নিউইয়র্ক ০৬:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

‘দেশরতœ’ উপাধি ভূষিত : বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সব ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত : নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:১২:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ মে ২০১৫
  • / ৭৫৮ বার পঠিত

ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে সম্মাননা তাকে দেয়া হল এটি তার প্রাপ্য নয়। এ সম্মাননা বাংলাদেশের জনগণের প্রাপ্য। তিনি বলেন, ‘আমি এ সম্মাননা বাংলার জনগণকে উৎসর্গ করছি।’ ২৯ মে শুক্রবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বর্ণাঢ্য নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসহ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জনের জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রধানমন্ত্রীকে এ সংবর্ধনা দেয়। এ সময় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। জন্মেছি যেহেতু একদিন মরতে হবেই। বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যাব। সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে চলবে।’
বিকাল সাড়ে ৩টায় নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তার আগে এক ঝলক বৃষ্টি উড়ে এসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়া মানুষকে ভিজিয়ে দেয়। তা সত্ত্বেও বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও দলে দলে মিছিল নিয়ে এ নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক কমিটির সভাপতি সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক। বিকাল ৪টার পরে জাতীয় সঙ্গীত ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। সৈয়দ শামসুল হক সংবর্ধনার শুরু ও শেষে বক্তৃতা করেন। তিনি শেখ হাসিনাকে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে ‘দেশরতœ’ উপাধি দিয়ে বলেন, এখন থেকে আপনারা সবাই শেখ হাসিনার নামের আগে আবশ্যিকভাবে ‘দেশরতœ’ শব্দ ব্যবহার করবেন।
সূচনা বক্তব্যের পর সৈয়দ শামসুল হকের রচিত ‘মর্ম সঙ্গীত’ এবং নৃত্য পরিবেশিত হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন নৃত্যাঞ্চলের সদস্যরা দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। অ্যামেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন। এর আগে, শেখ হাসিনার হাতে নৌকা সদৃশ স্মারক তুলে দেন সৈয়দ শামসুল হক ও ড. আনিসুজ্জামান। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী নেতা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ঢাকা সিটির দুই মেয়রসহ বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান। বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে গান। শিল্পী মিতা হক ও মহিউজ্জামান চৌধুরী দ্বৈত কণ্ঠে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…’ রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
প্রধানমন্ত্রী ৬টা ৭ মিনিটে বক্তৃতা শুরু করে শেষ করেন ৬টা ৩০ মিনিটে। ২৩ মিনিটের বক্তৃতা ছিল ’৭৫ পরবর্তী সময়ে তার দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ, সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য, উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ আশাবাদ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখান ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৪১ বছরের মাথায় ভারত সরকার এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। এজন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে বিদ্রুপ করে বলেছিল- স্বাধীন হলে বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। সেই ঝুড়ি এখন উন্নয়নে ভরপুর। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে ভরপুর একটি রাষ্ট্র।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব। আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের উন্নয়ন। সেই গ্রামের অবহেলিত মানুষটিরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তার সেই অধিকার রক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিটি মানুষ তার অধিকার পাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি জাতির জীবনে কোনো দিকদর্শন না থাকলে সে জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রূপকল্প ঘোষণা করেছি। এখন তা বাস্তবায়নে কাজ করছি। দারিদ্র্যই বাংলাদেশের একমাত্র শত্রু উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ দারিদ্র্য থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সরকার দারিদ্র্য নির্মূলে সফল হবে বলে আশাবাদও ব্যক্ত করেন তিনি।
শেখ হাসিনা ‘জাতির পিতা’র বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগ চাই। যে কোনো অর্জনের জন্য ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। ভোগে না, ত্যাগেই সব থেকে বড় অর্জন করা যেতে পারে। ‘জাতির পিতা’র সেই আদর্শ বুকে নিয়েই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ইনশাআল্লাহ এগিয়ে যাবে। কি অর্জন করেছি সেটা বড় কথা নয়, এখনও মনে করি আমাদের আরও অনেক দূর পথ চলতে হবে। অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশকে আরও উন্নয়নের উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে হবে, সেটাই হল আমার প্রতিজ্ঞা। সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করায় ভারতকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু ১৯৭১ সাল থেকে। আমরা সেই বন্ধুত্বের প্রমাণ পেয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তারা অস্ত্র দিয়েছে, মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। স্বীকৃতিও পেয়েছি তাদের কাছ থেকে। তাদের সহযোগিতায় আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দারিদ্র্যের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা। যে কোনো দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অনেক সমস্যা সমাধান করা যায়।
সংবর্ধনা সভায় শ্লোগান ছিল না। ছিল শুধু মুহুর্মুহু করতালি। এদিন রুচিশীল-সুশৃংখলিত অনুষ্ঠানে প্রথমে তীব্র গরম পরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রিয় নেত্রীর সংবর্ধনায় নেতা-কর্মীরা গেঞ্জি, টুপি পরে উপস্থিত হন। তবে, এ অনুষ্ঠান ঘিরে শুক্রবারেও শাহবাগ, রমনা, প্রেসক্লাব, হাইকোর্ট এবং দোয়েল চত্বরের চারপাশে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
এ সংবর্ধনাকে ঘিরে গোটা সোহরাওর্য়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকা ছিল লোকে-লোকারণ্য। নেতা-কর্মীদের ব্যানার আনতে নিষেধ করা হলেও প্রায় প্রতিটি মিছিলের সামনে ছিল ব্যানার। তবে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার পরপরই তাদের ব্যানার গুটিয়ে ফেলতে দেখা যায়। অন্যদিকে অনুষ্ঠান চলাকালীন মঞ্চের পেছনে থেকে মাঝে মাঝে শ্লোগানের শব্দও শোনা যায়।
তীব্র গরমের মধ্যে দুপুর থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতা-কর্মীদের আগমন শুরু হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীদের আসতে দেখা যায়। বিকাল ৩টার মধ্যে শাহবাগ, টিএসসি এলাকা মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে ভরে উঠতে থাকে অনুষ্ঠানস্থল। নেতা-কর্মীরা লাইনে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে মঞ্চের আশপাশে প্রবেশ করেন। কিন্তু বাদ সাধে বৃষ্টি। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে মঞ্চে যখন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখনি নামে বৃষ্টি। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা অনেক মানুষ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেন আশপাশের গাছতলায়। অনেককে টিএসসির দিকেও ছুটতে দেখা যায়। অনেকে আবার মঞ্চের কাছে না গিয়ে ফিরে যান। এ সময়েই অনুষ্ঠানস্থলে এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর আসার পরপরই জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। নাগরিক কমিটির সভাপতি সৈয়দ শামসুল হকের স্বাগত বক্তব্যের পর শামীম আরা নিপা ও তার দলের মনোমুগ্ধকর নৃত্য এবং সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এরপর শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা স্মারক তুলে দেয়া হয়। অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক এবং অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট নাগরিকরা ছিলেন দর্শক সারিতে। বক্তব্যের ফাঁকে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্র এবং নজরুল সঙ্গীত। এরপর আবারও বক্তব্য চলতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মমতাজের গান এবং শামীম আরা নিপার আরেকটি নাচ দিয়ে শেষ হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
শুক্রবারের এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কারণে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এ যানজট ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাতেও। চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, মূলত অনুষ্ঠানে আসা অতিথি ও দর্শকদের গাড়ি যত্রতত্র পার্ক করে রাখার কারণেই যানজট সৃষ্টি হয়। এছাড়া নেতা-কর্মীদের রাজপথে মিছিলের কারণেও যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটে।(দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

‘দেশরতœ’ উপাধি ভূষিত : বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সব ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত : নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রকাশের সময় : ০৯:১২:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ মে ২০১৫

ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে সম্মাননা তাকে দেয়া হল এটি তার প্রাপ্য নয়। এ সম্মাননা বাংলাদেশের জনগণের প্রাপ্য। তিনি বলেন, ‘আমি এ সম্মাননা বাংলার জনগণকে উৎসর্গ করছি।’ ২৯ মে শুক্রবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বর্ণাঢ্য নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নসহ জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জনের জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রধানমন্ত্রীকে এ সংবর্ধনা দেয়। এ সময় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। জন্মেছি যেহেতু একদিন মরতে হবেই। বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যাব। সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে চলবে।’
বিকাল সাড়ে ৩টায় নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তার আগে এক ঝলক বৃষ্টি উড়ে এসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়া মানুষকে ভিজিয়ে দেয়। তা সত্ত্বেও বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও দলে দলে মিছিল নিয়ে এ নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক কমিটির সভাপতি সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক। বিকাল ৪টার পরে জাতীয় সঙ্গীত ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। সৈয়দ শামসুল হক সংবর্ধনার শুরু ও শেষে বক্তৃতা করেন। তিনি শেখ হাসিনাকে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে ‘দেশরতœ’ উপাধি দিয়ে বলেন, এখন থেকে আপনারা সবাই শেখ হাসিনার নামের আগে আবশ্যিকভাবে ‘দেশরতœ’ শব্দ ব্যবহার করবেন।
সূচনা বক্তব্যের পর সৈয়দ শামসুল হকের রচিত ‘মর্ম সঙ্গীত’ এবং নৃত্য পরিবেশিত হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন নৃত্যাঞ্চলের সদস্যরা দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন। অ্যামেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন। এর আগে, শেখ হাসিনার হাতে নৌকা সদৃশ স্মারক তুলে দেন সৈয়দ শামসুল হক ও ড. আনিসুজ্জামান। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী নেতা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ঢাকা সিটির দুই মেয়রসহ বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান। বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে গান। শিল্পী মিতা হক ও মহিউজ্জামান চৌধুরী দ্বৈত কণ্ঠে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…’ রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
প্রধানমন্ত্রী ৬টা ৭ মিনিটে বক্তৃতা শুরু করে শেষ করেন ৬টা ৩০ মিনিটে। ২৩ মিনিটের বক্তৃতা ছিল ’৭৫ পরবর্তী সময়ে তার দেশে ফেরার স্মৃতিচারণ, সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য, উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ আশাবাদ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখান ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৪১ বছরের মাথায় ভারত সরকার এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। এজন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে বিদ্রুপ করে বলেছিল- স্বাধীন হলে বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। সেই ঝুড়ি এখন উন্নয়নে ভরপুর। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নে ভরপুর একটি রাষ্ট্র।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই সরকারের দায়িত্ব। আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের উন্নয়ন। সেই গ্রামের অবহেলিত মানুষটিরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তার সেই অধিকার রক্ষাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। প্রতিটি মানুষ তার অধিকার পাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি জাতির জীবনে কোনো দিকদর্শন না থাকলে সে জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রূপকল্প ঘোষণা করেছি। এখন তা বাস্তবায়নে কাজ করছি। দারিদ্র্যই বাংলাদেশের একমাত্র শত্রু উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ দারিদ্র্য থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সরকার দারিদ্র্য নির্মূলে সফল হবে বলে আশাবাদও ব্যক্ত করেন তিনি।
শেখ হাসিনা ‘জাতির পিতা’র বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগ চাই। যে কোনো অর্জনের জন্য ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। ভোগে না, ত্যাগেই সব থেকে বড় অর্জন করা যেতে পারে। ‘জাতির পিতা’র সেই আদর্শ বুকে নিয়েই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ইনশাআল্লাহ এগিয়ে যাবে। কি অর্জন করেছি সেটা বড় কথা নয়, এখনও মনে করি আমাদের আরও অনেক দূর পথ চলতে হবে। অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশকে আরও উন্নয়নের উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে হবে, সেটাই হল আমার প্রতিজ্ঞা। সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করায় ভারতকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু ১৯৭১ সাল থেকে। আমরা সেই বন্ধুত্বের প্রমাণ পেয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তারা অস্ত্র দিয়েছে, মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। স্বীকৃতিও পেয়েছি তাদের কাছ থেকে। তাদের সহযোগিতায় আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দারিদ্র্যের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা। যে কোনো দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অনেক সমস্যা সমাধান করা যায়।
সংবর্ধনা সভায় শ্লোগান ছিল না। ছিল শুধু মুহুর্মুহু করতালি। এদিন রুচিশীল-সুশৃংখলিত অনুষ্ঠানে প্রথমে তীব্র গরম পরে বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রিয় নেত্রীর সংবর্ধনায় নেতা-কর্মীরা গেঞ্জি, টুপি পরে উপস্থিত হন। তবে, এ অনুষ্ঠান ঘিরে শুক্রবারেও শাহবাগ, রমনা, প্রেসক্লাব, হাইকোর্ট এবং দোয়েল চত্বরের চারপাশে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
এ সংবর্ধনাকে ঘিরে গোটা সোহরাওর্য়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকা ছিল লোকে-লোকারণ্য। নেতা-কর্মীদের ব্যানার আনতে নিষেধ করা হলেও প্রায় প্রতিটি মিছিলের সামনে ছিল ব্যানার। তবে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার পরপরই তাদের ব্যানার গুটিয়ে ফেলতে দেখা যায়। অন্যদিকে অনুষ্ঠান চলাকালীন মঞ্চের পেছনে থেকে মাঝে মাঝে শ্লোগানের শব্দও শোনা যায়।
তীব্র গরমের মধ্যে দুপুর থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতা-কর্মীদের আগমন শুরু হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীদের আসতে দেখা যায়। বিকাল ৩টার মধ্যে শাহবাগ, টিএসসি এলাকা মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে ভরে উঠতে থাকে অনুষ্ঠানস্থল। নেতা-কর্মীরা লাইনে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে মঞ্চের আশপাশে প্রবেশ করেন। কিন্তু বাদ সাধে বৃষ্টি। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে মঞ্চে যখন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখনি নামে বৃষ্টি। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা অনেক মানুষ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেন আশপাশের গাছতলায়। অনেককে টিএসসির দিকেও ছুটতে দেখা যায়। অনেকে আবার মঞ্চের কাছে না গিয়ে ফিরে যান। এ সময়েই অনুষ্ঠানস্থলে এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর আসার পরপরই জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। নাগরিক কমিটির সভাপতি সৈয়দ শামসুল হকের স্বাগত বক্তব্যের পর শামীম আরা নিপা ও তার দলের মনোমুগ্ধকর নৃত্য এবং সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এরপর শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা স্মারক তুলে দেয়া হয়। অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক এবং অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট নাগরিকরা ছিলেন দর্শক সারিতে। বক্তব্যের ফাঁকে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্র এবং নজরুল সঙ্গীত। এরপর আবারও বক্তব্য চলতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মমতাজের গান এবং শামীম আরা নিপার আরেকটি নাচ দিয়ে শেষ হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
শুক্রবারের এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কারণে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এ যানজট ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাতেও। চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, মূলত অনুষ্ঠানে আসা অতিথি ও দর্শকদের গাড়ি যত্রতত্র পার্ক করে রাখার কারণেই যানজট সৃষ্টি হয়। এছাড়া নেতা-কর্মীদের রাজপথে মিছিলের কারণেও যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটে।(দৈনিক যুগান্তর)