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার বিচারে তিনি সে চাপ অগ্রাহ্য করেছেন। এ কারণে বিএনপির অনেক নেতার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের একটি অংশও তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। আবার বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিরোধী দলে থাকলেও তার কাছ থেকে পরামর্শ চাইত তারা। এ কারণেও প্রভাবশালী একটি অংশ তার ওপর নাখোশ ছিলেন। এম সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মারা যান। আর ২০১০ সাল থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের পাশাপাশি অর্থনীতিতে মাফিয়াতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।’ এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হলেও সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এম সাইফুর রহমানের ছেলে এম নাসের রহমান বলেন, ‘সে সময় ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা আমাদের কানেও এসেছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কখনো ভাবা হয়নি। দুর্ঘটনার শিকার গাড়িতে ড্রাইভারসহ ছয়জন ছিলেন। তার মধ্যে আমার আব্বা ছাড়া কেউ মারা যাননি। পানিতে পড়ে যাওয়ার পর ড্রাইভার গাড়ির সামনের গ্লাস ভেঙে তাকে তুলে এনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা আর ড্রাইভারকে খুঁজে পাইনি।’ নাসের রহমান বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি ২০০১ সালে উপনির্বাচনে পিতার ছেড়ে দেয়া মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাসের রহমান বলেন, ‘আমরা শুনেছি, ড্রাইভার খালি রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই ড্রাইভার অনেক দিন থেকেই বাবার গাড়িচালক ছিলেন। এ কারণে কখনো সন্দেহ করিনি। তবে এত বছর পর এসে কোনো প্রমাণ ছাড়া এ বিষয়ে কথা তোলার প্রয়োজন মনে করছি না।’

দুর্ঘটনার পর কখনো ওই ড্রাইভারকে খুঁজেছিলেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার কোনো খোঁজ পাইনি। তবে বেঁচে আছেন বলে শুনেছি।’
যদিও ওই দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচেভেলে ও দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল সাইফুর রহমানের গাড়িচালকও দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তবে ওই গাড়িচালকের বেচে থাকা বা পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত করা হয়নি। এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছিল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন। এর বাইরে দলগতভাবে আমাদের ভিন্ন কোনো চিন্তা আসেনি। এ বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি।’

নব্বইয়ের দশকেই পূর্বসূরি সাইফুর রহমানের সংস্কার পদক্ষেপগুলোর সপক্ষে শক্ত অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার সময়েই অর্থনীতিতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়ে। দেশের ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার তৎপরতা জোরদার হয়। ১৯৯৮ সালে সংঘটিত বন্যা ছিল দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর দুর্যোগ। দুই মাসের অধিককালজুড়ে সংঘটিত এ বন্যায় দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু শাহ এএমএস কিবরিয়ার সময়োপযোগী পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয় সরকার। হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী এ রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কর্মজীবনে কূটনীতিক হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যার ১৯ বছর পেরোতে চললেও নৃশংস এ ঘটনার এখনো বিচার হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে টানা সাড়ে ১৫ বছর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়েও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় থাকা কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এ বিষয়ে শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার পিতার হত্যাকারী কে, তার উত্তর শেখ হাসিনার কাছে রয়েছে। কারণ খুনিদের রক্ষার ব্যাপারে তিনি সবসময় তৎপর ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যাকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে।’

অলিগার্কদের অর্থায়নেই শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেন রেজা কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে আমার বাবা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করিয়েছিলেন। এ কারণে সালমান এফ রহমানের পাশাপাশি শেখ হাসিনাও বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হন। বিষয়টি নিয়ে বাবার সঙ্গে শেখ হাসিনার বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়েছিল।’

রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘আমার পিতাকে হত্যায় আওয়ামী লীগের জেলার নেতাদের সঙ্গে বিএনপির একজন সম্পৃক্ত ছিলেন। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হলেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি আবু জাহির, হবিগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি আব্দুল মজিদ খান ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুশফিক হোসেন চৌধুরী। প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করতে শেখ হাসিনা বিএনপির ছোটখাটো কিছু নেতাকর্মীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের নতুন তদন্ত দরকার। সুষ্ঠু তদন্ত হলে হত্যাকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে।’ সূত্র : বণিক বার্তা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

দেশের সেরা দুই অর্থমন্ত্রীর মৃত্যু হয় অপঘাতে

প্রকাশের সময় : ০২:৩৭:৫৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

অলিগার্কদের উত্থান। ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থের লুটপাট। দেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার অর্থ পাচার। দায় মুক্তি দিয়ে অন্যায্য সরকারি চুক্তি। অর্থনীতির এ প্রধান প্রবণতা গড়ে উঠে অর্থমন্ত্রী হিসাবে এম সাইফুর রহমান,শাহ এএমএস কিবরিয়া পরবর্তী যুগে। এ দুজনেরই মৃত্যু হয় অপঘাতে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। মৌলভীবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খড়িয়ালা নামক স্থানে তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার গাড়ি রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যায়। ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়া ওই গাড়িতে চালকসহ ছিলেন মোট ছয়জন। এর মধ্যে কেবল এম সাইফুর রহমানেরই মৃত্যু হয়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি এক জনসভায় গ্রেনেড হামলার শিকার হন শাহ এএমএস কিবরিয়া। ওই হামলায় সাবেক এ অর্থমন্ত্রীসহ পাঁচজন নিহত হন।

সিলেট অঞ্চল থেকে উঠে আসা প্রয়াত এ দুই মন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কাজ করা বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, আমলা, গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য হলো অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান ও শাহ এএমএস কিবরিয়া দুজনই ছিলেন বেশ সফল। তাদের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে সবাই সমীহ করে চলতেন। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তাদের অবস্থান ছিল বেশ কঠোর। ব্যাংক খাত সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুজনেরই ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কঠোর ছিলেন ব্যাংক খাতে মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাদের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অলিগার্করা ঢুকতেও পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের মতের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি এ দুই অর্থনীতিবিদ। এ কারণে অলিগার্কদের পাশাপাশি নিজ দলের মধ্যেও অনেকে তাদের শত্রু মনে করতেন। দেশের সেরা দুই অর্থমন্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র থাকার কথাও জানান কেউ কেউ। স্বনামধন্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন। বিএনপি গঠনেও তার ভূমিকা ছিল বেশ উজ্জ্বল। দলটির ক্ষমতাকালীন অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২ বার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন তিনি। নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার নিয়ে এসেছিলেন এম সাইফুর রহমান।

মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণকারী এ রাজনীতিবিদ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশের কর ও শুল্ক ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে ফেলেছিলেন। বাণিজ্য খাতে নির্দিষ্ট শুল্কহারের বদলে মূল্যভিত্তিক শুল্কহারের সূচনা হয় তার হাত ধরে। পণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও আরো অনেক সংস্কার এনেছেন। প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদার নীতিগুলোর প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে গেছেন। বাংলাদেশে মুক্তবাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার।

এম সাইফুর রহমান ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রথমে জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন সাইফুর রহমান। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এম সাইফুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এমন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার জন্য এম সাইফুর রহমানের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার বিচারে তিনি সে চাপ অগ্রাহ্য করেছেন। এ কারণে বিএনপির অনেক নেতার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের একটি অংশও তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। আবার বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিরোধী দলে থাকলেও তার কাছ থেকে পরামর্শ চাইত তারা। এ কারণেও প্রভাবশালী একটি অংশ তার ওপর নাখোশ ছিলেন। এম সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মারা যান। আর ২০১০ সাল থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের পাশাপাশি অর্থনীতিতে মাফিয়াতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।’ এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হলেও সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এম সাইফুর রহমানের ছেলে এম নাসের রহমান বলেন, ‘সে সময় ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা আমাদের কানেও এসেছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কখনো ভাবা হয়নি। দুর্ঘটনার শিকার গাড়িতে ড্রাইভারসহ ছয়জন ছিলেন। তার মধ্যে আমার আব্বা ছাড়া কেউ মারা যাননি। পানিতে পড়ে যাওয়ার পর ড্রাইভার গাড়ির সামনের গ্লাস ভেঙে তাকে তুলে এনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা আর ড্রাইভারকে খুঁজে পাইনি।’ নাসের রহমান বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি ২০০১ সালে উপনির্বাচনে পিতার ছেড়ে দেয়া মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাসের রহমান বলেন, ‘আমরা শুনেছি, ড্রাইভার খালি রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ওই ড্রাইভার অনেক দিন থেকেই বাবার গাড়িচালক ছিলেন। এ কারণে কখনো সন্দেহ করিনি। তবে এত বছর পর এসে কোনো প্রমাণ ছাড়া এ বিষয়ে কথা তোলার প্রয়োজন মনে করছি না।’

দুর্ঘটনার পর কখনো ওই ড্রাইভারকে খুঁজেছিলেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার কোনো খোঁজ পাইনি। তবে বেঁচে আছেন বলে শুনেছি।’
যদিও ওই দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচেভেলে ও দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল সাইফুর রহমানের গাড়িচালকও দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তবে ওই গাড়িচালকের বেচে থাকা বা পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত করা হয়নি। এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছিল কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেছেন। এর বাইরে দলগতভাবে আমাদের ভিন্ন কোনো চিন্তা আসেনি। এ বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি।’

নব্বইয়ের দশকেই পূর্বসূরি সাইফুর রহমানের সংস্কার পদক্ষেপগুলোর সপক্ষে শক্ত অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার সময়েই অর্থনীতিতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়ে। দেশের ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার তৎপরতা জোরদার হয়। ১৯৯৮ সালে সংঘটিত বন্যা ছিল দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর দুর্যোগ। দুই মাসের অধিককালজুড়ে সংঘটিত এ বন্যায় দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু শাহ এএমএস কিবরিয়ার সময়োপযোগী পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয় সরকার। হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী এ রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কর্মজীবনে কূটনীতিক হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যার ১৯ বছর পেরোতে চললেও নৃশংস এ ঘটনার এখনো বিচার হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে টানা সাড়ে ১৫ বছর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়েও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় থাকা কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এ বিষয়ে শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার পিতার হত্যাকারী কে, তার উত্তর শেখ হাসিনার কাছে রয়েছে। কারণ খুনিদের রক্ষার ব্যাপারে তিনি সবসময় তৎপর ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যাকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে।’

অলিগার্কদের অর্থায়নেই শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেন রেজা কিবরিয়া। তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে আমার বাবা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করিয়েছিলেন। এ কারণে সালমান এফ রহমানের পাশাপাশি শেখ হাসিনাও বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হন। বিষয়টি নিয়ে বাবার সঙ্গে শেখ হাসিনার বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়েছিল।’

রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘আমার পিতাকে হত্যায় আওয়ামী লীগের জেলার নেতাদের সঙ্গে বিএনপির একজন সম্পৃক্ত ছিলেন। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হলেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি আবু জাহির, হবিগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি আব্দুল মজিদ খান ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুশফিক হোসেন চৌধুরী। প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করতে শেখ হাসিনা বিএনপির ছোটখাটো কিছু নেতাকর্মীকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের নতুন তদন্ত দরকার। সুষ্ঠু তদন্ত হলে হত্যাকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে।’ সূত্র : বণিক বার্তা।