নিউইয়র্ক ০২:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মুজিববর্ষের উপহার : পাটনি সম্প্রদায়ের স্বপ্ন বুনন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:৫৪:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • / ২৯ বার পঠিত

হাসিবুল হাসান, রংপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে: শীতের বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। কিন্তু বাড়ির উঠোনে স্বামী-স্ত্রীর হাতের কাজ থেমে নেই। উপার্জনের একমাত্র উৎস ডালা, কুলা ও চালনিসহ গৃহস্থালির নানা জিনিসপত্র তারা বুনে চলেছেন। পূর্বসূরিদের পেশা তারা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর বড়গোলা গ্রামের কয়েকটি ঘরে এভাবে ব্যস্ত সময় পার করেন পাটনি সম্প্রদায়ের লোকজন।
যমুনাশ্বরী নদীর পাশে বড়গোলা গ্রামে পাটনি সম্প্রদায়ের ৩২টি পরিবার বসবাস করে। শীত-বর্ষায় ছন বা খড়ের ভাঙা ঘরে পরিবার নিয়ে তাদের দিন কেটেছে বহু দুঃখ-কষ্টে। দু-একটি পরিবার ছাড়া কারোই ভালো থাকার ঘর ছিল না। সমতলের ৬১টি জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘর দেওয়ায় তাদের সেই কষ্টের দিন ফুরিয়েছে। ৩২টি পরিবারের মধ্যে ২৫টি পরিবারকে সেমিপাকা বা পাকা নতুন ঘর দেওয়া হয়েছে।
পরিবারগুলোর জন্য পাঁচটি পাকা শৌচাগারও স্থাপন করা হয়েছে। ফলে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন এসব মানুষ। ডালা, কুলা ও চালনিতেই তারা বুনছেন নতুন জীবনের স্বপ্ন। ঘর-পাওয়া মানুষগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে সরকারের সহায়তা কামনা করেছেন।
গ্রামের বাসিন্দা মানিক চন্দ্র তরনীদাস ও তার স্ত্রী ফুলকলি বাড়ির আঙিনায় বসে ডালি-কুলা-চালনি তৈরি করেন। ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কেনা দুটি বাঁশ দিয়ে তারা এক সপ্তাহে এগুলো বুনেন। এরপর মানিক হাটে হাটে সেগুলো ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করেন। এ আয় দিয়ে তার পাঁচ সদস্যের পরিবারের গোটা সপ্তাহের খরচ চালাতে হয়। মানিকের মতো অবস্থা এখানকার বেশির ভাগ মানুষের। কয়েকটি পরিবারের সন্তান স্কুলে যায়।
মানিক তরনীদাস বলেন, বাপ-দাদার পেশাটাই আমরা করতে পারি। অন্য কাজ তো করতে পারি না। আমরা চাই সরকার এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করুক। আমরা যাতে প্রশিক্ষণ পাই, ঋণ পাই। এলাকার বিনোদ বিহারী তরনীদাস, সাবিত্রী রানী তরনীদাস, শিবুরাম তরনীদাস ও দুলাল চন্দ্র তরনীদাস একই ধরনের কথা বলেন। সরকারের কাছ থেকে ঘর পাওয়ায় তারা আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে আরাধ্য দেবতার পূজার জন্য এলাকার মন্দিরের উন্নয়নে তারা সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
জানতে চাইলে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে সাড়ে তিন হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ঘর নির্মাণ-কার্যক্রম চলছে। রংপুরের পাঁচটি উপজেলায়ও এ কার্যক্রম চলছে। কয়েকটি উপজেলায় ঘর হস্তান্তরও করা হয়েছে।
সুভাগীর ভাঙা ঘরে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি: সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার প্রতাপ বাজারের কাছে সুভাগীর ঘর। ঘর বললে ঠিক বলা হবে না- ঝুপড়ির মতো দু-চালার ছাউনি। ২০ বছর আগে স্বামীহারা সুভাগী দুই ছেলেকে নিয়ে এ ঘরে থাকতেন। কয়েক বছর আগে তার বড় ছেলে মারা যায়। জীবনযুদ্ধে সব হারানো মানুষটি অনেক কথা ঠিক করে বলতে পারেন না। তার এখন একটি নতুন ঘর হয়েছে। তাও আবার পাকা ঘর। তার কাছে এগিয়ে যেতেই ডেকে নিলেন আগে যে ভাঙা ঘরে থাকতেন তার সামনে। উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন- ‘এখানে কতটা কষ্টে থাকতে হতো আপনিই বলেন! এরপর যা শোনালেন তা এক নিদারুণ জীবনযুদ্ধের গল্প। তার ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে তিনটি ছবি বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি চোখে পড়ল। সুভাগী বলেন, অনেক বছর ধরে এগুলো ঘরে রাখি। এজন্য অনেকে অনেক কথা বলেন। অনেকে পাগলও বলেন।
ছবিগুলো কেন টাঙিয়েছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা তো আমাদের মতো গরিব মানুষদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমরা তো তাদের জন্য কিছুই করতে পারি না। তাই ছবিগুলো ঘরে রাখি। যখন ঘরে আসি সম্মান জানাই, শত কোটি প্রণাম জানাই। নতুন ঘরেও ছবিগুলো রাখবেন বলে তিনি জানান।
পাশেই ঘর পেয়েছেন সুভাগীর সৎভাই মদন রবিদাস (৫০)। পেশায় মুচি মদনের পাঁচ মেয়ে। এর মধ্যে একজনের বিয়ে দিয়েছেন। অন্যরা লেখাপড়া করছে। বাড়ির পাশে বালিকা বিদ্যালয়ে তার মেয়ে মমতা দশম ও পূর্ণিমা নবম শ্রেণিতে পড়ে। পাশের কয়েকজন জানান, মদনের মেয়েগুলো খুব মেধাবী। স্কুলশিক্ষক মাওলানা আশরাফুল ইসলাম জানান, মদনের ঘরটা খুব দরকার ছিল। তার মেধাবী মেয়েরা এখন ভালো পরিবেশে বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে।
মমতা জানায়, আগে খুব অসুবিধা হতো। দু-তিন বোন একসঙ্গে এক রুমে বসে পড়তে হতো। ঘুমানোর ভালো জায়গাও আমাদের ছিল না। ঘর পেয়ে আমরা অনেক খুশি। নতুন ঘরে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত মমতা-পূর্ণিমা। চোখে তাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মুজিববর্ষের উপহার : পাটনি সম্প্রদায়ের স্বপ্ন বুনন

প্রকাশের সময় : ১০:৫৪:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১

হাসিবুল হাসান, রংপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে: শীতের বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। কিন্তু বাড়ির উঠোনে স্বামী-স্ত্রীর হাতের কাজ থেমে নেই। উপার্জনের একমাত্র উৎস ডালা, কুলা ও চালনিসহ গৃহস্থালির নানা জিনিসপত্র তারা বুনে চলেছেন। পূর্বসূরিদের পেশা তারা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর বড়গোলা গ্রামের কয়েকটি ঘরে এভাবে ব্যস্ত সময় পার করেন পাটনি সম্প্রদায়ের লোকজন।
যমুনাশ্বরী নদীর পাশে বড়গোলা গ্রামে পাটনি সম্প্রদায়ের ৩২টি পরিবার বসবাস করে। শীত-বর্ষায় ছন বা খড়ের ভাঙা ঘরে পরিবার নিয়ে তাদের দিন কেটেছে বহু দুঃখ-কষ্টে। দু-একটি পরিবার ছাড়া কারোই ভালো থাকার ঘর ছিল না। সমতলের ৬১টি জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘর দেওয়ায় তাদের সেই কষ্টের দিন ফুরিয়েছে। ৩২টি পরিবারের মধ্যে ২৫টি পরিবারকে সেমিপাকা বা পাকা নতুন ঘর দেওয়া হয়েছে।
পরিবারগুলোর জন্য পাঁচটি পাকা শৌচাগারও স্থাপন করা হয়েছে। ফলে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন এসব মানুষ। ডালা, কুলা ও চালনিতেই তারা বুনছেন নতুন জীবনের স্বপ্ন। ঘর-পাওয়া মানুষগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রিতে সরকারের সহায়তা কামনা করেছেন।
গ্রামের বাসিন্দা মানিক চন্দ্র তরনীদাস ও তার স্ত্রী ফুলকলি বাড়ির আঙিনায় বসে ডালি-কুলা-চালনি তৈরি করেন। ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় কেনা দুটি বাঁশ দিয়ে তারা এক সপ্তাহে এগুলো বুনেন। এরপর মানিক হাটে হাটে সেগুলো ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করেন। এ আয় দিয়ে তার পাঁচ সদস্যের পরিবারের গোটা সপ্তাহের খরচ চালাতে হয়। মানিকের মতো অবস্থা এখানকার বেশির ভাগ মানুষের। কয়েকটি পরিবারের সন্তান স্কুলে যায়।
মানিক তরনীদাস বলেন, বাপ-দাদার পেশাটাই আমরা করতে পারি। অন্য কাজ তো করতে পারি না। আমরা চাই সরকার এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করুক। আমরা যাতে প্রশিক্ষণ পাই, ঋণ পাই। এলাকার বিনোদ বিহারী তরনীদাস, সাবিত্রী রানী তরনীদাস, শিবুরাম তরনীদাস ও দুলাল চন্দ্র তরনীদাস একই ধরনের কথা বলেন। সরকারের কাছ থেকে ঘর পাওয়ায় তারা আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে আরাধ্য দেবতার পূজার জন্য এলাকার মন্দিরের উন্নয়নে তারা সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
জানতে চাইলে রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে সাড়ে তিন হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ঘর নির্মাণ-কার্যক্রম চলছে। রংপুরের পাঁচটি উপজেলায়ও এ কার্যক্রম চলছে। কয়েকটি উপজেলায় ঘর হস্তান্তরও করা হয়েছে।
সুভাগীর ভাঙা ঘরে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি: সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার প্রতাপ বাজারের কাছে সুভাগীর ঘর। ঘর বললে ঠিক বলা হবে না- ঝুপড়ির মতো দু-চালার ছাউনি। ২০ বছর আগে স্বামীহারা সুভাগী দুই ছেলেকে নিয়ে এ ঘরে থাকতেন। কয়েক বছর আগে তার বড় ছেলে মারা যায়। জীবনযুদ্ধে সব হারানো মানুষটি অনেক কথা ঠিক করে বলতে পারেন না। তার এখন একটি নতুন ঘর হয়েছে। তাও আবার পাকা ঘর। তার কাছে এগিয়ে যেতেই ডেকে নিলেন আগে যে ভাঙা ঘরে থাকতেন তার সামনে। উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন- ‘এখানে কতটা কষ্টে থাকতে হতো আপনিই বলেন! এরপর যা শোনালেন তা এক নিদারুণ জীবনযুদ্ধের গল্প। তার ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে তিনটি ছবি বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি চোখে পড়ল। সুভাগী বলেন, অনেক বছর ধরে এগুলো ঘরে রাখি। এজন্য অনেকে অনেক কথা বলেন। অনেকে পাগলও বলেন।
ছবিগুলো কেন টাঙিয়েছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা তো আমাদের মতো গরিব মানুষদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমরা তো তাদের জন্য কিছুই করতে পারি না। তাই ছবিগুলো ঘরে রাখি। যখন ঘরে আসি সম্মান জানাই, শত কোটি প্রণাম জানাই। নতুন ঘরেও ছবিগুলো রাখবেন বলে তিনি জানান।
পাশেই ঘর পেয়েছেন সুভাগীর সৎভাই মদন রবিদাস (৫০)। পেশায় মুচি মদনের পাঁচ মেয়ে। এর মধ্যে একজনের বিয়ে দিয়েছেন। অন্যরা লেখাপড়া করছে। বাড়ির পাশে বালিকা বিদ্যালয়ে তার মেয়ে মমতা দশম ও পূর্ণিমা নবম শ্রেণিতে পড়ে। পাশের কয়েকজন জানান, মদনের মেয়েগুলো খুব মেধাবী। স্কুলশিক্ষক মাওলানা আশরাফুল ইসলাম জানান, মদনের ঘরটা খুব দরকার ছিল। তার মেধাবী মেয়েরা এখন ভালো পরিবেশে বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে।
মমতা জানায়, আগে খুব অসুবিধা হতো। দু-তিন বোন একসঙ্গে এক রুমে বসে পড়তে হতো। ঘুমানোর ভালো জায়গাও আমাদের ছিল না। ঘর পেয়ে আমরা অনেক খুশি। নতুন ঘরে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত মমতা-পূর্ণিমা। চোখে তাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন। (দৈনিক যুগান্তর)