বাংলাদেশ ডেস্ক : টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চরম ক্রান্তিকাল পার করছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত হওয়া দলটি নানা চেষ্টা করেও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বরং দিন দিন সেই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে সব সংকট, নানা চাপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
বর্তমানে দলটির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দলটির গুরুতর অসুস্থ চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায় এবং দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষে জাতীয় কাউন্সিল করা ও সারাদেশে দলের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে দায়ের করা লক্ষাধিক মামলা মোকাবেলা করা। দীর্ঘ রাজনৈতিক স্থবিরতা আর ‘ধীরে চলা নীতি’ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বছরে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমেই এসব দাবি আদায় করতে চায় বিএনপি। এ জন্য বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের দেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। ঢাকার রাজপথ থেকে তৃণমূল-পর্যায়ে এসব কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে উজ্জীবিত বিএনপি নেতারা।
দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশ পাঠানোর দাবিতে চলমান কর্মসূচিকে ঘিরে দলের নেতাকর্মীরা এখন উজ্জীবিত। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সৃষ্টি হয়েছে চাঙ্গাভাব। দীর্ঘ দিন ধরে হতাশায় থাকা অনেক নেতাকর্মীই গা-ঝাড়া দিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তারা খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ। এমনকি পদবঞ্চিতরাও যোগ দিচ্ছেন এসব কর্মসূচিতে। তারা আরও কঠোর কর্মসূচির দাবি জানাচ্ছেন। যদিও চলমান জেলা সমাবেশ শেষে তৃণমূলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের।
দলটির একাধিক নেতাকর্মী জানান, নতুন বছরে দলের অগ্রাধিকার আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে পাঠিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। এ ছাড়াও সারাদেশে দলের ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর নামে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো মামলা রয়েছে। বেশির ভাগ নেতার নামেই ১০০-এর ওপরে মামলা আছে। এমন বাস্তবতায় জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে মামলা মোকাবেলায় নানামুখী কৌশল খুঁজছে বিএনপি। ক্ষমতাসীন সরকারের দায়ের করা লক্ষাধিক মামলার যে খড়গ ঝুলছে- তা মোকাবেলায় ভুক্তভোগী নেতা-কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য গঠিত সেলগুলো শিগগিরই সচল করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র আইনজীবীরা এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অন্যদিকে দেশব্যাপী দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ইতিমধ্যে মাত্র ৩০টিতে নতুন কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫১টি মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলায় কমিটি গঠন করতে হবে। এ ছাড়া আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি আদায়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে চায় দলটি। এর মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে চায় বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার স্বার্থে বিদেশে পাঠানো এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করাটাই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে। সে আন্দোলনে জনগণ জেগে উঠেছে। আমরা আশাবাদী, আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশনেত্রীর মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসাসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ সরকারের সময় প্রায় শেষ। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় থাকলে যা হয় আরকি। এবার জনগণ জেগে উঠেছে। ভোট নিয়ে আর প্রতারণার সুযোগ তাদের দেওয়া হবে না। গণআন্দোলনের মাধ্যমেই মানুষের ভোটাধিকারসহ সব অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বিদেশে চিকিৎসাসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করা হবে। এই নতুন বছরে এই সরকারকে বিদায় করেই নেত্রীকে মুক্ত করব ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে, কর্মসূচিতে আমরা জনমত আদায়ে চেষ্টা করছি। অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছি। ফলে এখন শুধু বিএনপি নয় দেশের অর্ধেকের বেশি জনগণ চায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হোক। আমরা আন্দোলনে আছি এবং দাবি আদায়ে রাজপথই ফয়সালা করবে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও ধরন।’
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি আর এ রকম কর্মসূচি করতে পারেনি। তবে গত বছরের শেষভাগে এসে ঢাকায় এবং জেলায় জেলায় সিরিজ সমাবেশগুলোতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে এতসংখ্যক নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ বিগত কয়েক বছরেও দেখা যায়নি। ২২ ডিসেম্বর থেকে ৩২টি স্থানে সমাবেশ করার কর্মসূচি শুরু হয়। এর মধ্যে ২০টি জেলায় কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় শুধু নওগাঁয় সমাবেশ করতে পারেনি দলটি। সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, ফেনী, ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী ক্ষমতাসীন দল ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও, শেষ পর্যন্ত সমাবেশ করেছে নেতা-কর্মীরা।
হবিগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারির কারণে সমাবেশ হয়নি। যশোর, ফেনী, কক্সবাজারে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সমাবেশ করা হয়েছে। এর বাইরে গাজীপুর, সিলেট ও টাঙ্গাইলে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বাকি জেলাগুলোতে শিগগির সমাবেশ শেষে পরবর্তীতে আবার উপজেলা, পৌরসভা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচির প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির পর মহানগরী পর্যায়ে সমাবেশ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবস্থান, অনশন ও মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন রকমের টানা কর্মসূচির কথা ভাবছে দলটি।খবর সাম্প্রতিক দেশকাল
হককথা/এমউএ