চট্টগ্রামে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত ও গুলীতে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী নিহত

- প্রকাশের সময় : ০৪:৩৯:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ জুন ২০১৬
- / ৮৫১ বার পঠিত
চট্টগ্রাম: একাধিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ,সাহসী ও মেধাবী পুলিশ অফিসার সদ্য পুলিশ সুপার পদে প্রমোশন পাওয়া ঢাকা হেড কোয়ার্টারে কর্মরত (চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুকে (৩২) গুলী করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ৫ জুন রোববার সকাল ৭টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ থানার জিইসি মোড়ে এমএম পিস্তল থেকে নিখুঁত নিশানায় গুলী করে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। নিহত মাহমুদা খাতুন মিতু এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী। বাবুল আক্তারের পদোন্নতির পর ঢাকায় অবস্থান করলেও তার স্ত্রী ছেলে- মেয়েকে নিয়ে নগরীর জিইসি এলাকার ‘ইক্যুইটি সেন্ট্রিয়াম’ নামের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। বাবুল আক্তারের অবুঝ শিশুকন্যা তাবাসসুম তাজনীম এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর কোলে চুপটি মেরে নিশ্চুপ বসে বিড় বিড় করে বলতে থাকে, বাবা থাকলে আজ ওরা মাকে মারতে পারত না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার সকালে ছেলে মাহির আক্তারকে স্কুলের বাসে তুলে দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ের ওয়েল ফুডের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মাহমুদা খাতুন মিতু। এসময় মোটরসাইকেলে আসা তিন ঘাতক তার গায়ে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। এরপর দুর্বৃত্তরা প্রথমে তাকে ছুরিকাঘাত করে এবং পরে তাকে লক্ষ্য করে গুলী চালায়। মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত করে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেল যোগে গোলপাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় সৌভাগ্যবশত মাহির আক্তার দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা য়ায়, মেডিকেল সেন্টার হাসপাতাল সংলগ্ন ওআর নিজাম রোড আবাসিক এলাকার ১ নম্বর বিল্ডিং ‘ইক্যুইটি সেন্ট্রিয়াম’ নামের যে অ্যাপার্টমেন্টে বাবুল আক্তারের পরিবার থাকতেন, সেখান থেকে ২০০ গজ দূরেই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়েছে। ওই ভবনের ‘সেভেন ডি’ অ্যাপার্টমেন্টে বাবুল আক্তারের স্ত্রী, ছেলে মাহির আক্তার ও মেয়ে তাবাসসুম থাকতেন। ছেলে নগরীর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে স্কুলে পৌঁছে দিতেই বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি।
সেখানকার বাসিন্দা ডা. কাজী ইদ্রিস বলেন, সকালে আমি বাসা থেকে নামছিলাম। দেখি মাহির আক্তার অ্যাপার্টমেন্টের নিচে হাঁপাচ্ছে আর কান্না করছে। মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলাম কী হয়েছে। সে বললো, আমার মাকে মেরে ফেলতেছে। তারপর পড়িমড়ি করে দৌড়ে গেলাম। ততক্ষণে সব শেষ। রক্তাক্ত নিথর দেহটি পড়ে আছে।
যেভাবে হত্যাকান্ডটি ঘটে: মাহির আক্তার বীভৎস হত্যাকান্ডের দৃশ্য দেখার পর থেকেই স্বাভাবিক কথাবার্তা আর বলছে না। সারাক্ষণ কাঁদছে আর চোখমুখে হাত দিয়ে ঢেকে রাখছে। তার সঙ্গে কৌশলে হত্যাকান্ডের বর্ণনাটি জানার চেষ্টা করেছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার মোক্তার আহমদ। তিনি বলেন, মাহির আক্তার বলেছে, মায়ের হাত ধরে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েছিল স্কুলে যাওয়ার জন্যে। এ সময় জিইসি মোড় থেকে গোলপাহাড়মুখী একটি মোটরসাইকেল প্রথমে মাকে ধাক্কা মারে। তখন মা মাটিতে পড়ে যান। এরপর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। সব শেষে গুলী করে। ওই মোটর সাইকেলে তিনজন আরোহী ছিল। এ সময় বাচ্চাটি দৌড়ে আবার বাসার সামনে চলে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী জিইসি মোড়ের নিরিবিলি হোটেলে কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম (৪২) জানান, সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে আসছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ে আমাদের হোটেলের নিচে অচেনা এক যুবক মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। জিনসের প্যান্ট পরা ছিল। একটু পর সে রাস্তা পার হলো। তখনি দ্রুতগতির একটি মোটরসাইকেল এলো। এ সময় ছেলের হাত ধরে হাঁটতে থাকা এক মাকে ধাক্কা দিল মোটরসাইকেলটি। তিনি বলেন, ওই মোটরসাইকেলে ছিল দুই যুবক। তারা নেমে ওই মাকে মারতে শুরু করলেন। ততক্ষণে ছোট্ট ছেলেটি দৌড়ে চলে গেল। একপর্যায়ে ওই মা উঠে দাঁড়ালেন। তখনি গুলীর শব্দ শুনলাম। তারপর তিনজন মোটরসাইকেলে উঠে পড়লো। কিন্তু ২-৩ মিনিট মোটরসাইকেলটি স্টার্ট হলো না। তারপর স্টার্ট নিলো। গোলপাহাড়ের দিকে পালিয়ে গেলেন তিনজন। তারপর আমরা ছুটে গেলাম। ততক্ষণে সব শেষ।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পরিদর্শক কবির হোসেন জানান, দুর্বৃত্তদের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রীর শরীরে আটটি ছুরিকাঘাত করেছিল দুর্বৃত্তরা। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে খুব কাছ থেকে করা হয়েছে গুলী। তিনি বলেন, মোট ১০টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আটটি ছুরিকাঘাত। একটি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় জখম। বাকিটি বুলেট বিদ্ধ হওয়ার। খুনিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে জানিয়ে কবির হোসেন বলেন, পেছন দিক থেকে চারটি এবং সামনের দিক থেকে চারটি ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। পেছনের দিক থেকে মেরুদন্ডের দুপাশে ‘এল শেফ’ বা ‘এল’ আকৃতির ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। বাম হাতের উপরেও ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সব শেষে খুব কাছ থেকে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ এমএম পিস্তল দিয়ে গুলী করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ইতিমধ্যে তিনটি অব্যবহৃত এবং একটি ব্যবহৃত কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে।
ইকুইটি সেন্ট্রিয়াম ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আবদুস ছাত্তার জানান, গত একবছর ধরে এই ভবনে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাবুল আকতারের সাহচর্য পেয়েছেন তিনি। সেই সূত্র ধরে বাবুল আকতারের পরিবারকে বেশ ভালোভাবেই চিনতেন তিনি। বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুকে সম্বোধন করতেন পুলিশ ভাবি বলে। তিনি বলেন, আমাদের ভবনে ঢুকার সড়কের মোড়ে মাহিরকে কাঁদতে দেখে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে বললাম বাবা কি হয়েছে। সে তখন উত্তর দিল মাকে মেরে ফেলেছে তিনজন মানুষ। তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম পুলিশ ভাবি (মিতু) পড়ে আছেন। এসময় আমি তার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলাম তার নিঃশ্বাস বন্ধ। পরে দ্রুত মাহিরকে তার অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে আসি, এবং একটা চাদর নিয়ে আবার ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ ভাবির শরীর ঢেকে দিই। এরপর সবাইকে খবর দিই। পুলিশ ভাবি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সকালে ছেলেকে নিয়ে বের হওয়ার সময়ও ভালো আছি কিনা জানতে চাইলেন। সবসময় খবর নিতেন আমাদের। তিনি বলেন, কারা মেরেছে আমি দেখিনি। তবে মাহিরের কাছ থেকে শুনেছি তিনজন মানুষ মোটরসাইকেলে করে এসে প্রথম পুলিশ ভাবিকে ধাক্কা মারে। পরে পেটে ছুরিকাঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দেন এবং মাথায় তিনটা গুলী করেন।
স্ত্রী খুনের সময় বাবুল আক্তার ছিলেন ঢাকার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। এরপর সেখান থেকে হেলিকপ্টারযোগে তাকে পাঠানো হয় দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে। সেখান থেকে গাড়িতে সিএমসির জরুরী বিভাগে আসেন পৌনে ১১টা। কিন্তু আসার পরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন অসম সাহসী মানুষটি। মানসিকভাবে তাকে দেখাচ্ছিল বিপর্যস্ত। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে স্ত্রীর লাশের পাশে না নিয়ে আরএমও’র কক্ষে বসতে দেওয়া হয়। কিছুটা ধীরস্থির বা স্বাভাবিক হলেই লাশের পাশে যাওয়ার অনুমতি দেন চিকিৎসকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এখন তিনি খুবই বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় স্ত্রীর লাশ দেখলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বেন এমন আশঙ্কাতেই চিকিৎসকরা সময় নেন। এসময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসকের কক্ষে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন বাবুল আক্তার। সেখানে থাকা নগরের পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউদ্দিন মাহমুদকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারকে কেন দেখে রাখা হয়নি? আমি তো আগেই বলেছিলাম, তারা আমার পিছু ছাড়বে না।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ-উল-হাসান হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, বাবুল আক্তার জঙ্গি দমনে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন। তিনি কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এ কারণে জঙ্গিরা তাঁকে টার্গেট করতে পারে। কিন্তু তার স্ত্রীকে গুলী করে মারা, এটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার স্ত্রীকে কেউ এভাবে মারতে পারে, তা পুলিশের ধারণা ছিল না।
রোববার সকালে হত্যাকান্ডের পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে সাংবাদিকদের সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, সকালে উনি বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলের বাসে উঠিয়ে দেয়ার জন্য এখানে এসেছিলেন। ঘটনাটা ৬টা ৩৫ থেকে ৪০-এর দিকে হবে। ওই সময়ে একটা মোটরসাইকেলে একজন হেলমেট পরাসহ তিনজন এসেছে। প্রথমে একটু তর্কাতর্কি করে একপর্যায়ে তাকে ছুরি মেরেছে। পরে গুলী করে চলে গেছে। এতে ঘটনাস্থলেই উনার মৃত্যু হয়েছে। সিএমপি কমিশনার বলেন, আমরা এখন বিষয়টা খতিয়ে দেখছি, এই রাস্তায়, অয়েল ফুড থেকে শুরু করে মন্দির পর্যন্ত অনেক সিসি ক্যামেরা (ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা) আছে। সবক’টির ফুটেজ নিয়ে আমরা এদের চেহারা শনাক্ত করতে পারব। ইকবাল বাহার আরও বলেন, বাবুল আক্তার যেহেতু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিয়ে অনেক কাজ করেছে, তাই এতে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, সেটি অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব এবং আশা করি, খুব দ্রুততার সঙ্গেই আমরা এদেরকে গ্রেফতার করতে পারব।
এদিকে খুনিদের ধরতে র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ১০টি দল মাঠে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ। তিনি আশা করেন, আসামিরা ধরা পড়বে।
পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর: ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সদস্যদের মিতুর লাশ হস্তান্তর করা হয়। এরপর মিতুর প্রথম নামাযে জানাযা নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানাযায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহারসহ বিপুলসংখ্যক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অংশ নেন।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ কমিশনার (উত্তর) পরিতোষ ঘোষ জানান, দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে জানাযা শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঝিনাইদহে। সেখানে বাবুল আক্তারের গ্রামের বাড়িতে দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। (দৈনিক সংগ্রাম)