গণভবনে পর্দা উঠল সংলাপের : আসুন সবাই মিলে দেশ গড়ি- প্রধানমন্ত্রী
- প্রকাশের সময় : ০৭:০০:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ নভেম্বর ২০১৮
- / ৪৩৭ বার পঠিত
ফারাজী আজমল হোসেন: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোটের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সংলাপ শুরু হলো। প্রথমদিনে বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে পর্দা উঠলো সংলাপের। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত গণভবনে এই সংলাপ চলবে। শুক্রবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গণভবনে সংলাপে অংশ নেবে বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। এরপর আগামী রোববার (৪ নভেম্বর) রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করবেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। আর এখন পর্যন্ত নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আগামী সোমবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গণভবনে সংলাপ হবে জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোট-ইউএনএন’র সঙ্গে। বৃহস্পতিবারের সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সংলাপের সিডিউল রয়েছে। আর ঐক্যফ্রন্ট নেতাদেরও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এরপরেও তারা যখন আলোচনার প্রয়োজন মনে করবেন সেজন্য তার দরজা সবসময় উন্মুক্ত।
বৃহস্পতিবার গণভবনে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের ২৩ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২০ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। সন্ধ্যা সাতটায় বহুল আলোচিত সংলাপের শুরুতে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের স্বাগত জানিয়ে সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণভবন জনগনের ভবন। এখানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজকে অনুষ্ঠানে যে আপনারা এসেছেন-আমি এটুকু বলতে পারি যে বাংলাদেশের জন্য আজকে আমরা যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করে যাচ্ছি এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছি সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে বলে মনে করি। এছাড়া এই দেশটা আমাদের সকলের, আসুন সবাই মিলে দেশ গড়ি। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি এটার বিচার আপনাদের উপরই ছেড়ে দেব। নয় বছর ১০ মাস হতে চলল আমরা সরকারে, এই সময়ের মধ্যে দেশের কতটুকু উন্নয়ন করতে পেরেছি সেটা নিশ্চয় আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে এটুকু বলতে পারি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো আছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দিন বদলের যে সূচনা আমরা করেছিলাম, দিন বদল হচ্ছে। এটাকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। আমাদের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজকে সেই স্বাধীনতার সুফল যেনো প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছাতে পারি সেটাই একমাত্র লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী এসময় মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো ২ লাখ মা-বোন এবং দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে আত্মত্যাগকারীদের কথা স্মরণ করেন। দেশের স্বার্থে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই দেশটাকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে এই ঐক্য জরুরি। পৌনে ৪ ঘণ্টা সংলাপ শেষে সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা সংলাপে এসেছেন এজন্য ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে যদি কখনো সংলাপের প্রয়োজন হয় আসবেন, সংবিধানের মধ্য থেকে যেকোন বিষয়ে সংলাপের জন্য আমার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত।
এর আগে সন্ধ্যা ৬টা ৫৭ মিনিটে গণভবনের ব্যাংকোয়েট হলে আলোচনা সভায় উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসন গ্রহণ করার পর তিনি উপস্থিত সবার উদ্দেশে সালাম দেন। তার আগে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংলাপে যোগ দিতে গণভবনে পৌঁছান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। বিকালে সাড়ে ৫টার দিকে তারা ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসা থেকে গণভবনের উদ্দেশে রওয়ানা হন।
প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর রুদ্ধদ্বার সংলাপ শুরু হয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত পৌনে নয়টা পর্যন্ত সংলাপের প্রথম পর্ব চলে। এরপর নৈশভোজের বিরতি শেষে রাত সাড়ে নয়টায় আবার দুইপক্ষের সংলাপ শুরু হয়। শেষ হয় পৌনে ১১টায়। প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা সংলাপ চলে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ড. কামাল। এতে তিনি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং দেশের মানুষের ভোটাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। ড. কামালের বক্তব্য শেষে ফ্রন্টের পক্ষে সাত দফা দাবি পড়ে শোনান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাত দফার মধ্যে রয়েছে- সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়োগ, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, খালেদা জিয়াসহ গ্রেপ্তারকৃত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া, নতুন করে আর কাউকে গ্রেপ্তার না করা।
এছাড়া মির্জা ফখরুল গত এক মাসে ‘গায়েবি মামলা’য় গ্রেপ্তারকৃত ও লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামি করার কথা তুলে ধরেন। ওবায়দুল কাদের জানান, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই ধরনের কিছু ঘটে থাকলে আমার (ওবায়দুল কাদেরের কাছে) কাছে তালিকা দেয়ার জন্য, এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মামলা নিয়ে আলোচনার সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, হাতিরঝিল থানায় আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অথচ যে অভিযোগ ওই ধরনের ঘটনাই ঘটেনি। আমার ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কখনও দেখিনি যে ঘটনা ঘটেনি তা নিয়ে মামলা হতে পারে।
ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৪ দল নেতারা বলেছেন, আলোচনা বা সমঝোতা যাই হোক তা হতে হবে সংবিধানের ভেতরে থেকে। বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, আমরা পরিস্কার বলেছি সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না। এনিয়ে বৈঠকে আলোচনার সময় মওদুদ আহমদ বলেছেন, আমাদের সাতটি দাবির মধ্যে সাড়ে ছয়টির জন্য সংবিধান সংশোধানের দরকার নেই। এগুলো নির্বাহী আদেশেই করা সম্ভব।এগুলো নির্ভর করবে আপনাদের (সরকারের) সদিচ্ছার ওপর। যেমন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টির সঙ্গে সংবিধানের কোনো সম্পর্ক নেই। সংসদ বাতিল করতেও সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়বে না। সরকার সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় কিনা, সেই সদিচ্ছার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সংলাপ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সংসদ ভেঙে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবি তোলা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত রোববার সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠান। পরদিনই সংলাপে রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার সকালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেন কামাল হোসেনের কাছে। বিএনপি নেতারা তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে জোর দিলেও সংলাপের আমন্ত্রণের চিঠিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানসম্মত উপায়ে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় গুরুত্বারোপ করেছেন। গণফোরাম, বিএনপি, জাসদ (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়।
মোমবাতি হাতে গণভবনের সামনে ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মীরা: প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের সংলাপ শুরু হওয়ার পরই গণভবনের সামনের আইল্যান্ডে স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে অবস্থান নেন জাতীয় যুব ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাকর্মীরা। মোমবাতি হাতে গলায় ব্যানার ঝুলিয়ে তারা এ অবস্থান নেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা যায় পর গণভবন এলাকায় কারও কারও হাতে মোমবাতি ও ব্যানার দেখা যায়। ‘সংবিধান ওহি নয়, জনগণের জন্যই সংবিধান’, ‘জনগণ ভোট দিতে চায়, ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ফলপ্রসূ সংলাপ চাই’, ‘সংবিধান জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা নয়’ ইত্যাদি স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন দেখা যায়। (দৈনিক ইত্তেফাক)