চলে গেলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক

- প্রকাশের সময় : ০৯:১২:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬
- / ৯০৯ বার পঠিত
ঢাকা: শেষ পর্যন্ত লড়াই করলেন। কিন্তু ক্যান্সার ও মৃত্যুর সঙ্গে পেরে উঠলেন না। আশ্রয় নিলেন মৃত্যুর কোলে। দেশ ও প্রবাসের অসংখ্য অনুরাগী পাঠককে বিষাদে ডুবিয়ে মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) শেষ বিকেলে চলে গেলেন সব্যসাচী লেখক বাংলা সাহিত্যের রাজা সৈয়দ শামসুল হক (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দিয়ে তিনি অমর হয়ে গেলেন। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ফুসফুসে এ রোগ বাসা বেঁধেছিল আরও আগে। উন্নত চিকিৎসার জন্য লেখক গিয়েছিলেন লন্ডনের হাসপাতালে। সেখানে রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষার পর শনাক্ত হয় মরণঘাতী এ রোগ। মাস চারেক চিকিৎসা চলে সেখানেই। লন্ডনের চিকিৎসকরাই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তেমন কিছুই করার নেই। দুই সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। এরপর থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখান থেকেই শুরু হল তার অন্তিম যাত্রা।
লন্ডনের চিকিৎসকরাই আশা জাগিয়েছিলেন লেখক আরও ছয় মাস বাঁচতে পারেন। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হল না। ফেরার পর মাস পুরো হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে সদর্প বিচরণকারী সৈয়দ হকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর (জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫, মৃত্যু ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। এই দীর্ঘ সময়ে দু’হাত ভরে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গান লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। ‘আয়না বিবির পালা’সহ ৫০টির বেশি উপন্যাস এসেছে তার হাত দিয়ে। যার মধ্যে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’ ও ‘মৃগয়ার কালক্ষেপ’ অন্যতম। যাওয়ার সময় তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তার স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হকও মনোরোগ চিকিৎসার পাশাপাশি লেখালেখিতে সক্রিয়।
এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই লেখকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, গানসহ সাহিত্য কর্মগুলো বাঙালি জাতির জন্য ভবিষ্যৎ পাথেয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যু দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার কাছে বাঙালি বাংলাদেশ ও ‘জাতির জনক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অভিন্ন সত্তা। তিনি তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে আমৃত্যু মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ শামসুল হকের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার এবং অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শোক জানিয়েছেন সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখররুল ইসলাম আলমগীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, আমারা মুক্তিযুদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ূন কবির।
সৈয়দ হকের মৃত্যুর খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সৈয়দ শামসুল হক শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না তিনি এদেশের সব স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিকও ছিলেন।
অপরদিকে মঙ্গলবার সৈয়দ হকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বুধবার বিকালে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠেয় আনন্দ আয়োজনটি স্থগিত করে শেখ হাসিনার ৭০তম জন্মদিন উদযাপন কমিটি। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর ইউনাইটেড হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন তিনি। গত ১০ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে তাকে দেখতে এসে চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার নেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসপাতালে সোমবার দুপুরে সৈয়দ হকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। মঙ্গলবার ভোর থেকে কৃত্রিম উপায়ে তাকে শ্বাস-প্রশ্বাস দেয়া হচ্ছিল। দুপুরে তাকে দেখতে এসে কবি মুহাম্মদ সামাদ সাংবাদিকদের বলেন, সংকটাপন্ন হলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তাকে বিদেশে নেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া যাচ্ছে না। তার কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিয়ে জানিয়ে দেন, সৈয়দ শামসুল হক আর নেই।
ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে মরদেহ গুলশানের বাসায় নেয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে তার মরদেহ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল ১০টায় নেয়া হয় চ্যানেল আই কার্যালয়ে। সেখান থেকে নেয়া হয় বাংলা একাডেমিতে। ১১টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়ে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। দুপুরে জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার পর কুড়িগ্রামে নিয়ে তার নামে বরাদ্দ করা জমিতে সমাহিত করা হয় এই লেখককে।
বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করা সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন আর মা গৃহিণী হালিমা খাতুন। ১৯৫৩ সালে ‘একদা এক রাজ্যে’ কাব্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হলেও ‘তাস’ নামের গ্রন্থটি আরও আগেই প্রকাশিত হয়। দু’হাত ভরে লিখেছেন তিনি। তার রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা।
ষাট, সত্তর ও আশির দশকে অনেক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’র মতো বহু গান মানুষের মুখে মুখে। তার নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস নিয়ে কয়েক বছর আগে গেরিলা নামে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। গায়ক এন্ড্রু কিশোরের জন্য কবি চারটি গান লিখে গেছেন। শেষ বিদায়ের আগে হাসপাতালে শুয়ে-বসেই তিনি লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পথে হিথ্রো বিমানবন্দরে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে বলেছিলেন, তিনি নতুন নাটক লিখছেন… নাম ‘শেষ যোদ্ধা’। লেখাটি শেষ হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন সব্যসাচী এই লেখক। (সূত্র: যুগান্তর)