নিউইয়র্ক ০৭:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

টাঙ্গাইলের চমচম

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৫০:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ নভেম্বর ২০১৬
  • / ১৮৩৯ বার পঠিত

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের চমচম সারা দেশেই বিখ্যাত তার ভূবন ভোলানো স্বাদের জন্য। ব্রিটিশ আমলেও এ চমচমের স্বাদ গোটা উপমহাদেশেই বিখ্যাত ছিল। এখনও তেমনি বিখ্যাত। সমান বিখ্যাত থাকলেও টাঙ্গাইলের চমচম আজ যেনো তার স্বাদ হারাতে বসেছে। কারণ আমরা এখন যে চমচম পাই তা মূলত টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারের। পোড়াবাড়িতে চমচমের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই।এ চমচমগুলো সাধারণত লালচে রঙের যার উপড়িভাগে চিনির গুড়ো থাকে। আর ভেতরের অংশ অনেক রসালো আর নরম। চমচমের গুণগত মান আর স্বাদ মূলত পানি আর দুধের অনুপাতের উপড়ই নির্ভর করে।মিষ্টির রাজা বলে খ্যাত টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়ী নামক স্থানের এই চমচম স্বমহিমায় মহিমান্বিত। স্বাদ আর স্বাতন্ত্র্যে এর জুড়ি মেলে না। বাংলা, বিহার ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষ তথা গোটা পৃথিবী জুড়ে এর সুনাম রয়েছে। লালচে রঙের এই সুস্বাদু চমচমের উপরিভাগে চিনির গুড়ো তাকে-এর ভিতরের অংশ রসাল নরম। এই ঐতিহাসিক চমচমের গুণেই মূলত টাঙ্গাইল একটি জেলা হিসেবে জন্মলাভের পূর্বেই বিশ্ববাজারে পরিচিত লাভ করে।
গবেষকদের মনে দশরথ গৌড় নামের এক ব্যক্তি বৃটিশ আমলে টাঙ্গাইল-এর যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়ীতে আসেন। আসাম থেকে আগত এই দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু পানি ও এখানকার গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি করেন। অতঃপর এখানে ব্যবসা শুরু করেন। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ মাইল পশ্চিমে একদা ঘাট ছিল, এর নাম তালান-ঘাট। সেখানে ভিড়তো সওদাগরী নৌকা, জাহাজ ও লঞ্চ। সে সময় দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারণায় পোড়াবাড়ী ছিল ব্যস্ত এক ব্যবসাকেন্দ্র। তখন চমচমের ব্যবসাও ছিল জমজমাট। চমচমের গুণগত মান আর স্বাদ মূলত পানি ও দুধের উপরই নির্ভরশীল। এখানে এই দুটি মৌল শর্ত পূরণ হয় বলে এর মিষ্টি স্বাদে, গন্ধে, তৃপ্তিতে অতুলনীয়। পোড়াবাড়ীর চমচম একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি। এর মধ্যে কোনো ভেজাল মেশানো হয় না। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা পোড়াবাড়ী কারিগর নিয়ে পোড়াবাড়ীতে প্রস্তুত প্রণালী ব্যবহার করে চমচম বানিয়েছে, কিন্তু এই মানের চমচম তৈরী করতে পারেনি। এজন্যেই পোড়াবাড়ীর চমচমের বিকল্প হয় না। একসময় যমুনা আর ধলেশ্বরী স্রোতস্বিনী ছিল। তখন লঞ্চ-স্টিমার যোগে পোড়াবাড়ীর চমচম ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যেতো। প্রতি সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ মন চমচম তৈরি হতো পোড়াবাড়ীতে। উত্তরোত্তর সাফল্য ও চাহিদার কারণে তখন পোড়াবাড়ীতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি চমচম তৈরির কারখানা গড়ে উঠে, যার সাথে তিন শতাধিক পরিবারের জীবনধারা আবর্তিত হয়।
tangail-chomchom-2টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারের পুরাতন মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই পোড়াবাড়ীতে প্রথম চমচম তৈরি শুরু হয়। এর স্রষ্টা দশরথ গৌড়। তাদের সাথে মিষ্টি তৈরিতে যারা সার্বিক সাহায্য করেছে তারা হলো- রাজারাম গৌড়, মদন গৌড়, শিব শংকর, নারায়ণ বাবু প্রমুখ।
কালের আবর্তে যমুনার শাখানদী ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এতে বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ীর নৌপথের ব্যবসা-বাণিজ্য। ক্রমে ক্রমে জনবহুল পোড়াবাড়ী হতে থাকে জনশূন্য। যে ঐতিহ্যবাহী চমচম শিল্পকে কেন্দ্র করে এতো লোক জীবিকা নির্বাহ করতো, তারা বেকার হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে যায়। পোড়াবাড়ী বাজারের অবস্থা খুবই করুণ। এই বাজারে ৫টি ভাঙ্গাচোরা চমচমের দোকান রয়েছে, যা কেবল ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে চলেছে। বাজারের আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে এখনও মিষ্টি তৈরি হয় এবং তারা রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন শহরে তা সরবরাহ করে থাকে। জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার ও টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ী মিষ্টিঘরে নির্ভেজাল পোড়াবাড়ীর চমচম পাওয়া যায়। এর প্রতি কেজির মূল্য ১৮০ থেকে ২২০ টাকা।
ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ীর চমচম আজ নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন। তাই মিষ্টি নির্মাতা ও ব্যবসায়ীরা আর্থিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। প্রতিকূলতার মধ্যে যারা টিকে রয়েছে এভাবে তারা আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে- তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ কারণে পোড়াবাড়ী বাজারে সংস্কারণ, কারিগরদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, চাঁদাবাজ ও ভেজাল চমচম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। না হলে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ীর চমচম বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
যমুনার শাখানদী ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠা চরের দুর্বাঘাষ খাওয়া গরুর দুধ আর নেই–সেই স্রোতস্বিনী জলও নেই-নেই তেঁতুলের লাকড়ীর জালানী——তবুও ওরা চেষ্টা করছে—–!

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

টাঙ্গাইলের চমচম

প্রকাশের সময় : ০৯:৫০:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ নভেম্বর ২০১৬

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের চমচম সারা দেশেই বিখ্যাত তার ভূবন ভোলানো স্বাদের জন্য। ব্রিটিশ আমলেও এ চমচমের স্বাদ গোটা উপমহাদেশেই বিখ্যাত ছিল। এখনও তেমনি বিখ্যাত। সমান বিখ্যাত থাকলেও টাঙ্গাইলের চমচম আজ যেনো তার স্বাদ হারাতে বসেছে। কারণ আমরা এখন যে চমচম পাই তা মূলত টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারের। পোড়াবাড়িতে চমচমের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই।এ চমচমগুলো সাধারণত লালচে রঙের যার উপড়িভাগে চিনির গুড়ো থাকে। আর ভেতরের অংশ অনেক রসালো আর নরম। চমচমের গুণগত মান আর স্বাদ মূলত পানি আর দুধের অনুপাতের উপড়ই নির্ভর করে।মিষ্টির রাজা বলে খ্যাত টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়ী নামক স্থানের এই চমচম স্বমহিমায় মহিমান্বিত। স্বাদ আর স্বাতন্ত্র্যে এর জুড়ি মেলে না। বাংলা, বিহার ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষ তথা গোটা পৃথিবী জুড়ে এর সুনাম রয়েছে। লালচে রঙের এই সুস্বাদু চমচমের উপরিভাগে চিনির গুড়ো তাকে-এর ভিতরের অংশ রসাল নরম। এই ঐতিহাসিক চমচমের গুণেই মূলত টাঙ্গাইল একটি জেলা হিসেবে জন্মলাভের পূর্বেই বিশ্ববাজারে পরিচিত লাভ করে।
গবেষকদের মনে দশরথ গৌড় নামের এক ব্যক্তি বৃটিশ আমলে টাঙ্গাইল-এর যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়ীতে আসেন। আসাম থেকে আগত এই দশরথ গৌড় যমুনার সুস্বাদু পানি ও এখানকার গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি করেন। অতঃপর এখানে ব্যবসা শুরু করেন। টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ মাইল পশ্চিমে একদা ঘাট ছিল, এর নাম তালান-ঘাট। সেখানে ভিড়তো সওদাগরী নৌকা, জাহাজ ও লঞ্চ। সে সময় দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারণায় পোড়াবাড়ী ছিল ব্যস্ত এক ব্যবসাকেন্দ্র। তখন চমচমের ব্যবসাও ছিল জমজমাট। চমচমের গুণগত মান আর স্বাদ মূলত পানি ও দুধের উপরই নির্ভরশীল। এখানে এই দুটি মৌল শর্ত পূরণ হয় বলে এর মিষ্টি স্বাদে, গন্ধে, তৃপ্তিতে অতুলনীয়। পোড়াবাড়ীর চমচম একটু ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি। এর মধ্যে কোনো ভেজাল মেশানো হয় না। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা পোড়াবাড়ী কারিগর নিয়ে পোড়াবাড়ীতে প্রস্তুত প্রণালী ব্যবহার করে চমচম বানিয়েছে, কিন্তু এই মানের চমচম তৈরী করতে পারেনি। এজন্যেই পোড়াবাড়ীর চমচমের বিকল্প হয় না। একসময় যমুনা আর ধলেশ্বরী স্রোতস্বিনী ছিল। তখন লঞ্চ-স্টিমার যোগে পোড়াবাড়ীর চমচম ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যেতো। প্রতি সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ মন চমচম তৈরি হতো পোড়াবাড়ীতে। উত্তরোত্তর সাফল্য ও চাহিদার কারণে তখন পোড়াবাড়ীতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি চমচম তৈরির কারখানা গড়ে উঠে, যার সাথে তিন শতাধিক পরিবারের জীবনধারা আবর্তিত হয়।
tangail-chomchom-2টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারের পুরাতন মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই পোড়াবাড়ীতে প্রথম চমচম তৈরি শুরু হয়। এর স্রষ্টা দশরথ গৌড়। তাদের সাথে মিষ্টি তৈরিতে যারা সার্বিক সাহায্য করেছে তারা হলো- রাজারাম গৌড়, মদন গৌড়, শিব শংকর, নারায়ণ বাবু প্রমুখ।
কালের আবর্তে যমুনার শাখানদী ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। এতে বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ীর নৌপথের ব্যবসা-বাণিজ্য। ক্রমে ক্রমে জনবহুল পোড়াবাড়ী হতে থাকে জনশূন্য। যে ঐতিহ্যবাহী চমচম শিল্পকে কেন্দ্র করে এতো লোক জীবিকা নির্বাহ করতো, তারা বেকার হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে যায়। পোড়াবাড়ী বাজারের অবস্থা খুবই করুণ। এই বাজারে ৫টি ভাঙ্গাচোরা চমচমের দোকান রয়েছে, যা কেবল ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে চলেছে। বাজারের আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে এখনও মিষ্টি তৈরি হয় এবং তারা রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন শহরে তা সরবরাহ করে থাকে। জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার ও টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ী মিষ্টিঘরে নির্ভেজাল পোড়াবাড়ীর চমচম পাওয়া যায়। এর প্রতি কেজির মূল্য ১৮০ থেকে ২২০ টাকা।
ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ীর চমচম আজ নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন। তাই মিষ্টি নির্মাতা ও ব্যবসায়ীরা আর্থিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। প্রতিকূলতার মধ্যে যারা টিকে রয়েছে এভাবে তারা আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে- তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ কারণে পোড়াবাড়ী বাজারে সংস্কারণ, কারিগরদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, চাঁদাবাজ ও ভেজাল চমচম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। না হলে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ীর চমচম বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
যমুনার শাখানদী ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠা চরের দুর্বাঘাষ খাওয়া গরুর দুধ আর নেই–সেই স্রোতস্বিনী জলও নেই-নেই তেঁতুলের লাকড়ীর জালানী——তবুও ওরা চেষ্টা করছে—–!