চট্টগ্রামে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন আজ
- প্রকাশের সময় : ০৫:১০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৩
- / ৪০ বার পঠিত
বাংলাদেশ ডেস্ক : অপেক্ষার পালা শেষে এলো স্বপ্নপূরণের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল শনিবার সকালে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে টানেলযুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রচিত হতে চলেছে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। যেখানে কেবলই লেখা থাকবে উন্নয়নের গৌরবগাথা।
১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের পতেঙ্গাপ্রান্তে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সকাল ১০টায় কোরিয়ান ইপিজেড আনোয়ারাপ্রান্তে টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এক জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সভাপতিত্ব করবেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এদিন টানেল ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী ১৯টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। উদ্বোধনের পরদিন যান চলাচলের জন্য টানেলটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম জেলাজুড়ে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এ অঞ্চলে নতুন মাত্রার উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা করে স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা পথে আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সর্বস্তরের দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, পরামর্শক, বিশেষজ্ঞ প্যানেল, সেতু বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিরাপত্তা তদারকিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং নির্মাণ শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাদের অবদান ও অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য অভিবাদন জানান তিনি।
টানেলে থ্রি হুইলার ও মোটরসাইকেল চলবে না। হেঁটেও পার হওয়া যাবে না। টানেলের ভেতরে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলবে। টানেলটি পার হতে সময় লাগবে মাত্র তিন মিনিট। টানেল পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে আসবে। সময়ও লাগবে এক ঘণ্টা কম।
তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে টানেলটি শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল। যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে খুলে দেবে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চট্টগ্রাম নগরী ও সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল এবং কক্সবাজারকে এক করবে এই টানেল। বাস্তবায়ন হবে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ কনসেপ্ট। টানেলের একপ্রান্তে রয়েছে চট্টগ্রাম নগরী, অন্যপ্রান্তে আনোয়ারা এলাকায় গড়ে উঠবে নতুন শহর। যাতায়াত সহজতর হওয়ায় কমবে সময় ও পরিবহণ ব্যয়। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে শিল্পায়ন হবে দ্রুতগতিতে। সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের জন্য চট্টগ্রামবাসী বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। চট্টগ্রামের চেহারা বদলে দেবে এই টানেল। এটি যুগান্তকারী একটি কানেকটিভিটি। চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ গড়ে উঠবে টানেলের সুবাদে। চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান হবে অনেক উন্নত। টানেল শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। কর্ণফুলীর অপর পাড়ে শিল্পায়ন শুরু হয়ে গেছে। আরও নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কক্সবাজার পর্যন্ত শত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শিল্পায়নের দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। উপকৃত হবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। শুধু একটি টানেলের কারণে দেশের জিডিপিতে এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটবে। তিনি আরও বলেন, টানেলের পুরো সুফল পেতে হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে হবে। যেটি টানেল হয়ে মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ কাজের দায়িত্বে ছিল চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল-টিউব নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
দুই টিউব, চার লেন : তথ্য মতে, টানেলে রয়েছে দুটি টিউব। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিমপ্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারাপ্রান্তে।
নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে স্থলপথে বের হয়েছে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে সুদে পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
টোল হার : টানেল দিয়ে চলাচলকারী গাড়ির টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। টোলের হার- কার, জিপ, পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ সিট পর্যন্ত) ৩০০ টাকা, ৩১ সিটের বেশি ৪০০ টাকা, বাস থ্রি এক্সেল ৫০০ টাকা, ট্রাক ৫ টন পর্যন্ত ৪০০ টাকা, ট্রাক ৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত ৫০০ টাকা, ৮ টন থেকে ১১ টন পর্যন্ত ৬০০ টাকা, ট্রাক থ্রি এক্সেল ৮০০ টাকা, টেইলার ফোর এক্সেল এক হাজার টাকা, ফোর এক্সেল থেকে বেশি এক হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি স্কেল ২০০ টাকা হারে যোগ হবে।
নবরূপে সেজেছে চট্টগ্রাম : টানেল উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে চট্টগ্রাম সেজেছে নবরূপে। নগরীর বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড, ফৌজদারহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আউটার রিং রোড এবং টানেলের অপরপ্রান্ত আনোয়ারা থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত এলাকা ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। সড়ক সংস্কার করা হয়েছে। সড়কের পাশে গাছগুলোও সাদা রঙে সেজেছে। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান জানান, ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৮ ফুট প্রস্থের জনসভার মঞ্চটি নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে। টানেল উদ্বোধন ও জনসভা ঘিরে নিñিদ্র নিরাপত্তায় দুই হাজার ৫০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
আনোয়ারায় আনন্দ র্যালি : আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারা-কর্ণফুলীর অন্যতম সামাজিক সংগঠন স্বাধীন চেতনার প্রজন্ম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঢাকঢোল পিটিয়ে টানেল পাড়ায় আনন্দ র্যালি বের হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় উপজেলার কালাবিবির দিঘির মোড় থেকে টানেল সংযোগ সড়কের মুখ পর্যন্ত এই র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় হলুদ রঙের গেঞ্জি পরে ব্যানার, ফেস্টুন, বেলুন নিয়ে বাদ্যযন্ত্রসহ উৎসবে মেতে ওঠেন তারা।
টানেল অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে- হানিফ : শুক্রবার দুপুরে আনোয়ারার কেইপিজেড মাঠে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ টানেলের যুগে প্রবেশ করছে। এটি দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কেউ যদি সহিংসতা ও নাশকতার চেষ্টা করে তাহলে কঠোরহস্তে দমন করা হবে। সূত্র : যুগান্তর