নিউইয়র্ক ০৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

তিন দশকে দেশে বিদেশী বিনিয়োগের সাফল্য হাতে গোনা কয়েকটি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৪:৫৩:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / ৭৪ বার পঠিত

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছয় দশক ধরে ব্যবসা করছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা করেছিল লিভার ব্রাদার্স নামে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৯৬৪ সালে সাবানের কারখানা চালুর মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৫ জুলাই যাত্রা হয় লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশের। আবারো নাম পাল্টে ২০০৪ সালে হয় ইউনিলিভার। বহুজাতিক কোম্পানিটির ৪০ শতাংশ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, দেশের প্রতি ১০ পরিবারের নয়টিতেই ব্যবহার হয় তাদের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এফএমসিজি পণ্য। আশির দশকের পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে বড় অবদান রেখেছে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই)। তবে বাংলাদেশের পালে মুক্তবাজার অর্থনীতির হাওয়া লাগে নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু সে সময় থেকে গত তিন দশকে নতুন মূলধন নিয়ে আসা এফডিআই প্রকল্প হাতে গোনা অল্প কয়েকটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ের মধ্যে লাফার্জহোলসিম, কোটস, ম্যারিকো, ইয়াংওয়ান, আইগ্যাজসহ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে এলেও গ্রামীণফোন ছাড়া আর কোনোটি সেভাবে উল্লেখ করার মতো ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আর দেশে গত ছয় দশকে এফডিআই-ভিত্তিক সফল প্রকল্প হিসেবে ইউনিলিভারের নামকে সবার ওপরে রাখছেন বিদেশী বিনিয়োগসংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে এফডিআই। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে পুঞ্জীভূত বিদেশী বিনিয়োগ স্টক রয়েছে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসা কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হলেও এ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের বিষয়টি শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ। বিদেশীদের আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও এর ধারাবাহিকতা ছিল না। বিনিয়োগ উপযোগী হিসেবে আস্থা অর্জন থেকেও বারবার ছিটকে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। আবার বিনিয়োগ ধরে রাখতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা, তা দূর হয়নি গত তিন দশকে। সব মিলিয়ে হাতে গোনা দু-একটি কোম্পানি ছাড়া বিদেশী বিনিয়োগের বড় সফলতার গল্প তৈরি হয়নি এ দেশে।

এ বিষয়ে কথা হয় ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাভেদ আখতারের সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেকোনো কোম্পানির জন্য অসাধারণ এক বাজার হলো বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব নয়। প্রথমত, বিনিয়োগকারীরা দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ আমরা কথা দিয়ে কথা রাখিনি, এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। এরপর রয়েছে আমাদের বিনিয়োগ নীতির ধারাবাহিকতার অভাব। বছর বছর নীতি পরিবর্তনের উদাহরণ আছে। পরিশেষে আমাদের বিনিয়োগে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারী সংস্থার কাজ সহজ ও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়।’ এসব সমস্যা সমাধানে একটি সংস্থার কাছে সব দায়িত্ব দিয়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন জাভেদ আখতার। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের যাবতীয় কাজ ও অনুমোদন অনলাইনে নিয়ে আসতে হবে। সব শেষে প্রয়োজন একবারে যাতে সব কাজ সম্পন্ন করা যায়; বারবার একই জিনিসের জন্য যেন বিভিন্ন সংস্থার কাছে যেতে না হয়।’

গ্রাহক সংখ্যা ও আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোন লিমিটেড। নরওয়েভিত্তিক টেলিনর গ্রুপ ও বাংলাদেশের গ্রামীণ টেলিকমের যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ কোম্পানিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। দেশের পুঁজিবাজারে আসে ২০০৯ সালে। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে গ্রামীণফোনের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় ছিল ৩ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। ২০২৩ হিসাব বছরে আয় হয়েছে ১৫ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৪৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে গ্রামীণফোন এখন দেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় কোম্পানি।

জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এফডিআই আকর্ষণ করতে আমাদের প্রয়োজন সবার আগে দেশের ব্র্যান্ডিং। এজন্য বিনিয়োগকারীরা মূল্যায়ন করবে এমন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ব্যবসার জন্য আগে থেকে অনুধাবনযোগ্য একটি স্থিতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সিংয়ের অধিকার প্রয়োগেরও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে সরকারকেও সততার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।’ গ্রামীণফোন ছাড়াও গত তিন দশকে আরো চার বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। সেগুলো হচ্ছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ পিএলসি, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড ও রবি আজিয়াটা পিএলসি।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক হোলসিম গ্রুপ ও স্পেনভিত্তিক সিমেন্টোস মলিন্স গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ ইনকরপোরেটেড হয় ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর। কোম্পানিটি ২০০৩ সালে পুঁজিবাজারে আসে। গত দুই দশকেরও বেশি সময়ে একটি সিমেন্ট প্লান্ট ও তিনটি গ্রাইন্ডিং স্টেশনে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে লাফার্জহোলসিম। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় দাঁড়িয়েছে ৭৫৭ কোটি টাকায়। ২০২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৫৯৪ কোটি টাকা। ডিএসইতে গত বৃহস্পতিবার লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। মুম্বাইভিত্তিক এফএমসিজি কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি। পুঁজিবাজারে আসে ২০০৯ সালে। নারকেল তেলের বাজারে ম্যারিকোর ব্র্যান্ড প্যারাসুট বর্তমানে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া দেশে সাফোলা ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেলও বাজারজাত করছে কোম্পানিটি। ২০২৪ হিসাব বছরে ম্যারিকো বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৩ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় দাঁড়িয়েছে ৭০৫ কোটি টাকায়। ২০২৪ হিসাব বছরে ম্যারিকো বাংলাদেশের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৭ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ২০০০ সালের ১২ নভেম্বর। কোম্পানিটি ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে আসে। ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ১ হাজার ৬১১ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় ১৫৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটি ব্যবসা থেকে ৭৮২ কোটি টাকা আয় করেছে। কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশের বাজার মূলধন ৯৭১ কোটি টাকা ছিল।

মালয়েশিয়াভিত্তিক আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদের উদ্যোগ রবি আজিয়াটা পিএলসি ১৯৯৭ সালে একটেল ব্র্যান্ড নামে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। ২০১০ সালে কোম্পানিটি নাম পাল্টে রাখে রবি। ২০১৬ সালে এয়ারটেলকে অধিগ্রহণ করে রবি আজিয়াটা। গ্রাহক সংখ্যার দিক দিয়ে কোম্পানিটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর। কোম্পানিটি দেশের পুঁজিবাজারে আসে ২০২০ সালে। রবি আজিয়াটার ২০২৩ হিসাব বছরে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ২১ হাজার ৩৫৪ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় ৫৬১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ হিসাব বছরে রবি আজিয়াটার কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ৩২১ কোটি টাকা। ডিএসইতে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১৪ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড যৌথভাবে কাজ করে আসছে। জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের সিইও নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘গত তিন দশকে কিছু সফল বিনিয়োগ হয়েছে, যেমন জ্বালানি খাতে শেভরন, টেলিযোগাযোগ খাতে টেলিনর। এছাড়া আছে নেসলে, লাফার্জহোলসিম, কোটস, ইয়াংওয়ান, ম্যারিকো ইত্যাদি। তবে এটি সত্য যে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করলে এফডিআইয়ের গতি বজায় রাখতে এবং মোট বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অংশে আসার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আমরা সবাই জানি যে এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব। বিনিয়োগকারীদের কাছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটিকে নির্বাচনের অপশন থাকে। ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা, উৎপাদনের অনুকূল ফ্যাক্টর, ব্যবসা পরিচালনার সহজতা ইত্যাদির ওপর বিনিয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে। এটি প্রতিষ্ঠিত যে বর্তমান এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা উন্নত করার জন্য উল্লেখযোগ্য কাজ করতে হবে, অর্থাৎ ব্যবসা পরিচালনার সহজতা।’

গত তিন দশকে দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ধাবিত হলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিবেশে বড় ধরনের কোনো উন্নতি হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া কাউকেই তেমন আকৃষ্ট করা যায়নি। আবার ইউনিলিভার, গ্রামীণফোন বা বিএটিবিসির মতো কোম্পানির সফলতা দেখা গেলেও এগুলো বেশ নিরাপদ পরিবেশে এসেছে। তাদের জন্য নীতিগুলো বেশ সহায়ক ছিল। যেমন ইউনিলিভারের পণ্যগুলোর অধিকাংশই ট্যারিফ সুবিধা পেয়ে আসছে। আবার গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে তাদের মার্কেটটা বেশ অলিগোপলিস্টিক; কম্পিটিটিভ না। ফলে তারা যেভাবে মুনাফা করতে পেরেছে তা অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের জন্য দরকার এমন একটা ব্যবসার পরিবেশ যেখানে তারা সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারবে এবং নানাভাবে তাদের প্রফিটগুলো রিপ্যাট্রিয়েট করতে পারবে নিয়মের মধ্যেই। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আমলাতান্ত্রিক হয়রানির শিকার হবে না। এফডিআই হিসেবে যা প্রত্যাশা ও প্রয়োজন, বিশেষ করে আমরা যদি ম্যানুফ্যাকচারিং-ভিত্তিক বৈচিত্র্যময় এফডিআইয়ের বিষয়ে চিন্তা করি, যেগুলো আকর্ষণে ভিয়েতনাম সফলতা দেখিয়েছে। সেবা খাতেও দেশটি একই সফলতা দেখিয়েছে।’

বিদেশী বিনিয়োগ আনার জন্য যে ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ দরকার বাংলাদেশ সেটা এত বছরেও গড়ে তুলতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন এ অর্থনীতিবিদ। সেলিম রায়হান আরো বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগকারী যারা আসে তারা সবাই তো আর বহুজাতিক হবে না। সেজন্য সবার কথা মাথায় রেখে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে আমরা পারিনি। এমনকি বহুজাতিক কোম্পানি যারা আছে তারাও বিনিয়োগ পরিবেশের সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতার কারণে তারা অনেকটা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মতো হয়ে গেছে। তারা লুপ হোলস জানে, কোথায় কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেগুলোও তারা জানে। কিন্তু নতুন কোনো বিদেশী বিনিয়োগকারী চাইবে না ম্যানেজ করে বিনিয়োগ পরিচালনা করতে। তারা চায় একটা রুলস বেজড ব্যবস্থা, যেখানে কোনো অন্যায় হলে সে প্রতিকার পাবে। আমরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও পরিবেশের বড় ধরনের উন্নতি করতে পারিনি, ফলে বিদেশীদেরও এ দেশে আনতে পারিনি।’ সূত্র : বণিক বার্তা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

তিন দশকে দেশে বিদেশী বিনিয়োগের সাফল্য হাতে গোনা কয়েকটি

প্রকাশের সময় : ০৪:৫৩:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছয় দশক ধরে ব্যবসা করছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা করেছিল লিভার ব্রাদার্স নামে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৯৬৪ সালে সাবানের কারখানা চালুর মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৫ জুলাই যাত্রা হয় লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশের। আবারো নাম পাল্টে ২০০৪ সালে হয় ইউনিলিভার। বহুজাতিক কোম্পানিটির ৪০ শতাংশ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, দেশের প্রতি ১০ পরিবারের নয়টিতেই ব্যবহার হয় তাদের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এফএমসিজি পণ্য। আশির দশকের পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে বড় অবদান রেখেছে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই)। তবে বাংলাদেশের পালে মুক্তবাজার অর্থনীতির হাওয়া লাগে নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু সে সময় থেকে গত তিন দশকে নতুন মূলধন নিয়ে আসা এফডিআই প্রকল্প হাতে গোনা অল্প কয়েকটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ের মধ্যে লাফার্জহোলসিম, কোটস, ম্যারিকো, ইয়াংওয়ান, আইগ্যাজসহ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে এলেও গ্রামীণফোন ছাড়া আর কোনোটি সেভাবে উল্লেখ করার মতো ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আর দেশে গত ছয় দশকে এফডিআই-ভিত্তিক সফল প্রকল্প হিসেবে ইউনিলিভারের নামকে সবার ওপরে রাখছেন বিদেশী বিনিয়োগসংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে এফডিআই। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে পুঞ্জীভূত বিদেশী বিনিয়োগ স্টক রয়েছে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসা কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হলেও এ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের বিষয়টি শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ। বিদেশীদের আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও এর ধারাবাহিকতা ছিল না। বিনিয়োগ উপযোগী হিসেবে আস্থা অর্জন থেকেও বারবার ছিটকে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। আবার বিনিয়োগ ধরে রাখতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা ও সমন্বয়হীনতা, তা দূর হয়নি গত তিন দশকে। সব মিলিয়ে হাতে গোনা দু-একটি কোম্পানি ছাড়া বিদেশী বিনিয়োগের বড় সফলতার গল্প তৈরি হয়নি এ দেশে।

এ বিষয়ে কথা হয় ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাভেদ আখতারের সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেকোনো কোম্পানির জন্য অসাধারণ এক বাজার হলো বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব নয়। প্রথমত, বিনিয়োগকারীরা দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ আমরা কথা দিয়ে কথা রাখিনি, এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। এরপর রয়েছে আমাদের বিনিয়োগ নীতির ধারাবাহিকতার অভাব। বছর বছর নীতি পরিবর্তনের উদাহরণ আছে। পরিশেষে আমাদের বিনিয়োগে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারী সংস্থার কাজ সহজ ও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়।’ এসব সমস্যা সমাধানে একটি সংস্থার কাছে সব দায়িত্ব দিয়ে দেয়া উচিত বলে মনে করেন জাভেদ আখতার। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের যাবতীয় কাজ ও অনুমোদন অনলাইনে নিয়ে আসতে হবে। সব শেষে প্রয়োজন একবারে যাতে সব কাজ সম্পন্ন করা যায়; বারবার একই জিনিসের জন্য যেন বিভিন্ন সংস্থার কাছে যেতে না হয়।’

গ্রাহক সংখ্যা ও আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোন লিমিটেড। নরওয়েভিত্তিক টেলিনর গ্রুপ ও বাংলাদেশের গ্রামীণ টেলিকমের যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ কোম্পানিটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। দেশের পুঁজিবাজারে আসে ২০০৯ সালে। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে গ্রামীণফোনের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় ছিল ৩ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। ২০২৩ হিসাব বছরে আয় হয়েছে ১৫ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৪৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে গ্রামীণফোন এখন দেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় কোম্পানি।

জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এফডিআই আকর্ষণ করতে আমাদের প্রয়োজন সবার আগে দেশের ব্র্যান্ডিং। এজন্য বিনিয়োগকারীরা মূল্যায়ন করবে এমন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ব্যবসার জন্য আগে থেকে অনুধাবনযোগ্য একটি স্থিতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সিংয়ের অধিকার প্রয়োগেরও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে সরকারকেও সততার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।’ গ্রামীণফোন ছাড়াও গত তিন দশকে আরো চার বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। সেগুলো হচ্ছে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ পিএলসি, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড ও রবি আজিয়াটা পিএলসি।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক হোলসিম গ্রুপ ও স্পেনভিত্তিক সিমেন্টোস মলিন্স গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ ইনকরপোরেটেড হয় ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর। কোম্পানিটি ২০০৩ সালে পুঁজিবাজারে আসে। গত দুই দশকেরও বেশি সময়ে একটি সিমেন্ট প্লান্ট ও তিনটি গ্রাইন্ডিং স্টেশনে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে লাফার্জহোলসিম। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় দাঁড়িয়েছে ৭৫৭ কোটি টাকায়। ২০২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৫৯৪ কোটি টাকা। ডিএসইতে গত বৃহস্পতিবার লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। মুম্বাইভিত্তিক এফএমসিজি কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি। পুঁজিবাজারে আসে ২০০৯ সালে। নারকেল তেলের বাজারে ম্যারিকোর ব্র্যান্ড প্যারাসুট বর্তমানে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া দেশে সাফোলা ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেলও বাজারজাত করছে কোম্পানিটি। ২০২৪ হিসাব বছরে ম্যারিকো বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৩ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় দাঁড়িয়েছে ৭০৫ কোটি টাকায়। ২০২৪ হিসাব বছরে ম্যারিকো বাংলাদেশের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৭ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ২০০০ সালের ১২ নভেম্বর। কোম্পানিটি ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে আসে। ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ১ হাজার ৬১১ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় ১৫৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটি ব্যবসা থেকে ৭৮২ কোটি টাকা আয় করেছে। কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশের বাজার মূলধন ৯৭১ কোটি টাকা ছিল।

মালয়েশিয়াভিত্তিক আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদের উদ্যোগ রবি আজিয়াটা পিএলসি ১৯৯৭ সালে একটেল ব্র্যান্ড নামে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। ২০১০ সালে কোম্পানিটি নাম পাল্টে রাখে রবি। ২০১৬ সালে এয়ারটেলকে অধিগ্রহণ করে রবি আজিয়াটা। গ্রাহক সংখ্যার দিক দিয়ে কোম্পানিটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম টেলিকম অপারেটর। কোম্পানিটি দেশের পুঁজিবাজারে আসে ২০২০ সালে। রবি আজিয়াটার ২০২৩ হিসাব বছরে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে কোম্পানিটির মোট সম্পদ ২১ হাজার ৩৫৪ কোটি এবং সংরক্ষিত আয় ৫৬১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ হিসাব বছরে রবি আজিয়াটার কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ৩২১ কোটি টাকা। ডিএসইতে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ১৪ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড যৌথভাবে কাজ করে আসছে। জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের সিইও নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘গত তিন দশকে কিছু সফল বিনিয়োগ হয়েছে, যেমন জ্বালানি খাতে শেভরন, টেলিযোগাযোগ খাতে টেলিনর। এছাড়া আছে নেসলে, লাফার্জহোলসিম, কোটস, ইয়াংওয়ান, ম্যারিকো ইত্যাদি। তবে এটি সত্য যে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করলে এফডিআইয়ের গতি বজায় রাখতে এবং মোট বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অংশে আসার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। আমরা সবাই জানি যে এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব। বিনিয়োগকারীদের কাছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটিকে নির্বাচনের অপশন থাকে। ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা, উৎপাদনের অনুকূল ফ্যাক্টর, ব্যবসা পরিচালনার সহজতা ইত্যাদির ওপর বিনিয়োগের বিষয়টি নির্ভর করে। এটি প্রতিষ্ঠিত যে বর্তমান এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা উন্নত করার জন্য উল্লেখযোগ্য কাজ করতে হবে, অর্থাৎ ব্যবসা পরিচালনার সহজতা।’

গত তিন দশকে দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ধাবিত হলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিবেশে বড় ধরনের কোনো উন্নতি হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া কাউকেই তেমন আকৃষ্ট করা যায়নি। আবার ইউনিলিভার, গ্রামীণফোন বা বিএটিবিসির মতো কোম্পানির সফলতা দেখা গেলেও এগুলো বেশ নিরাপদ পরিবেশে এসেছে। তাদের জন্য নীতিগুলো বেশ সহায়ক ছিল। যেমন ইউনিলিভারের পণ্যগুলোর অধিকাংশই ট্যারিফ সুবিধা পেয়ে আসছে। আবার গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে তাদের মার্কেটটা বেশ অলিগোপলিস্টিক; কম্পিটিটিভ না। ফলে তারা যেভাবে মুনাফা করতে পেরেছে তা অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের জন্য দরকার এমন একটা ব্যবসার পরিবেশ যেখানে তারা সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারবে এবং নানাভাবে তাদের প্রফিটগুলো রিপ্যাট্রিয়েট করতে পারবে নিয়মের মধ্যেই। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আমলাতান্ত্রিক হয়রানির শিকার হবে না। এফডিআই হিসেবে যা প্রত্যাশা ও প্রয়োজন, বিশেষ করে আমরা যদি ম্যানুফ্যাকচারিং-ভিত্তিক বৈচিত্র্যময় এফডিআইয়ের বিষয়ে চিন্তা করি, যেগুলো আকর্ষণে ভিয়েতনাম সফলতা দেখিয়েছে। সেবা খাতেও দেশটি একই সফলতা দেখিয়েছে।’

বিদেশী বিনিয়োগ আনার জন্য যে ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ দরকার বাংলাদেশ সেটা এত বছরেও গড়ে তুলতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন এ অর্থনীতিবিদ। সেলিম রায়হান আরো বলেন, ‘বিদেশী বিনিয়োগকারী যারা আসে তারা সবাই তো আর বহুজাতিক হবে না। সেজন্য সবার কথা মাথায় রেখে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে আমরা পারিনি। এমনকি বহুজাতিক কোম্পানি যারা আছে তারাও বিনিয়োগ পরিবেশের সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতার কারণে তারা অনেকটা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মতো হয়ে গেছে। তারা লুপ হোলস জানে, কোথায় কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেগুলোও তারা জানে। কিন্তু নতুন কোনো বিদেশী বিনিয়োগকারী চাইবে না ম্যানেজ করে বিনিয়োগ পরিচালনা করতে। তারা চায় একটা রুলস বেজড ব্যবস্থা, যেখানে কোনো অন্যায় হলে সে প্রতিকার পাবে। আমরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও পরিবেশের বড় ধরনের উন্নতি করতে পারিনি, ফলে বিদেশীদেরও এ দেশে আনতে পারিনি।’ সূত্র : বণিক বার্তা।