ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অধিকতর নিয়ন্ত্রণ

- প্রকাশের সময় : ০৩:৫৩:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
- / ৮১২ বার পঠিত
ঢাকা: বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে চূড়ান্ত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া। তবে বিতর্কিত সেই ধারার বিধান আরো বিস্তারিতভাবে যুক্ত হয়েছে নতুন আইনে। এতে কার্যত ডিজিটাল মাধ্যমে আরো অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আরোপ হচ্ছে। এই আইন পাস হলে ১১ সদস্যের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন আইনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কেউ কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালালে ১৪ বছরের জেল, এক কোটি টাকার জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এর জন্য ১৪ বছর কারাদন্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে।
নতুন আইনটির বিভিন্ন ধারায় শাস্তির বিধান রেখে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ এর খসড়া সোমবার (২৯ জানুয়ারী) চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদন দেয়া হয়। এদিকে সোমবার পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক জানিয়েছেন এ পর্যন্ত দায়ের হওয়ার মামলাগুলো ৫৭ ধারাতেই চলবে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, ৫৭ ধারা বাতিল হয়েছে এটি বলা যাবে না। এদিকে চূড়ান্ত হওয়া আইনটির খসড়া প্রকাশের পর নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছেন, অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য গোপনে ধারণ করলে প্রকাশ বা প্রচার করলে সেটিও কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে? আর এটি যদি হয় তাহলে তা হবে স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তির বিষয়ে সচিবালয়ে ফিরে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এই আইনের আওতায় কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালান, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নতুন আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদন্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, কেউ যদি বেআইনিভাবে কারও ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে, তাহলে তাকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া হবে। বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আবার কেউ যদি বেআইনিভাবে কারও ডিভাইসে প্রবেশ করে তাহলে এক বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কেউ যদি কারও ডিভাইসে প্রবেশে সহায়তা করে, তাহলে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখায়, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, না জানিয়ে কেউ যদি কোনও ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করে, তাহলে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ৬২ ধারায় বলা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ যুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারার বিলুপ্তি হবে। ৫৭ ধারায় সব ছোট করে লেখা ছিল। সেটা বিস্তারিত ব্রেক-আপ দিয়ে যেটা যে প্রকৃতির অপরাধ সেই আঙ্গিকে শাস্তি, বেশি হলে বেশি কম হলে কম। তদন্ত কীভাবে করা হবে সেটা ডিটেইল (বিস্তারিত) করা হয়েছে, যেটা আগে ছিল না। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় হওয়া মামলাগুলোর কী হবে- জানতে চাইলে শফিউল আলম বলেন, সেই মামলাগুলো চলতেই থাকবে, যেন ধারাটি বাতিল করা হয়নি। এর আগে ২০১৬ সালের বছরের ২২ আগস্ট ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। তবে খসড়াটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইনমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ওই সময় বলেছিলেন, যারা কনসার্ন স্টেক হোল্ডার (সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী) তাদের নিয়ে বৈঠক করে এটাকে (খসড়া আইন) আরেকটু পরিশীলিত করা হবে। এ প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কয়েক দফা সভা করার পর গত বছরের ২৯ নভেম্বর এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। এর পরই খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে পাঠায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। এদিকে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনটির কোনো ধারায় কী শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনে ডিজিটালের সংজ্ঞা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব করা, ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। এদিকে সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত হলেও আইসিটি আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম চলবে বলে জানিয়েছেন বিদায়ী আইজিপি একেএম শহীদুল হক।
গত ২৯ জানুয়ারী সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন যখন তৈরি হয় বা ওই আইন যখন সংশোধন বা রদ হবে, ওই আইনের অতীতের সব কর্মকান্ড কিন্তু অব্যাহত থাকবে। তা কখনও বাতিল হয় না। কিন্তু যেদিন থেকে ওই আইন সংশোধন বা এনফোর্স হবে সেদিন থেকে পুরনো আইন বাতিল হবে। সদরদপ্তরের নির্দেশ ছাড়া মামলা নিতে নিষেধ করেছেন জানিয়ে আইজিপি বলেন, এরপর যেসব মামলা নেওয়া হয়েছে তা যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হয়েছে। সত্যতা আছে তাই কিছু মামলা নেওয়া হয়েছে। নতুন আইনেও ৫৭ ধারার মত কিছু ধারা রয়েছে, সেক্ষেত্রেও একই নির্দেশ পুলিশ সদরদপ্তর থেকে থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন আইন যেটা হবে সেটা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না। যে অপরাধের জন্য ৫৭ ধারা দেওয়া হয়েছিল সেই অপরাধগুলো যদি থাকে তাহলে তো মুশকিল। তবে বিস্তারিত না জেনে কিছু বলা যাবে না।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে হওয়া এ আইনটি ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনে সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদন্ড করা হয়। আর ৫৭ ধারার অপরাধকে করা হয় জামিন অযোগ্য। ওই ধারাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি দাবি করে সেটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীরা। ৫৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। (দৈনিক মানব জমিন)