ঢাকায় উত্তপ্ত রাজনীতি নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস যা বলেছে-
- প্রকাশের সময় : ১২:৩৫:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২
- / ৩৩ বার পঠিত
ঢাকায় পুলিশ ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে একজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক ডজন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক শত মানুষকে। এরপর শুক্রবার খুব ভোরে বিরোধী দলের দুই সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যদিয়ে এক সপ্তাহের উত্তেজনা প্রশমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে বিরোধী পক্ষের ওপর দমনপীড়ন তীব্র হয়েছে। দেশটির ১৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বর্তমান সরকার কমপক্ষে এক দশক ক্ষমতায়। এ সময়টা চিহ্নিত হয়েছে কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ এবং বিস্ময়কর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। তবে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এই অগ্রগতির ক্ষতি করেছে।
আরোও পড়ুন।ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপি কার্যালয় দেখে ক্ষুব্ধ রাজনীতিবিদরা
‘বাংলাদেশ অ্যারেস্টস অপোজিশন লিডারস অ্যাজ ক্র্যাকডাউন ইনটেনসিফাইজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে বলা হয়, বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সিনিয়র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং মির্জা আব্বাসকে খুব ভোরে সাদা পোশাকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা গ্রেপ্তার করেছে। উভয় নেতার স্ত্রী এসব কথা বলেছেন।
দলটির নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে। তাকে রাজনীতি থেকেও বিরত রাখা হয়েছে। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকে বিরোধী দলের মূল নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম বলেন, আমাদের বাসায় চার জন লোক এসে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কেন তাকে প্রশ্ন করছেন। জবাবে তারা বলেন- ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাকে আটক করতে এসেছেন তারা। তবে এই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কে, সে বিষয়ে তারা কিছু বলেননি। পরে ঢাকার পুলিশ বলেছে, বিএনপি’র প্রধান কার্যালয়ের সামনে সংঘর্ষের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই দু’নেতাকে তুলে নিয়েছে তারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, শনিবারের পরিকল্পিত র্যালিকে সামনে রেখে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিপুল পরিমাণ নেতাকর্মীর সমাগম ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে ওই সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশের ৪৭ জন কর্মকর্তা আহত হন।
গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই নেতারা সমর্থকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদেরকে পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উস্কানি দিয়েছেন। উল্টো র্যালিতে স্যাবোটাজ করার জন্য পুলিশি কর্মকাণ্ডকে ‘সুসংগঠিত সহিংসতা’ বলে অভিযুক্ত করেছে বিএনপি। বিএনপি বলেছে, এটা হবে গত কয়েক সপ্তাহে যেসব সমাবেশ হয়েছে, তার সম্মিলিত রূপ ও বড় আকারের এক র্যালি। এতে লাখ লাখ নেতাকর্মীর যোগ দেয়ার কথা। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, সরকার যখন তার সমালোচকদের টার্গেট করেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেশের অর্থনৈতিক সফলতার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধির এক অনুপ্রেরণামূলক দেশ বলে অভিহিত করেছে। দারিদ্র্যতা কমিয়ে আনা এবং প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় মাথাপিছু আয় বেশি হওয়ার জন্য এমনটা বলেছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি থেকে অর্থনীতি যখন মাথা তুলে দাঁড়ানো শুরু করেছে, তখনই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এসে প্রভাব ফেলে। বিশ্বজুড়ে পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে রপ্তানি চাহিদা কমে গেছে। বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্য ও তেলের মূল্য। এতে দেশের ভেতরে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। ফলে সাড়ে চার শত কোটি ডলার সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক হতাশাকে কেন্দ্র করে জুলাই থেকে বিরোধী দল তাদের আন্দোলনে গতি আনার চেষ্টা করছে।
এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশে প্রায় এক ডজন বড় আকারের র্যালি সম্পন্ন করেছেন তারা। জার্মানভিত্তিক বাংলাদেশের রাজনীতির বিশ্লেষক ও লেকচারার মারুফ মল্লিক বলেন, অর্থনৈতিক টানাপড়েন এবং এর প্রভাবের কারণে সরকারের বাধা সত্ত্বেও বিরোধীদের র্যালিতে এত মানুষের ঢল নামছে। সরকার মনে করছে এই পরিস্থিতি যদি চলতেই থাকে তাহলে তাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে দুর্বল এই পরিস্থিতিতে তারা রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘অ্যাটাক’ করার চেষ্টা করছে। সংঘর্ষ তীব্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, সরকার একপেশে মনোভাব দেখিয়েছে। তারা নিজেদের সমর্থকদের রক্ষা করছে। বিরোধীদের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়েছে। এতে পুলিশ কৌশল হিসেবে সন্দেহজনকভাবে কয়েক শত ‘অজ্ঞাতনামা’ ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করেছে। অধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলেন, এই কৌশল ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করছে অবাধে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারা এই ‘ওপেন মামলা’ ব্যবহার করছে রাজনৈতিক বিরোধীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশিতে ওয়ারেন্ট হিসেবে। এটাকে দেখা যেতে পারে রাজনৈতিক হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শন হিসেবে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা বুধবার টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। এদিন বিএনপি’র হাজার হাজার সমর্থক ঢাকায় দলীয় প্রধান কার্যালয়ের সামনে সমবেত হন। তখনো শনিবারের র্যালির ভেন্যু নিয়ে সরকার ও এই দলটির মধ্যে অমতের কারণে অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। ওইদিন বিকালে বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় ওই এলাকা ঘেরাও করে। তারা বলেন, বিএনপি’র সমর্থকরা জনজীবনে বিশৃঙ্খলা এবং যান চলাচলে বাধা দিচ্ছেন। এসব সমর্থকের বিরুদ্ধে পুলিশ তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি এবং ভাঙচুরের অভিযোগ এনেছে। বলেছে, তারা হাতবোমা বহন করছিল। এ সময়ে তাদের ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করে তারা। এসব নেতাকর্মীকে তারা সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিএনপি’র এখনকার মূল নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা যেমনটা জমায়েত করি, এদিনও তেমনি কিছু মানুষের জমায়েত হয়েছিল। আকস্মিকভাবে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় পুলিশ। তারা আমাদের সমর্থকদের প্রহার শুরু করে। তারা সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। বন্দুক ব্যবহার করে। আমাদের দলীয় অফিসে আমাকে প্রবেশে বাধা দেয়। গ্রেপ্তার করে আমাদের লোকজনকে। আমাদের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র সাজাচ্ছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি জানি না, আমাদের অফিসের ভেতরে তারা কী করছে।
গত সপ্তাহে ঢাকায় বিদেশি ১৫টি মিশন একটি যৌথ বিবৃতি দেয়। এতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারের প্রতি জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস বলেছেন, আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সেটা হলো- ডিক্লেয়ারেশনের অধীনে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, মিডিয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রতি প্রতিশ্রুতির কথা বলা আছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমবেত এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর একজন সিনিয়র সহযোগী পাল্টা আক্রমণ করেছেন তাকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী বিরোধ এবং অস্ত্র বিষয়ক সহিংসতার দিকে আঙ্গুল তোলেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতাদের এক মিটিংয়ে বলেছেন, কারও নির্দেশ বা হস্তক্ষেপে মাথা নত করবেন না শেখ হাসিনা। আল্লাহ ছাড়া কাউকে তিনি ভয় পান না। সূত্র : মানবজমিন