তিন বিদেশি গণমাধ্যমে একই দিনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ইমেইল সাক্ষাৎকার : রহস্য কী?
- প্রকাশের সময় : ০১:৫১:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
- / ২০ বার পঠিত
ঢাকা ডেস্ক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে উৎখাত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার সাক্ষাৎকার একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একই দিনে প্রকাশিত হওয়ায় নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং এএফপি ইমেইলের মাধ্যমে এসব সাক্ষাৎকার নিয়েছে বলে জানিয়েছে। পলাতক জীবনে হাসিনার প্রথম এই সাক্ষাৎকার নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা ও জল্পনা।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, খুনি হাসিনা লিখিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন এবং তিনটি সাক্ষাৎকারে একই ভাষায় কথা বলেছেন। তাই প্রশ্ন উঠেছে, উত্তরগুলো হয়তোবা একই সেট প্রশ্নের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে বা তিনি সব গণমাধ্যমকে একই লিখিত উত্তর পাঠিয়েছেন। ফলে এসব উত্তর অন্য কেউ দিয়েছেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ তোলার যথেষ্ট কারণ দেখছেন অনেকে।
রয়টার্সকে দেওয়া মন্তব্যে শেখ হাসিনা জানান, ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করেন এবং ভবিষ্যতে শেখ পরিবারের রাজনীতিতে নেতৃত্ব অপরিহার্য নয় বলেও মত দেন। দি ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগ করেন, তার অনুপস্থিতিতে চলমান বিচারপ্রক্রিয়া ‘লজ্জাজনক’ এবং জুলাইয়ের রক্তপাতের জন্য তাকে দায়ী করা অন্যায্য। সাক্ষাৎকারে কোনো কিছুর দায় স্বীকার বা অনুশোচনা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি এই রক্তপিপাসু গণহত্যাকারীকে। যেখানে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ওই সহিংসতায় ১,৪০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শেষ হয়েছে এবং আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত হবে বলে জানা গেছে। এমন এক সময়ে এই সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ পাওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনটি সাক্ষাৎকারেই বিষয়বস্তু, ভাষা এবং শব্দচয়নে অবিশ্বাস্য মিল পাওয়া গেছে। ফলে এটি নিছক কাকতালীয় না হয়ে বরং একটি সমন্বিত বা সিন্ডিকেটেড প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্যদিকে, তিনটি আউটলেটই তাদের নিজস্ব প্রতিবেদনকে শেখ হাসিনার ‘পতনের পর প্রথম সাক্ষাৎকার’ হিসেবে দাবি করেছে, যা তাদের পেশাদারিত্ব এবং প্রকাশের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
সাংবাদিক নাজমুল আহসানের মন্তব্যকে সমর্থন করে অনেকেই বলছেন, কোনো পাবলিক রিলেশন (পিআর) ফার্মের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারগুলো সমন্বয় করা হয়েছে। এই ফার্ম সম্ভবত প্রশ্নের কাছাকাছি সেট এবং লিখিত উত্তরগুলি তৈরি করে গণমাধ্যমগুলিতে বিতরণ করেছে। যদি পিআর ফার্মের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারগুলো সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, তবে কোনো সংবাদমাধ্যমই এই প্রক্রিয়াটি প্রকাশ না করায় পাঠকের কাছে তথ্যের উৎস নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
এদিকে, ইমেইল সাক্ষাৎকারের কথা বললেও, জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা শেখ হাসিনা নিজেই উত্তর দিয়েছেন কিনা, কিংবা এই উত্তরগুলোর সত্যতা কিভাবে যাচাই করা হয়েছে, তা উল্লেখ করেনি বিদেশি গণমাধ্যমগুলো। আর সাক্ষাৎকারগুলো এমন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে যখন ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রকাশ বা প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
রয়টার্স জানায়, তাদের সাক্ষাৎকারটি নয়াদিল্লি থেকে ইমেইলের মাধ্যমে নেন কৃষ্ণা এন. দাস, সরিতা চাগান্তি সিংহ ও ঢাকার রুমা পাল। এএফপি জানিয়েছে, তারা নয়াদিল্লি থেকে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তবে সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করেনি।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুযায়ী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রচার বা প্রেস বিবৃতি প্রকাশ নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞার পরেও প্রায় সকল দেশীয় অনলাইন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হওয়ায় আইনি বৈধতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, সাক্ষাৎকারগুলোতে গুম, খুন, লুটপাট বা অর্থ পাচার সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। এর থেকে বোঝা যায়, এই প্রক্রিয়াটি ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং এটি মূলত আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। ভারতের সহায়তা ও লুটপাটের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যায় করে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রকাশের মাধ্যমে হাসিনা দেশের ভেতরের ও বাইরের বিভিন্ন মহলে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, তিনি এখনও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁর বক্তব্য শোনা হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনে তাঁর দলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা শুরু করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের মন্তব্যের পর সাক্ষাৎকার প্রকাশ হওয়ায়, কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, খালেদ মুহিউদ্দীন কি এই সাক্ষাৎকারের প্রভাব অনুধাবনের জন্য পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন কিনা। এরআগে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফ্যাসিস্ট হাসিনা যদি সাক্ষাৎকার দিতে চান, সেক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটলেও তা নেবেন বলে সম্প্রতি তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এপ্রসঙ্গে বলেন, গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের সময় আদালতে উপস্থাপিত প্রমাণ, জাতিসংঘের তথ্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো স্মরণ রাখা জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভারত কেবল শেখ হাসিনার নিরাপদ আশ্রয়ই নিশ্চিত করেনি, বরং বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের স্থিতিশীলতাকে নানাভাবে প্রভাবিত করার কৌশলও চালিয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার আগে দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে ঘিরে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ বাড়বার কারণ ও উদ্দেশ্য কী?
বিশিষ্ট সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন, ‘ক্ষমতাচ্যুতির ১৪ মাস পরে বিশ্বের প্রথম সারির একাধিক সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্র শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশ করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব রয়েছে। গুরুত্ব কমছে না। বাড়ছে।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ লিখেছেন, শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুটো বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার তা হল, জুলাই গণভূত্থানে তার নির্দেশে ৩৬ দিনে যে বিপুল হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে তাতে তার ভেতরে কোন ধরনের অনুতাপ ও অনুশোচনা নেই। তিনি এখনো তার ভুলগুলো উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের কাজকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছেন। এ কারণেই তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
‘শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, দেশে থাকা তাদের লাখ লাখো নেতাকর্মী যারা আশায় রয়েছেন, আপা টুপ করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বেন- সে ধন্য আশা কুহকিনী। সারাদেশে আওয়ামী লীগের লাখো লাখো নেতাকর্মী যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আপা আপা ডাক পাড়ি’ বলি আওড়াচ্ছেন তাদের আশা চোরাবালিতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ও প্রতিপক্ষের হামলার ভয় উপেক্ষা করেও আওয়ামী লীগের যে সমস্ত জানবাজ কর্মী এখনো ঘটিকা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরুচ্ছেন যে কোন দিন আপার ফিরে আসার প্রত্যাশায় তারা এখন বুঝতে পারবেন কী বিশাল মরীচিকার পিছনে তারা ছুটেছিলেন এতদিন। ‘আয়রে আপা ফিরে আয়’ ঘুম পাড়ানী ছড়ায় আওয়ামী লীগের লাখো নেতা কর্মী যারা আশায় তন্দ্রা দোলায় বিলোলিত ছিল তাদের এখন রাজপথের তপ্ত পিচে বাস্তবতার কঠিন সত্য মেনে নেয়ার সময় এসেছে, ‘আপা আর হয়তো কখনো ফিরবে না বাংলাদেশে’,’ বলেন তিনি। (দৈনিক ইনকিলাব)


















