জামাল উদ্দীন: ব্যাংকিং খাতে ঋণ জালিয়াতি ঘটেছে, এমন শাখাগুলোতেই পুঞ্জীভূত হচ্ছে সরকারি ব্যাংকের ঋণ। হাতে গোনা পাঁচ-ছয়টি শাখা থেকেই বিতরণ করা হচ্ছে সিংহভাগ ঋণ। এসব শাখায় অনিয়মের ঘটনার পরও যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেওয়া হচ্ছে গোষ্ঠীবিশেষকে- এমন অভিযোগও রয়েছে। শাখাগুলোতে তদারকি জোরদার করার বদলে পুরোনো স্টাইলেই চালাচ্ছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আবার কোনো কোনো শীর্ষ নির্বাহী এমন দাপুটে যে, ধরাকে সরা জ্ঞান করেন।
ব্যাংকিং সূত্র জানায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে গত কয়েক বছর ধরে অজ্ঞাত কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় পরিদর্শন বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত চিত্র এখনো অস্পষ্ট। তদুপরি, সরকারি ব্যাংকগুলোতে নানা প্রভাববলয় থাকায় খুব বেশি ভালো করছে না এসব ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে বিভিন্ন সময়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। বেসিক, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রæপ, এ্যানটেক্সসহ নানা ঘটনা এখনো ব্যাংকিং খাতে আলোচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে জালিয়াতি হয়েছে এমন শাখাগুলো থেকে পরবর্তী সময়েও বেশি হারে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন মাস শেষে রূপালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৩৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। এরমধ্যে মাত্র পাঁচটি শাখার মাধ্যমেই বিতরণ করা হয়েছে ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬১ শতাংশই নির্দিষ্ট পাঁচটি শাখার মাধ্যমে হয়েছে। যেখানে রূপালী ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ৫৮৫টি। একইভাবে অগ্রণী ব্যাংকের ৫৪ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ২৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখার মাধ্যমে। অগ্রণী ব্যাংকের মোট শাখা ৯৬০টি। জনতা ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ৯১২টি। জুন ২১ পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এই ঋণের ৭২ শতাংশ বা ৪৫ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে পাঁচটি শাখার মাধ্যমে। এসব শাখায় আলোচিত ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল। সোনালী ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ১ হাজার ২২৮টি। আলোচ্য সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। পাঁচটি শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার মতো।
সূত্রগুলো বলেছে, শহরকেন্দ্রিক ব্যাংকগুলো ঋণদানের ফোকাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে, গ্রামাঞ্চল কিংবা এসএমই খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ হচ্ছে না। কিংবা অর্থনীতিতে এর সঠিক প্রতিফলন ঘটছে না। তদুপরি, নির্দিষ্ট শাখায় পুঞ্জীভূত হওয়ার ঘটনা শুভলক্ষণ নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, নির্দিষ্ট শাখায় বেশি অঙ্কের ঋণ দেওয়া মানে অপরাপর শাখার গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছে। এতে করে প্রকৃত উদ্যোক্তা কিংবা নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রয়াসও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিগত সময়ের কেলেঙ্কারির ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। এই পুঞ্জীভূতকরণের ফলে ভবিষ্যতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গ্রাহকরা আটকে গেলে কিংবা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হলে ব্যাংক দুর্ভোগে পড়বে।
এদিকে, ঋণ বিতরণে প্রভাবশালী গ্রাহকদের প্রাধান্য দেওয়ায় ফোর্সড লোনের পরিমাণও বেড়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোনের পরিমাণ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ। ঋণপত্র খোলার সময় প্রদেয় গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সঠিক যাচাই-বাছাই হচ্ছে না। এই ফোর্সড লোন এক সময় ব্যাংকগুলোর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা, টাকা পরিশোধে গ্রাহকের অনীহার কারণেই ফোর্সড লোন হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েই গ্রাহকের হিসাবে ফোর্সড লোন করে বিদেশি ব্যাংককে টাকা পরিশোধ করছে। (দৈনিক ইত্তেফাক)